বিশ্বাসঘাতকদের ক্ষমা নেই

আজ ২৩ জুন। ১৭৫৭-র এই দিন প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের এক নির্মম গতি। সংঘটিত হয়েছিল পলাশির যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের ঐতিহাসিক তাৎপর্য আজও অনস্বীকার্য। মনে করিয়ে দিচ্ছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

মিরজাফরকে সবাই বিশ্বাসঘাতক বলেন। কিন্তু নন্দনকুমার কি বিশ্বাসঘাতকতা করেননি? তাঁকে কেন বিশ্বাসঘাতকের তকমা দিই না আমরা?
নন্দনকুমারের বিশ্বাসঘাতকতার বিবরণ আছে রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রণীত ‘বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা’ নামের বইয়ের ৮ নং পৃষ্ঠায়।

আরও পড়ুন-দুধে-জলে জগন্নাথের স্নানযাত্রা হল মাহেশে

১৭৫৭-তে পলাশি যুদ্ধের আগের কথা। রবার্ট ক্লাইভ ফরাসি অধিকৃত চন্দননগর আক্রমণ করলেন। তখন ব্রিটিশ সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং ফরাসি সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য নবাব সিরাজউদ্দৌলা হুগলির ফৌজদার নন্দন কুমারকে আদেশ দেন। কিন্তু নন্দন কুমার ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তো দূরে থাক, নবাবের অন্য একদল সৈন্যকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বিরত রাখলেন। তিনি যে মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়ে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তা শুধু অনুমান নয়, সমসাময়িক ইংরেজ লেখকরাও এটি স্বীকার করেছেন। সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে এটা মোটেও অসংগত নয় যে, নন্দন কুমার ইংরেজদের বাধা দিলে তারা চন্দননগর দখল করতে পারত না এবং পলাশির যুদ্ধ ও সিরাজউদ্দৌলার পতনও ঘটত না।
পলাশির যুদ্ধ নিয়ে নানাজনের নানা মত। কেউ বলছেন যে, ইংরেজ আর তার দেশীয় শাগরেদদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো সিরাজকে সরানোর জন্যই এ ছিল ইংরেজদের এক চক্রান্ত। ক্রিস্টোফার বেইলির মতো ইতিহাসবিদরা বলেন, দেশীয় অভিজাতদের সমর্থন ছাড়া ষড়যন্ত্র দানাই বাঁধত না। আবার আর এক দল ‘রাজ-বান্ধব’ ইতিহাসবিদদের কথা বলেছেন, যাঁরা মনে করেন ‘গদ্দারি’, ‘বেইমানি’— সবই ছিল এ দেশের দস্তুর। ঔরঙ্গজেবের ভ্রাতৃহত্যা থেকে আলিবর্দি কর্তৃক সরফরাজ হত্যা— সবই তার প্রমাণ। এই ঘরানা অনুযায়ী পলাশি গদ্দারদের মিছিল নয়, ‘মার্সি বিজ়নেস অ্যাজ় ইউজুয়াল’।

আরও পড়ুন-রাজ্য সরকারি কর্মচারী ও আধিকারিকদের ভ্রমণ ভাতা, গাড়িভাড়ায় নয়া নিয়ম রাজ্যের

পলাশি কি কেবল লোভ, মুনাফা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষায় মজে থাকা কিছু মানুষের ছবি? এটা কি এক অপমানিত ব্যাঙ্কার (জগৎ শেঠ), উচ্চাকাঙ্ক্ষী মাসির (ঘসেটি বেগম) বদলা? যুদ্ধ নামক এই হাতাহাতির জয় কি পূর্বাহ্ণেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল? এমন সব প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আজও বাংলার ইতিহাসের আকাশে।
ভারতবর্ষ হোক বা বাংলা, আঠারো শতক তো এক গোলকধাঁধাই। দুটো দল। এক দলের বক্তব্য অনুযায়ী বাংলার ভিতরকার আর্থ-রাজনৈতিক সঙ্কটই অনিবার্যভাবে ব্রিটিশকে এখানে নিয়ে এল। ষড়যন্ত্রের সূচনা ও পরিণতিতে নাকি ক্লাইভ দলের কোনও ভূমিকাই ছিল না। যে কারণে রজতকান্ত রায় বলেছিলেন, পলাশির যুদ্ধের পিছনে ছিল মুর্শিদাবাদের রাজপুরুষদের ষড়যন্ত্র। ১৭৫৬-তে কলকাতা থেকে ব্রিটিশ বণিকরা বিতাড়িত হলে দেশীয় বণিকরা অস্থির হয়ে ওঠেন, যার পরিণতি পলাশি। ক্রিস্টোফার বেলি বা পিটার মার্শালদের বক্তব্যও ছিল এই রকমই।
সম্পূর্ণ ভিন্ন বক্তব্য অন্য গোষ্ঠীর। তাঁরা বলেন, আঠারো শতকের সূচনায় বাংলার নবাবরা ছিলেন স্বাধীন। এখানে তুলনামূলক ভাবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ছিল, বাণিজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এশিয়া ও ইউরোপ থেকেও বণিকরা এসেছিলেন। নবাবের নেতৃত্বে ব্যাঙ্কার, বণিক বা জমিদাররা এক সহযোগিতামূলক অংশীদারি গড়ে তুলেছিলেন। আর এই সমৃদ্ধিই হয়ে দাঁড়ায় তার কাল। এর আকর্ষণেই ইউরোপীয়রা তাঁদের লেখাপত্রে বাংলা জয়ের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলেন বহু আগেই। ব্রিটিশের বাংলা জয় মোটেই আকস্মিক নয়। এই সমৃদ্ধির টানেই তারা রীতিমতো ছক কষে মাঠে নামে।
এসব মতপার্থক্য যতই থাকুক, একটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। পলাশির ময়দানে সেদিন যারা বাংলা বিরোধী বিশ্বাসঘাতকদের ভূমিকা পালন করেছিল, ইতিহাস তাদের কারোকে ক্ষমা করেনি। কেন একথা এত জোর দিয়ে বলছি, দেখে নেওয়া যাক।

