‘‘Reality doesn’t bite, rather our perception of reality bites.’’
—Anthony J. D’Angelo
কথাটা যে কতটা সত্যি সেটা ভালমতোই বোঝা যাচ্ছে পদ্মপক্ষের কুৎসাবাহিনীর লম্ফঝম্প দেখে। সাড়ে তিন দশকের বাম জমানার দুঃস্বপ্নের স্মৃতিটাই ফেরি করে বেড়াচ্ছে জগাই-মাধাই-গদাইরা। লোডশেডিং অধিকারীদের সৌজন্যে কেউ যদি ঘটনাচক্রে ভেবেও থাকেন বাংলা ১৩ বছর আগে যেমনটি ছিল এখনও তেমনটিই আছে, তবে তিনি সর্বৈব ভুল ভাবছেন। বিভ্রান্ত হচ্ছেন মিডিয়ার একাংশ আর পদ্মপার্টির ঢোল-কাঁসির আওয়াজে।
আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো আপনাদের জানিয়ে বুঝিয়ে বিশ্বাস করিয়ে চলেছে, এগিয়ে গুজরাত (নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ যেখানকার ভূমিপুত্র), কিন্তু প্রকৃত সত্য হল এগিয়ে আমার আপনার পশ্চিমবঙ্গ, পিছিয়ে গুজরাত।
আরও পড়ুন-একশো দিনের কাজ বকেয়া মেটাতে বরাদ্দ ৩৭০০ কোটি
এবং এই নিখাদ সত্যটা প্রকাশ পাচ্ছে অন্য কারও প্রচার কিংবা আত্মজাহিরের সুবাদে নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের পরিবেশিত তথ্য-পরিসংখ্যানের সৌজন্যে। সত্যি কথা বলতে কী, এই উজ্জ্বল সত্যটা হজম করতেও ঢোঁক গিলতে হচ্ছে নীতি আয়োগকেও। তারাও বুঝে পাচ্ছে না কোন জাদুদণ্ডের সৌজন্যে, কোন জিয়ন-কাঠির ছোঁয়ায় এই আপাদমস্তক পরিবর্তন!
আসল কথাটা হল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মা-মাটি-মানুষের সরকারের প্রশাসনিক সাফল্যের অনিবার্য পরিণাম এই পরিবর্তন। ভাইব্র্যান্ট গুজরাতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে বাংলা। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই প্রাক্ ১৯৬০-এর দশক পর্বে ভারতের বৃহত্তম অর্থনীতি ছিল পশ্চিমবঙ্গের। একথাও অনস্বীকার্য, পশ্চিমবঙ্গ তার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে।
একটা একটা করে তথ্যগুলো তুলে ধরা যাক—
(১) জিডিপি-র বিচারে এগিয়ে বাংলা : পশ্চিমবঙ্গের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এখন বাড়তে বাড়তে প্রায় ১৭ লক্ষ ১৯ হাজার কোটি ছুঁই-ছুঁই। ১২টি সামাজিক মাপকাঠির মধ্যে ন’টিতে পশ্চিমবঙ্গ গুজরাতের থেকে এগিয়ে। স্পষ্টতর ভাষায়, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা সাম্প্রতিক কালে গুজরাতে যত কমেছে তার তুলনায় অনেক বেশি হারে কমেছে পশ্চমবঙ্গে।
আরও পড়ুন-আর একমাস আবাস যোজনা নিয়ে কেন্দ্রকে ফের হুঁশিয়ারি
(২) দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)-এ পশ্চিমবঙ্গের অবদান : ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের অবদান ৬ শতাংশের বেশি। পশ্চিমবঙ্গের মোট রাজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিএসডিপি-র হার অতিমারির সময় তলানিতে ঠেকেছিল। তার পরই মা-মাটি-মানুষের সরকারের নেতৃত্বে তা ঘুরে দাঁড়ায়। ২০২১-’২২-এ সেটা পৌঁছায় ১০.৭৬ শতাংশে। ২০২২-’২৩-এ তা হয়, একটু কমে, ৮.৪১ শতাংশ। গত অর্থবর্ষে গুজরাতের জিএসডিপি ৮.৩ শতাংশ।
(৩) উন্নতি স্পষ্ট বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের বিচারেও : ২০১৬-র কথা। তখন গুজরাতের ১৮.৫ শতাংশ মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। পশ্চিমবঙ্গে সে সময় বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২১.৩ শতাংশ। ২০২১-এ, নীতি আয়োগের দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে গুজরাতের ক্ষেত্রে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৬.৮ শতাংশ কমে হয়েছে মোট জনসংখ্যার ১১.৭ শতাংশ। আর পশ্চিমবঙ্গে এই হারটা কমে হয়েছে ১১.৯ শতাংশ। গুজরাতের চেয়ে নিঃসন্দেহে বেশি। কিন্তু দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা কমার হার ৯.৪ শতাংশ।
