পদার্থবিদ্যার এক আধুনিকতম তত্ত্ব হল কোয়ান্টাম গতিবিদ্যা (Quantum dynamics)। বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকে যার সূত্রপাত আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, ম্যাক্স বর্ন, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, আরউইন শ্রোয়েডিঙ্গার-এর মতো একঝাঁক বিজ্ঞানীর হাত ধরে। বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে অনেক ধারণাকে বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা, এই কোয়ান্টাম তত্ত্বের বেশ কিছু অংশ নির্মাণের সময়। ‘কোয়ান্টাম কম্পিউটিং’ বা ‘কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি’-র মতো বেশ কিছু শব্দ-বন্ধ যার মূলে রয়েছে ওই কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার কিছু আজব নিয়মগুলোই। বলা হচ্ছে, আগামী পৃথিবীতে কোয়ান্টাম তত্ত্বের আরও আশ্চর্য সব প্রয়োগ বাস্তবে ঘটতে দেখব আমরা।
কোয়ান্টাম (Quantum dynamics) তত্ত্বের বিভিন্ন দিকে যুগান্তকারী কাজের জন্য এর আগে একাধিকবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বহু বিজ্ঞানী। উপরিউক্ত প্রায় সকলেই একশো বছরের বেশি সময়কালে পেয়েছেন এই পুরস্কার। এবারের নোবেলেও রয়েছে সেই ধারাবাহিকতার নবতম প্রতিফলন। আমেরিকার জন ক্লজার (বয়স ঊনআশি), ফ্রান্সের অ্যালেন অ্যাসপেক্ট (পঁচাত্তর) আর অস্ট্রিয়ার আন্তন জেইলিঙ্গার (সাতাত্তর)— ২০২২ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাপক হিসেবে এই তিন প্রবীণ অধ্যাপকের নাম ঘোষিত হয়েছে কয়েকদিন আগেই।
কেন পেলেন নোবেল
কোয়ান্টাম তত্ত্বের এক বিশেষ ঘটনা ‘কোয়ান্টাম গাঁটছড়া’র (‘কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট’-কে বাংলা করলে এটাই বলা উচিত বলে মনে করি আমরা) অস্তিত্ব বাস্তবে প্রমাণ করবার জন্য তাঁদের নাম এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছিল। তাঁদেরকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ‘এনট্যাঙ্গলড ফোটন কণা নিয়ে পরীক্ষা করে ‘বেল অসমতা’কে ভ্রান্ত প্রমাণের জন্য এবং কোয়ান্টাম তথ্য-বিজ্ঞানের জগতে নতুন এক দিশা দেখানোর জন্য’।
কোয়ান্টাম গাঁটছড়া কী
ধরা যাক, আমি আর আমার এক বন্ধু, একজন লাল এবং অপরজন কালো জামা পরে অন্ধকার ঘরে রয়েছি। ফলে কে কোন রঙের জামা পরে আছি, আমরা নিজেরা দেখতে পাচ্ছি না। এবার ঘরে যদি হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠে, তাহলে ওই মুহূর্তেই আমি দেখতে পেয়ে যাব আমার জামার রং। আর ঠিক ওই মুহূর্তেই দূরে বসে থাকা আমার বন্ধুর জামার রং কী, সেটাও জেনে যাব তাকে জিজ্ঞেস না করেই। সহজ কথায় বলতে গেলে আমি আর আমার বন্ধু যেন ছিলাম এক বিশেষ গাঁটছড়ার বন্ধনে। যে মুহূর্তে আমার একটা বিষয় কোনওভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ল, ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ ওই পার্টনারের বিষয়টিও হয়ে গেল প্রকাশিত। এটাকেই কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের একটা উদাহরণ হিসেবে আপাতত ভাবা যেতে পারে।
আরও পড়ুন-ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল পুরস্কার পেলেন উত্তরবঙ্গের চার নার্স
কোয়ান্টামের অনির্দিষ্টতাই আকর্ষণ
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মধ্যে রয়েছে এরকম আরও অনেক অনিশ্চয়তা। যেমন ধরা যাক শ্রোয়েডিঙ্গারের সেই বেড়ালটার কথা। সে বেচারা বসে আছে একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে, আর ওই ঘরটাতেই রয়েছে একটা বিস্ফোরক-ভরা কাচের পাত্র। যদি ওই পাত্র ফেটে যায়, বেড়ালটার সেই মুহূর্তে মৃত্যু হবে। কিন্তু আমরা বাইরে থেকে যতক্ষণ না ভেতরের ওই বিস্ফোরক ফেটে গিয়েছে কি না দেখতে পাব, ততক্ষণ আমাদের কাছে বেড়ালটা থাকবে জীবিত অথবা মৃত এই দুইয়ের কোনও একটা অবস্থায়। যে মুহূর্তে দরজা ভেঙে দেখব, সেই মুহূর্তে বেড়ালটার অবস্থা একটা যে কোনও দিকে স্থিত হবে— হয় জীবিত নয় মৃত। এই যে এক মুহূর্তে ওর অবস্থা অনির্দিষ্ট থেকে নির্দিষ্ট হয়ে যাওয়া, এটাই কোয়ান্টাম গতিবিদ্যার মধ্যে কোনও-কোনও বস্তুকণার কোয়ান্টাম দশা বোঝাতে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়। কোয়ান্টাম জগতে এরকম অনির্দিষ্টতা দেখতে পাওয়া যায় হামেশাই। স্বয়ং আইনস্টাইনও ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’ — তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন সেই অনির্দিষ্টতার সেই আকর্ষণকে। শ্রোয়েডিঙ্গারের নির্মিত একটু আগে বলা ওই বিখ্যাত চিন্তন-পরীক্ষাটির (ইংরেজিতে থট এক্সপেরিমেন্ট, যে পরীক্ষা বাস্তবে করা হয় না, তবে কল্পনায় ঘটিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়) বিপরীতে যে কারণে আইনস্টাইন আর দু’জন গবেষক নাথান রোজেন আর বরিস পোডোলস্কি মিলে ১৯৩৫ সালে প্রকাশ করেছিলেন এক পেপার; যাতে তাঁরা লেখেন যে এইরকম কোনও ঘটনার মধ্যে আসলে লুকিয়ে থাকে সুপ্ত আর এক বিষয় (ইংরেজিতে হিডেন ভেরিয়েবল, এমন কোনও বিষয় যা কোনও ঘটনার মধ্যে লুকিয়ে থেকে ঘটনার গতিপথকে প্রভাবিত করে), এটাকেই খুঁজে বের করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু অনেক কাল অবধি তার খোঁজ মেলেনি।
আইনস্টাইন যে ঘটনাকে বলেছিলেন ‘স্পুকি অ্যাকশন অ্যাট এ ডিসট্যান্স’, এনট্যাঙ্গলমেন্ট-ঘটিত সেই তত্ত্ব বাস্তবে সত্যি কি না, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরেই। সেই ১৯৬৪ সালে আইরিশ বিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট বেল এক গাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যা দিয়ে কোয়ান্টাম জগতের এই অনির্দিষ্টতাকে আইনস্টাইনের ওই তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এটাই ‘বেল ইনইকোয়ালিটি’ নামে পরিচিতি পায়। পরে অ্যালান অ্যাসপেক্ট আর জন ক্লজার মিলে তাঁর এই গাণিতিক পদ্ধতিকে ভুল প্রমাণিত করেন। তাঁদের ওই কাজেরই স্বীকৃতি হল নোবেল।
কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন
অন্যদিকে আন্তন জেইলিঙ্গারের কাজের বিষয় হচ্ছে ‘কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন’। এখন টেলিপোর্ট করা মানে কোনও কিছুকে খুব সহজে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়া (ধরা যাক, আমি বসে আছি কলকাতায়, আমাকে টেলিপোর্ট করে এক লহমায় পাঠিয়ে দেওয়া হল চাঁদে), সুতরাং অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন যে তাঁর এই আবিষ্কার আগামী দিনে মানুষকে টেলিপোর্ট করে পাঠিয়ে দিতে পারবে অনেক দূরের কোথাও। বিষয়টা আসলে মোটেই তেমন ঘটবে না ভবিষ্যতে।
জেইলিঙ্গারের কাজের মূল বিষয় হল কোনও একটা কণার কোয়ান্টাম দশার খবরকে অতি দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তাঁর গবেষণাগারে রাখা এরকম একটা এনট্যাঙ্গলড ফোটন (ফোটন হল আলোর কণা, যার ভর বা চার্জ নেই কিন্তু ভরবেগ আর শক্তি রয়েছে) আর মহাকাশে রাখা একটা যন্ত্রের মধ্যে রাখা ফোটনের মধ্যে দেখা গিয়েছে কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশন ঘটছে এক লহমায়। দুটোর বেশি কণাকে নিয়ে পরীক্ষা করেও তিনি আর তাঁর সহযোগীরা মিলে দেখিয়েছেন যে ওদের মধ্যে কোয়ান্টাম গাঁটছড়া বাঁধা সম্ভব। কোয়ান্টাম (Quantum dynamics) তত্ত্বের অন্দরে এমন বহু রহস্যময় ঘটনা আর সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে, ভবিষ্যতে সেরকম আরও দেখতে পারব এ আশা করাই যায়।