আরও পড়ুন-বিদ্যুতের অপচয় রুখতে কড়া মুখ্যমন্ত্রী, দফতরে দফতরে নির্দেশ বকেয়া না মেটালে বাজেটে কোপ

মিরজাফরের পুত্র মিরন ছিল সিরাজ হত্যার মূল নায়ক। সিরাজের মা আমেনার ঘোষিত অভিশাপ অনুযায়ী তাঁবুতে বজ্রপাতে আগুন ধরে গেলে মিরনের মৃত্যু ঘটে। সর্বশেষে প্রাণভিক্ষা না চেয়ে সিরাজ মুহাম্মদি বেগের কাছে দুই রাকাত নামাজ পড়ার আকুতি জানিয়েছিলেন। মুহাম্মদি বেগ সে সুযোগটুকু দিতে পারেনি। নির্মমভাবে নামাজরত সিরাজকে পেছন দিক থেকে তরবারির আঘাতে শহিদ করে। সেই মুহাম্মদি বেগের মৃত্যু হয়েছিল বিকৃতমস্তিষ্ক নিয়ে অন্ধকার কূপে বিনা কারণে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার মাধ্যমে। পলাশির খলনায়ক মিরজাফরের মৃত্যু হয়েছিল প্রাণঘাতী কুষ্ঠরোগে। জগৎশেঠ এবং আমির চাঁদের মৃত্যু হয়েছিল গঙ্গায় ডুবে। ইয়ার লতিফ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ইতিহাস আজও জানে না এই বিশ্বাসঘাতকের ভাগ্যে কী ঘটেছিল। মহারাজ নন্দনকুমার ফাঁসির আসামি হয়ে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। রায়দুর্লভ কারাগারে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েই মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছিলেন। উমিচাঁদ পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন এবং রাস্তায় তাঁর মৃত্যু হয়। রাজবল্লভ উন্মত্তা পদ্মায় ডুবে মরেছিলেন। ওয়াটসন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অল্পবয়সে মারা যান। স্ক্রাফটনের মৃত্যু হয় কলকাতা থেকে বিলাত ফেরার সময় জাহাজডুবিতে। পলাশির যুদ্ধের অন্যতম খলনায়ক ক্লাইভ ভারতবর্ষ থেকে বিলাতে ফিরে যাওয়ার পর সে-দেশের সংসদে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের অপমান সইতে না পেরে বাথরুমে ঢুকে ক্ষুর দিয়ে নিজের গলা নিজে কেটে আত্মহত্যা করেছিলেন।

আরও পড়ুন-প্রচারে শোনা সমস্যার সমাধান হবে আগে : সায়নী

আরও একটা কথা মনে রাখার এবং মনে করিয়ে দেওয়ার। জনগণের সক্রিয় সচেতনতা ছাড়া জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় অস্মিতা, জাতির গৌরব কখনও রক্ষিত হতে পারে না।
নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যখন মুর্শিদাবাদে লাঞ্ছিত করা হচ্ছিল, তখন জনগণ বোঝার চেষ্টা করেনি নবাবের শেষ পরিণতি কী হতে যাচ্ছে। ক্লাইভ যখন বাংলার ধনসম্পদ ও মুর্শিদাবাদের কোষাগার খালি করে নৌবহরে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন নদীর দু-পাড়ে জনতা তামাশা দেখেছে। বুঝতে পারেনি কী হতে চলেছে। ইউরোপীয় লেখক নোভাক মন্তব্য করেছেন, যে পরিমাণ দর্শক নৌবহরের দৃশ্য অবলোকন করেছে, তারা যদি বুঝত তাদের সম্পদ লোপাট হচ্ছে, দেশ আগ্রাসনের শিকার এবং এর প্রতিক্রিয়ায় তারা যদি একটি করে ঢিলও ছুঁড়ত তাহলে ইংরেজদের সব স্বপ্নের সলিলসমাধি সেখানেই হয়ে যেত।
এই কথাগুলো আজকেও ভুলে গেলে চলবে না। বাংলা-বিরোধী বিজেপিকে প্রতিহত করতে আগামী উপনির্বাচনেও আমাদের যেন ভুল না হয়।
সেটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

Latest article