‘মশাই, কোন সালে জন্ম আপনার?’ কয়েক বছর আগে অবধি এরকম প্রশ্নের উত্তরে কোনও আম ভারতীয় বলতেন, ‘ওই যে বছর বন্যা হল, সে বছরে’ কিংবা ‘ভূমিকম্পের পরের বছর’। সালের অনুল্লেখ ছিল অবশ্যম্ভাবী। আর সালটা যে দিন থেকে শুরু হচ্ছে, সেই নিউ ইয়ার্স ডে বা নববর্ষের দিনটা কেউ খেয়ালই করত না। আঞ্চলিক পঞ্জিকা নিয়ে যারা মাথা ঘামাত তাদের ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য কথা। স্রেফ ব্যবসায়িক কাজকর্মে দরকার পড়লে তবেই সাল-বছরের দিকে নজর পড়ত কারণ অনেকের কারবারের হিসাবনিকাশের শুরু হত সেদিন থেকে। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে বদলে গেল সব কিছু। ‘হ্যাপি বার্থডের সঙ্গে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার্স ডে’ ঢুকে পড়ল আমাদের জীবনে, প্রবলভাবে। পশ্চিমি দুনিয়ার বছরের প্রথম দিন ১লা জানুয়ারি সারা বিশ্বে নববর্ষের দিন হিসেবে স্বীকৃত হল। অথচ এই মান্যতা পাওয়ার জন্য দিনটাকে কম লড়াই করতে হয়নি।
আরও পড়ুন-উদ্বোধনের আগেই রাম মন্দিরের নামে দু.র্নীতি
নববর্ষ পালনের প্রথম ইতিহাসের খোঁজ মেলে খ্রিস্ট পূর্ব ২০০০ অব্দে তদানীন্তন মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ আজকের ইরানে। তবে সেটা ১ লা জানুয়ারি পালিত হত না। ২১/২২ মার্চ বসন্ত বিষুবের সঙ্গে সঙ্গত করে পালিত হত সেই দিন। বসন্ত বিষুবের ঠিক পরবর্তী অমাবস্যা থেকে তখন শুরু হত বর্ষ গণনা। প্রাচীন মিশরীয়, ফিনিশীয় আর পারস্যগণ বসন্তের চেয়ে শরৎকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাই তাঁদের বর্ষ গণনা শুরু হয় শারদ বিষুব ২১ ডিসেম্বর থেকে। প্রাচীন গ্রিকরা বছর গুনতে শুরু করতেন ২১ ডিসেম্বর অর্থাৎ দক্ষিণায়নের সময় থেকে। রোমানরা যখন দুনিয়ার কর্তৃত্ব দখলে নিল তখন তারা খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ অব্দতে ১লা জানুয়ারি থেকে চালু করল সরকারি বর্ষ গণনা। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে জুলিয়াস সিজারের নামাঙ্কিত জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ঢুকে পড়ল দিনটা। রাজস্বের হিসাবপত্র আর সুদের অঙ্ক কষতে দিনটার গুরুত্ব অশেষ ছিল।
মধ্য যুগের সূচনা লগ্নে সাম্রাজ্য, বাণিজ্য, কর লেনদেন, এসব ছাপিয়ে প্রবল গুরুত্ব অর্জন করল চার্চ। চার্চের ইচ্ছেমতো ২৫ মার্চ ঘোষণার পরবের দিন থেকে বছর গোনা শুরু হল। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী ইউরোপ সেটা মেনেও নিল। ব্যতিক্রম অ্যাংলো স্যাকসন ইংল্যান্ড। তারা ২৫ ডিসেম্বরেই বছর গোনা শুরু করত। কয়েক শতাব্দী পরে দেখা গেল ইংল্যান্ডবাসীর একাংশ খ্রিস্ট দুনিয়ার তালে তাল মিলিয়ে ২৫ মার্চকে নববর্ষের দিন হিসেবে মেনে নিয়েছে।
আরও পড়ুন-বিপাকে বিজেপি! সংসদে হানাদারদের ‘পাস’ দেওয়া সাংসদের ভাই গ্রেফতার
১৮৫২য় রোমান ক্যাথলিক চার্চ জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের বদলে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারকে মান্যতা দিল। এই ক্যালেন্ডার অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক। তখন থেকে ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। অধিকাংশ ইউরোপীয় দেশ সেই পথ নিল। ১৬৬০-এ এই পথের পথিক হল স্কটল্যান্ড। ১৭০০-তে জার্মানি আর ডেনমার্ক। নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডকে ‘দোকানদারের জাত’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ইংরেজরা ততদিনে এশিয়াতে বাণিজ্য বিস্তার করে ফেলেছে। এদিকে অন্য দেশগুলোর বছর গোনার ধরন অন্য রকম হওয়ায় হিসাবপত্র মেলাতে বিস্তর অসুবিধা হত। তাই পলাশির যুদ্ধের বছর পাঁচেক আগে, ১৭৫২-তে ইংল্যান্ডও বছর শুরুর দিন হিসেবে ১ জানুয়ারিকে মেনে নিল। তখন বিশ্ব জুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। উপনিবেশের সর্বত্র সেই কানুন চালু হল। আর ভারতীয়রা? ঘরের ভেতর তারা যতই পাঁজি-পুঁথি, তিথি উৎসব, অশ্লেষা মঘা মেনে ভোজন উপবাস করুক না কেন, বাইরে তাদের ইংরেজ সাহেবের চালচলন মেনে প্যান্ট-শার্ট, বাস-ট্রেন, ঘড়ি আর ক্যালেন্ডার এসে গিয়েছিল। দ্বৈত জীবন আঁকড়ে ধরল তারা। বিশ্বায়নের যুগে আমরা বাবা-মাকে মাম্মি ড্যাডি বলতে শুরু করেছি। হ্যাপি বার্থডে পালনে জোয়ার এসেছে। আর সেই সঙ্গে কেক আর মিউজিক সহযোগে নিউ ইয়ার পালনের রীতিও। হ্যাপি নিউ ইয়ার!!!