বরের দেখা নেই
সেদিন বৌভাত। ঘর ভর্তি লোকজন। তুমুল ব্যস্ততা। পরিবারের প্রায় সবাই হাজির। অথচ সন্ধেবেলায় খোদ বরের দেখা নেই! কোথায় তিনি? শুরু হল খোঁজ। নববধূর কানে গেল খবর। চিন্তার ভাঁজ তাঁর কপালে। ভাবলেন, এ কার সঙ্গে বিয়ে হল আমার! এদিক-ওদিক অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে পাওয়া গেল বরকে। চাঁদনিরাতে উশ্রী নদীর পাড়ে বসে সদ্য বিবাহিত সুদর্শন যুবকটি বন্ধুদের বাঁশি বাজিয়ে শোনাচ্ছেন। এতটাই উদাসীন, আপনভোলা ছিলেন তিনি— কবি সুনির্মল বসু। ঘটনাটির কথা জানালেন কবি-পুত্র অভীক বসু। যদিও বাবার স্মৃতি তাঁর কাছে প্রায় আবছা। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি পিতৃহীন। বাবার কথা জেনেছেন মূলত মা নীহারিকা এবং পরিবারের অন্যদের মুখে।
আরও পড়ুন-নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই রাজ্যে ১৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী
মহানায়কের ছায়াছবিতে গান
আজীবন শিশুসাহিত্যের সাধনা করে গেছেন সুনির্মল বসু। ছোটদের কথা ভেবে লিখেছেন ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, পুরাণ কাহিনি। পাশাপাশি করেছেন অভিধান সম্পাদনার কাজও। কোনওদিন ছন্দ চিন্তা করে কবিতা রচনা করতে হয়নি। ছন্দ যেন স্বাভাবিক ভাবেই ধরা দিয়েছে তাঁর কলমে। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা ছায়াছবি ‘কামনা’। নব্যেন্দু সুন্দরের পরিচালনায়। অভিনয়ে মহানায়ক উত্তমকুমার। ওই ছবির জন্য গান লিখেছিলেন সুনির্মল বসু। তাঁর রচিত ‘আকাশের চাঁদ মাটির পরেতে’ গানটি হিমাংশু দত্তের সুরে উমা বসুর কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছিল। সুনির্মল বসু দুর্দান্ত অভিনেতাও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন নক্ষত্ররায়ের চরিত্র। তাঁর ছবি আঁকার হাতটিও ছিল চমৎকার। যুক্ত ছিলেন ওরিয়েন্টাল স্কুল অফ আর্টসের সঙ্গে। শিক্ষাগুরু ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুনির্মল বসুর বিয়ের স্মরণিকাকে আলোকিত করেছিলেন শিল্পাচার্য।
আরও পড়ুন-হাওড়া-শিয়ালদহ শাখায় বাতিল একাধিক লোকাল
মুগ্ধ হন বনফুল
ক্ষমতা ছিল। তবে সেইভাবে বড়দের জন্য সাহিত্যচর্চা করেননি সুনির্মল বসু। তবে একবার একটি জনপ্রিয় পত্রিকায় লিখেছিলেন প্রাপ্তমনস্ক গল্প। সাহিত্যিক বনফুলের ‘স্ত্রী’ গল্পটি পড়েছিলেন। তিনি বনফুলকে দেখান। লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হন বনফুল। বলেন, সুনির্মল চিরকাল শিশুদের মতো নেকার বুকার পরেই কাটিয়ে দিল। কোর্ট প্যান্ট পরে বড়দের সাহিত্য করল না। বড়দের সাহিত্য করলে ও খুবই নামজাদা সাহিত্যিক হত। সেই মুহূর্তে উপস্থিত ছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস।
ছড়ায় অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি
জীবিত কালেই পেয়েছিলেন জনপ্রিয়তা। মাতিয়ে তুলতেন সভা সমাবেশ। একটি ঘটনার উল্লেখ করলেন কবি-পুত্র। একবার নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাঁচিতে। সভাপতি ছিলেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধান অতিথি সুনির্মল বসু। প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। চলছে অনুষ্ঠান। তার মাঝেই কাগজ কলম টেনে নিয়েছেন সুনির্মল বসু। লিখে চলেছেন দীর্ঘ ছড়া। অনুষ্ঠানটি নিয়েই। লেখা শেষ হলে বিভূতিভূষণ-সহ অন্যদের অনুরোধে করলেন পাঠ। সুনির্মল বসুর ছড়াপাঠ শুনতে শুনতে উপস্থিত সাহিত্যিকরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন। ওই ছড়ায় তুলে ধরা হয়েছে অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি বিবরণ। উঠল তুমুল করতালি। পাশের প্রেক্ষাগৃহে চলছিল একটি রাজনৈতিক দলের সভা। করতালির আওয়াজ পৌঁছল সেই সভার লোকজনদের কানে। সেখান থেকে তাঁরা ছুটে এলেন এই প্রেক্ষাগৃহে। সুনির্মল বসুর ছড়া শোনার জন্য। সে এক হইহই ব্যাপার।