(৪) পুষ্টির পরিসংখ্যানেও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বাংলা : অপুষ্টিতে ধুঁকতে থাকা বাংলা পুষ্টিপ্রাপ্তির পরিসরে যে অগ্রগতি মা-মাটি-মানুষের সরকারের নেতৃত্বে সম্ভবায়িত করেছে বা এককথায় রোমাঞ্চকর। ২০১৬-তে পশ্চিমবঙ্গের ৩৩.৬ শতাংশ পরিবার অপুষ্টিতে ভুগত। গুজরাতে এই হার ছিল ৪১.৩৭ শতাংশ। ২০১৬-এ এসে দেখা গেল বাংলায় অপুষ্টির শিকার পরিবারের সংখ্যা কমেছে। ১৪ শতাংশ অপুষ্টি কবলিত পরিবার বেরিয়ে এসেছে ওই দুঃসহ অবস্থা থেকে। অপুষ্টি কবলিত পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭.৩ শতাংশ। গুজরাতের ছবিটা কিন্তু এরকম উজ্জ্বল নয়। ডাবল ইঞ্জিন শাসিত গুজরাতে অপুষ্টি কবলিত পরিবারের হার শতাংশের বিচারে মোটে ৩ শতাংশ কমেছে।
আরও পড়ুন-ঋণগ্রহীতাদের জন্য স্বস্তির খবর শোনালেন আরবিআই গভর্নর
(৫) পরিচ্ছন্নতার বিচারেও এগিয়ে বাংলা :
পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও দৃষ্টান্তমূলক উন্নতির নজির স্থাপন করেছে। ২০১৬ থেকে ২০২১, এই পাঁচ বছরে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ১৬ শতাংশ কাটিয়ে উঠেছে। ৪৭.৮১ শতাংশ প্রতিবন্ধকতা কমে হয়েছে ৩২ শতাংশ। পক্ষান্তরে গুজরাতে স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিবন্ধকতা মোটে ১১ শতাংশ কমে ৩৭ শতাংশ থেকে ২৬ শতাংশ হয়েছে। ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ৪.৯৭ শতাংশ পরিচ্ছন্ন পানীয় জলের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হত। গুজরাতে এরকম জনসংখ্যার শতাংশ ছিল ৫.৩ শতাংশ।
(৬) দারিদ্র্যের তীব্রতা কমছে বাংলায় : ২০২১-এর হিসাব। গুজরাতে দারিদ্র্যের তীব্রতা কমেছে ৪৩.২৫ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে এই হ্রাসের পরিমাণ ৪২.৩৫ শতাংশ। দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে শুধু আয় নয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবনযাত্রার মান সংক্রান্ত ১২টি বিষয় বিবেচনা করা হয়। গুজরাত আবাস, রান্নার জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সংযোগের মতো বিষয়ে নিঃসন্দেহে এগিয়ে। এটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও সত্যি যে সার্বিকভাবে দারিদ্র্য মােচনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগতি অনেক বেশি।
(৭) রফতানিতেও এগিয়ে বাংলা : কেবল সামাজিক উন্নতির মাপকাঠিতে নয়, অর্থনীতির অন্যান্য পরিসরেও রাজ্যের অগ্রগতি লক্ষণীয়। লোহা, ইস্পাত, মূল্যবান পাথর বা রত্ন, অলংকার এবং চা এই রাজ্য থেকে যে পরিমাণ রফতানি হয় সেটা জাতীয় রফতানির প্রায় ২.৮৩ শতাংশ। অর্থের অঙ্কে এর পরিমাণ ১৩৯০ কোটি ডলার, টাকার অঙ্কে প্রায় ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। বছরে এক লক্ষ কোটি টাকার রফতানি বাণিজ্যের এই পরিমাণ ২০৩০-এর মধ্যে রাজ্য অতিক্রম করবে। এমনটাই অনুমান করছে বিশ্বব্যাঙ্ক এবং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্টার্স অরগানাইজেশন।
(৮) সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ : প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রেও ছবিটার ঔজ্জ্বল্য কমবেশি একইরকম। ২০২৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে বাংলায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৯৪.২৮ কোটি টাকা। ২০২২-এ এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪২৭.৭৭ কোটি টাকা। ২০২১-এ এর পরিমাণ ছিল ৪১৫.৩৭ কোটি টাকা।
আরও পড়ুন-মৎস্যজীবীদের জন্য সমুদ্রসাথী প্রকল্প
(৯) মজুরির হারে পিছিয়ে গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশ : দেশে সব থেকে কম হারে দৈনিক মজুরি প্রদানকারী রাজ্য হল গুজরাত ও মধ্যপ্রদেশ। নাহ্, বাংলায় মজুরির হার এদের চেয়ে অনেক বেশি।
সুতরাং, ডবল ইঞ্জিন সরকারের মিথ্যের ঝুড়ি অগ্রাহ্য করো।
বুক ফুলিয়ে বলো, এগিয়ে বাংলা।