উনিশ শতকের শহরে বাঙালির আচরণ, রসিকতা আর সেকালের শহরের নানা প্রথা আচার-অনুষ্ঠান আর যানবাহনের বিস্তৃত বর্ণনা ফুটিয়ে তোলা নাগরিক বৃত্তান্তের জীবন্ত ছবি পাওয়া যায় হুতোম প্যাঁচার নকশায়। সামাজিক ছবি আর ব্যক্তি বিশেষকে বিদ্রুপ— দুই নিয়েই ‘হুতোমের নকশা’। কলকাতার চড়ক পার্বণ, বারোয়ারি পুজো, নানা হুজুগ, দুর্গোৎসব— এই সবকিছু নিয়েই কলম ধরেছিলেন হুতোম। চড়ক পার্বণ নিয়ে হুতোমের বর্ণনায় আমরা দেখি…
আরও পড়ুন-বাঙালির নিজস্বতা
‘‘কলিকাতা সহরের চারদিকেই ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্ছে … এদিকে আমাদের বাবুদের গাজন তলা লোকারণ্য হয়ে উঠতে লাগলো, ঢাক বাজতে লাগলো, শিবের কাছে মাথাচালা আরম্ভ হল; সন্ন্যাসীরা উবু হয়ে বসে মাথা ঘোরাচ্চে, কেহ ভক্তিযোগে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে পড়েচে… শিবের বামুন কেবল গঙ্গাজল ছিটুচ্চে…গাজন তলায় ঢাক ঢোল বেজে উঠল, সকলে উচ্চস্বরে ‘ভদ্রেশ্বরে শিবো মহাদেব’ বলে চিৎকার করতে লাগল। ক্রমে গিজ্জের ঘড়িতে ঢং ঢং ঢং করে সাতটা বেজে গেলো। সহরে কানপাতা ভার। রাস্তায় লোকারণ্য, চারিদিকে ঢাকের বাদ্যি, ধূনোর ধোঁ… সন্ন্যাসীরা বাণ, দশলকি, সুতোশোন, সাপ, ছিপ ও বাঁশ ফুঁড়ে একেবারে মরিয়া হয়ে নাস্তে নাস্তে কালীঘাট থেকে আসচে।”
অনেকে চড়ক ঘোরা, বান ফোঁড়া, তরোয়াল ফোঁড়া দেখতে ভালবাসেন। আমরা সবাই জানি যে চৈত্রের শেষ দিনে চড়কের মেলা হয়। সেই মেলা প্রসঙ্গে হুতোম বর্ণনা করেছেন এইভাবে— ‘‘এদিকে চড়ক তলায় টিনের ঘুরঘুরী, টিনের মহুরী দেওয়া তলতা বাঁশের বাঁশী, হলদে রং করা বাখারির চড়ক গাছ, ছেঁড়া ন্যাকড়ার তৈইরি গুরিয়া পুতুল, শোলার নানা প্রকার খেলনা, পেল্লাদে পুতুল, চিত্তির করা হাঁড়ি বিক্রি কত্তে বসেচে।
আরও পড়ুন-নববর্ষে বর্ধমান মহাজনটুলি কথা
‘ড্যানাক ড্যানাক ড্যাডাং ড্যাং
চিঙ্গড়ি মাছের দুটো ঠ্যাং’
ঢাকের বোল বাজ্জে। একজন চড়কী পিঠে কাঁটা ফুড়ে এসে চড়ক গাছের সঙ্গে কোলাকুলি কল্লে— সকলেই চড়কীর পিঠের দিকে চেয়ে রইলেন। চড়কী প্রাণপণে দড়ি ধরে কখনো ছেড়ে, পা নেড়ে ঘুত্তে লাগলো। কেবল ‘দে পাক দে পাক’ শব্দ। কারু সর্বনাশ কারু পৌষ মাস। একজনের পিঠ ফুড়ে ঘোরানো হচ্চে, হাজার লোকে মজা দেকছেন!”
এই তো গেল হুতোমের বর্ণনা। এবার আসি পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে শিবের উপাসক বাণ রাজা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজের গায়ের রক্ত দিয়ে নৃত্য-গীত পরিবেশন করেছিলেন। তাই শিবকে প্রীত করার জন্য আত্মনির্যাতনের মাধ্যমে গাজন উৎসব হয়। বাণফোঁড়া, জিহ্বাফোঁড়া, আগুনে ঝাঁপ, আগুনের উপর হাঁটা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-রাজ্যের ন্যায্য প্রাপ্য ১.১৫ লক্ষ কোটি টাকা ফেরত দিন, আমি রাজনীতি ছেড়ে দেব: শাহকে বিঁধে অভিষেক
সেকাল-একাল যাই হোক না কেন, নববর্ষের প্রাক্কালে চড়ক ও গাজন উৎসব আজও সমান জনপ্রিয়। যদিও অঞ্চল ভেদে এর বৈশিষ্ট্য আলাদা, তবে এই উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল চড়কের পুজো আর মেলা। গাজন বা চড়ক উৎসবের পরেই আসে নববর্ষ। এবার এই নতুন বছরকে, সেই সময় কালকে নিয়ে হুতোম কী বলেছেন একটু দেখে নেওয়া যাক।
‘‘ইংরেজরা নিউ ইয়ারে বড় আমোদ করেন। আগামীকে দাড়িগুয়া পান দিয়ে বরণ করে নেন। নেসার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরাণ কে বিদায় দেন। বাঙ্গালিরা বছরটী ভাল রকমেই আর খারাবেই শেষ হোক, সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরাণকে বিদায় দ্যান। কেবল কলসি উচ্ছুগগু কর্ত্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।”
আরও পড়ুন-বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনায় কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
সেকাল থেকে একাল, নববর্ষ মানেই ব্যবসায়ীদের নতুন খাতায় মঙ্গলচিহ্ন এঁকে লক্ষ্মী-গণেশের পুজো দিয়ে হালখাতার সূচনা করা। বাঙালি দোকানগুলোও সেজে ওঠে। দরজায় দেওয়া হয় স্বস্তিক চিহ্ন। শুধু তাই নয়, সেকালে অতিথি-অভ্যাগতদের জন্যও থাকত দরাজ আয়োজন। তৈরি হত খাস্তা নোনতার মিষ্টি। এই খাওয়ানোকে বলা হত ‘উঠনো’।
দোকানে-দোকানে হালখাতার ধুম থাকত চোখে পড়ার মতো। আমন্ত্রিত অতিথিদের দোকানে ঢোকার সময় ছড়ানো হত সুগন্ধী গোলাপজল। প্রথমেই দেওয়া হত কেওড়া ভেজানো ঠান্ডা জল, থাকত মিষ্টি-সহ ভূরিভোজের ব্যবস্থা।
সেকালে বিভিন্ন রকমের সঙদের দেখা মিলত রাস্তায় নববর্ষের দিনে। সঙ বার করা নিয়ে বাবুদের মধ্যে চলত প্রতিযোগিতা। এবার জানা যাক, সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর কথা।
আরও পড়ুন-অধ্যক্ষের নিশানায় বিচারপতি!
কীভাবে নববর্ষ পালিত হত সেই সব পরিবারে? খাওয়াদাওয়া, আনন্দ উৎসব পালন হত কীভাবে? অন্দরমহলের মহিলারাই বা কীভাবে উদযাপন করতেন বছরের প্রথম দিনটিকে?
আভিজাত্যের নিরিখে প্রথমেই আসি রুচি-সংস্কৃতির পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ির কথায়। শোনা যায়, ওঁদের বিচিত্র শখ-শৌখিনতার কথা। একেক বছর একেকরকম ভাবে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতেন ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা।
সরলা দেবী চৌধুরানী লিখেছেন— ‘‘সেদিন আমাদেরও পারিবারিক উৎসবের দিনে পরস্পরকে আলিঙ্গন, প্রণামাদি করা হত। সে নববর্ষে। পয়লা বৈশাখে। নতুন কাপড় পরার রেওয়াজও কতকটা সেই দিনটিতে ছিল। এক হিসাবে এইটিই আমাদের যথার্থ পারিবারিক মিলনের দিন। সেদিন অতি ভোরে ব্রাহ্মমুহূর্তে দেউড়িতে ঘণ্টা বেজে উঠতো। ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে উঠে বাড়িশুদ্ধ পুরুষেরা নবশুদ্ধ বস্ত্র পরিধান করে প্রস্তুত হয়ে, উঠোনে উপাসনা সভায় সমবেত হতেন। আর মেয়েরা খড়খড়িতে। উপাসনাদি হয়ে গেলে বয়সের তারতম্য অনুসারে আলিঙ্গনাদি সেরে মেয়ে মহলেও সরবত পান হত বাইরে… আর বাড়ির লোকেদের সেদিন সকলের একত্রে ভোজন হতো মধ্যাহ্নে।”
আরও পড়ুন-বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনায় কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
সম্ভ্রান্ত বা অভিজাত পরিবারের পুরুষদেরও এই নতুন বছর ঘিরে থাকত নানারকম শখ-শৌখিনতা।
একবার নাকি দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর নতুন বাগানবাড়িতে সাহেব-মেমদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। পাশ্চাত্য সংগীত-নৃত্যে নববর্ষের সন্ধে হয়ে উঠেছিল জমজমাট। আবার বাগবাজার, শোভাবাজার, পাথুরিয়াঘাটা, চোরবাগান অঞ্চলের বাবুরা সেদিন সাজবেন চুনোট করা ধুতি আর ফিনফিনে মসলিনের পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে। কোনও পরিবারে ধুমধাম সহকারে গৃহদেবতার পুজো হত তো আবার কোনও পরিবারে আসর বসত কালোয়াতি গানের। রাতভর চলত জলসা। বাইনাচের আসরও বাদ যেত না। নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে, হাতে পানপাত্র আর জুঁই-বেলফুলের মালা নিয়ে, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে জুত করে বসে জমিয়ে উপভোগ করতেন সেকালের অভিজাত পরিবারের বিলাসীবাবুরা। শহরের বিখ্যাত কোনও নর্তকীর নাচের বোলে, সারেঙ্গির তানে, নামকরা গাইয়ের সুরের মূর্ছনায় আর রুপোর পাত্রে রাখা রকমারি ফুলের সুগন্ধে সে এক মায়াবী পরিবেশ!
আরও পড়ুন-বেলুড় মঠে রাজ্যপাল
বাবুরা নাচাগানা মজলিশে ব্যস্ত থাকলেও কিন্তু গৃহদেবতার পুজোপাঠ নিয়েই দিনটা কাটাতেন অন্তঃপুরের মেয়ে-বউরা। তবে তার জন্য প্রস্তুতিও নিতেন অনেক আগের থেকে। দু’দিন আগেই আলতা দাসী এসে আলতা পরিয়ে দিতেন।
বহু আগে পরিচিত তাঁতিনীর কাছ থেকে ঘরে বসেই সেরে নিতেন পছন্দের কেনাকাটা।
এ-ছাড়া নতুন বছরে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলারা নতুন গয়না গড়াবেন না তা কি হয়? পারিবারিক রীতি অনুযায়ী স্যাকরা আসবেনই। রুচি এবং পছন্দমফিক অমৃতপাক বালা, গোলাপফুল বালা, রতনচূড়, বাজুবন্ধ কী থাকত না সেই তালিকায়!
সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার… এই জন্যেই বুঝি কবি বলেছিলেন। গয়না বানানো নিয়ে অভিজাত পরিবারগুলির মধ্যে চলত সূক্ষ্ম রেষারেষি। সৌন্দর্য, নকশা, রুচি আর আভিজাত্যে কারটি সবার সেরা, এই নিয়ে চলত এক অলিখিত প্রতিযোগিতা। উৎসব অনুষ্ঠানে বাড়ির মহিলাদের গয়না নিয়ে মজার সব কাহিনি রয়েছে।
আরও পড়ুন-ধনধান্য অডিটোরিয়ামের উদ্বোধন, ২০২৪ পর্যন্ত টাকা দেবে না কেন্দ্র
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক পুত্রবধূ প্রফুল্লময়ীর আত্মকথা থেকে জানা যায়— ‘‘উৎসবের সময় আমাদিগকে নানা রকম গহনা পরিয়া সাজিতে হইত। এখনকার মতো তখনকার দিনে গহনা অতো হালকা ছিল না। পরিবারের যে নতুন বউ তাহাকে আরো বেশি গহনা পরিয়া সাজিতে হইত। গলায় চিক, দিবালা, বাজুবন্ধ বীরবৌলি, কানবালা, মাথায় জড়োয়া সিঁথি। পায়ে গোড়ে, জোড়, মল, ছানলা চুটকি।”
নববর্ষের আগে গাজনতলায় বা শিবের পুজো দিতে বাড়ির মহিলারা অনেক সময় বের হতেন। তবে পালকির ভিতরে থাকায় তাঁদের দেখা তো যেতই না, ক্ষণিক আলোকে চোখের পলকে হয়তো কঙ্কনপরা দুটো হাত অথবা লাল টুকটুকে পাড়ের শাড়ির ঈষৎ আভাস। ব্যস, ওইটুকুই। তবে পালকির রং এবং ঘেরাটোপ দেখে কোন পরিবারের পালকি তা অনুমান করা হত। যেমন ঠাকুর পরিবারের পালকির রং নাকি ছিল টুকটুকে লাল এবং সাটিনের হলুদ পাড় দেওয়া। ইতিহাস বলে মুঘল সম্রাট আকবরের আমল থেকেই বাংলায় নববর্ষের শুরু। অনেক গবেষক আবার বলেন মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব। তাঁর শাসনকালে ‘পুণ্যাহ’ বলে একটি উৎসব পালন করা হত। এই দিনে প্রজারা তাঁদের বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দিতেন। রাজ কর আদায়ের উৎসব ‘পুণ্যাহ’ অর্থাৎ পুণ্যের দিন। প্রজারা সকলে নতুন জামা-কাপড় পরে আসতেন। লাল জাবদা খাতায় ধান-দূর্বা দিয়ে রুপোর মোহরকে সিঁদুর মাখিয়ে তার ছাপ দেওয়া হত সেই খাতায়। প্রজাদের মিষ্টিমুখ করানোর সঙ্গে সঙ্গে গান-বাজনা ও যাত্রাপালার মতো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন জমিদাররা বা রাজারা। জমিদারি প্রথার বিলুপ্তের পর বন্ধ হয়ে যায় পুণ্যাহ। কিন্তু রয়ে যায় হালখাতার উৎসব।
আরও পড়ুন-নয়া বাঘারুর কীর্তি
ভোজনরসিক বাঙালির উৎসব সম্পন্ন হয় না ভূরিভোজ ছাড়া। কোনও বাড়িতে সুগন্ধী পোলাও তো কোথাও কচিপাঁঠার ঝোল— বাদ যায় না কিছুই। আভিজাত্যের শিরোমণি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বারান্দায় বসে খাওয়াদাওয়া চলত জমিয়ে। চালতা দিয়ে মুগের ডাল, নারকেল চিংড়ি, কাঁচা ইলিশের ঝোল, ইলিশের পোলাও, আম দিয়ে শোলমাছ-সহ নানা বাহারি ও বৈচিত্র্যময় পদে জমে উঠত নববর্ষের দিন। গান-বাজনা, খাওয়াদাওয়া, হালখাতা উৎসবকে স্বাগত জানাতেন বিলাসীবাবুরা। বাবুবিলাস কালের নিয়মেই মুখ লুকিয়েছে। নববর্ষের আনন্দ-উৎসব কিন্তু আজও রয়ে গিয়েছে বাঙালির মজ্জায় এবং মননে।