আরও পড়ুন-চাঁদমামা ফের ডাকছে
শ্রদ্ধা করতেন জাদুসম্রাট
জাদুসম্রাট পিসি সরকার নিয়মিত আসতেন সুনির্মল বসুর বাড়িতে। তিনি কবিকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। ডাকতেন বড়দা বলে। তাঁর ম্যাজিক শোয়ে বহুবার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু কবি কিছুতেই যাবার সময় পেতেন না। কারণ লেখালিখির চাপ। কিন্তু কতদিন আর না গিয়ে থাকা যায়? একদিন কবি গেলেন মিনার্ভা থিয়েটারে জাদুসম্রাটের ম্যাজিক দেখতে। পিসি সরকার মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকবৃন্দের সামনে বলে উঠলেন, ‘আপনারা আমাকে জাদুসম্রাট বলেন। আজ আমার থেকেও বড় জাদুকর আমার সামনে বসে আছেন। তিনি হলেন আমার দাদা সুনির্মল বসু। আমি যতই ম্যাজিক দেখাই না কেন, ওঁর মতো মুখে মুখে ছড়া-কবিতা বানাতে পারব না।’
ফিরিয়েছিলেন চাকরির প্রস্তাব
সাহিত্যই ছিল সুনির্মল বসুর বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। অন্য কোনও পেশা গ্রহণ করেননি। খুব যে স্বচ্ছলতার মধ্যে দিন কেটেছে, তা নয়। তবে আজীবন সৎ থাকার চেষ্টা করেছেন।
একবার একটি বড় পত্রিকা গোষ্ঠী তাঁকে মোটা মাইনের চাকরির প্রস্তাব দেয়। তিনি যাননি। কারণ যে পদে তাঁকে নিয়োগ করা হচ্ছিল, সেই পদে বহাল ছিলেন তাঁরই এক কবি-বন্ধু। ঘটনাটি জানিয়ে কবি-পুত্র বলেন, বাবা এমন কোনও কাজ করতে চাননি যাতে বন্ধু-বিচ্ছেদ হয়।
আরও পড়ুন-৪ বছরের ভাড়া বাকি, ব্যাঙ্কে তালা ঝোলালেন মালিক
চাঁদের নরম আলো
সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। ১৯০২ সালে ২০ জুলাই— অধুনা ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে জন্ম। সেদিন ছিল শ্রাবণী পূর্ণিমা। আঁতুড়ঘরে নবজাতকের মুখে চাঁদের নরম আলো এসে পড়েছিল। তাই তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল নির্মলচন্দ্র। পরে নাম বদলে রাখা হয় সুনির্মল। তাঁর বহু লেখায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে সাঁওতাল পরগনার কথা, উশ্রী নদীর কথা। একটা সময় তিনি পাকাপোক্তভাবে কলকাতায় চলে আসেন। সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা পান। তবে দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। ১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫৪ বছর বয়সে প্রয়াত হন। পরের দিন প্রমথনাথ বিশি সংবাদপত্রে লিখেছিলেন ‘স্বর্গের নন্দনকাননে বসে এক শিশু মুড়িমুড়কি খাচ্ছে, আরেক শিশু এইমাত্র সেখানে গিয়ে হাজির হল মুড়িমুড়কির ভাগ বসাতে।’ প্রথম শিশুটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার অল্প কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় শিশুটি সুনির্মল বসু।
আরও পড়ুন-নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই রাজ্যে ১৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী
তারাশঙ্কর বলেছিলেন
তাঁর শেষ জন্মদিনে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কবির আঙুলে পাথর খচিত ‘সুনির্মল’ লেখা একটি আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি যতই লিখি না কেন, সুনির্মলের মতো সরল সহজ শিশুসাহিত্য করতে পারব না।’ বহু বছর আগে চলে গেছেন সুনির্মল বসু। থেকে গেছে অসংখ্য রচনা। তাঁর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতার মধ্যে দিয়ে সবাই পেয়ে থাকেন উদারতার পাঠ, কর্মী হবার মন্ত্র। এইভাবেই তিনি থেকে যাবেন। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে।