মোদিনোমিক্স (মোদি+ইকোনমিক্স)-এর কথা বহুবার শুনেছি। কিন্তু থালিনোমিক্স (থালি+ইকোনমিক্স)-এ গরমিলটা কিছুতেই ঠাহর করতে পারছি না।
গ্যাসের দাম কমিয়ে মোদিবাবু ও তাঁর সাঙাতরা ভোটের বাজারে ফয়দা তুলতে নেমে পড়েছেন। কিন্তু সোনিক্কা লোগানাথান ও ভিগনেশ রাধাকৃষ্ণনের একটি সমীক্ষার কলাকল দেখলে চক্ষুচড়কগাছ হওয়ার উপক্রম। এই দুই গবেষক হিসাব কষে দেখিয়েছেন মোদি জমানায় বিগত পাঁচ বছরে থালি (ভাত, ডাল, সবজি ইত্যাদি সমন্বিত খাবারের থালা)-র দাম বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। পক্ষান্তরে ওই একই কালপর্বে, অর্থাৎ পাঁচ বছরে, মহারাষ্ট্রের শহরাঞ্চলে একজন অস্থায়ী শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি হয়েছে মোটে ৩৭ শতাংশ। আর মাসিক মাইনে উপার্জন করেন এরকম ব্যক্তির মাহিনা বৃদ্ধির হার আরও কম, ২৮ শতাংশ।
উপভোক্তা বিষয়ক দফতর, ন্যাশনাল হর্টিকালচার বোর্ড, পিরিয়ডিক লেবার কোর্স সার্ভে এবং মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকারের জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষকদ্বয় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। মহারাষ্ট্রের অবস্থা কেবল মহারাষ্ট্রেই সীমায়িত, এমনটা নয়। কমবেশি এটাই সর্বভারতীয় চিত্র। মোদিবাবুর বিগত পাঁচ বছরের শাসনকালে খাবারের দাম যে হারে বেড়েছে মজুরি বা মাইনে তার অর্ধেকও বাড়েনি। এমতাবস্থায় গ্যাস (Coocking Gas Price) সিলিন্ডারের দাম ২০০ টাকা কমিয়ে বাজার গরম করার চেষ্টা নেহাতই হাস্যকর।
গড়ে প্রতিটি ভারতীয় পরিবারে প্রাতরাশ, মধ্যহ্নভোজ ও নৈশাহারে যা খাওয়া হয় সেটা দুটো নিরামিষ থালির সমান। সাধারণত নিরামিষ থালিতে (মহারাষ্ট্রে, বিশেষত মুম্বইয়ে) যা যা লাগে, সেই পদগুলো হল সাদাভাত, অড়হর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচালঙ্কা, আদা, টম্যাটো, আলু, কড়াইশুঁটি, আটা, বাঁধাকপি বা ফুলকপি, সূর্যমুখী তেল এবং নুন। ২০২৩-এর ৮ অগাস্টের হিসাব অনুযায়ী, এরকম একটা থালি তৈরি করতে খরচ হয় ৫৬ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাৎ একটি পরিবারে সারাদিনে এরকম উপকরণে তৈরি থালি খাওয়ার খরচ হল ১১২ টাকা ৬০ পয়সা। সারা মাসে তাহলে পরিবারপিছু খাওয়ার খরচ বা স্পষ্টতরভাবে বললে এরকম থালিবাবদ ব্যয়, ৩,৩৭৮ টাকা ৫০ পয়সা। এক বছর আগেও অর্থাৎ অগাস্ট ২০২২-এ খরচের পরিমাণ ছিল ২,৪৬০ টাকার সামান্য বেশি। তিন বছর আগে এই বাবদ ব্যয় ছিল প্রায় ২৪৪১ টাকা। আর পাঁচ বছর আগেও এরকম খাবার খাওয়ার জন্য ২,০৩৭ টাকা ২০ পয়সার বেশি খরচ হত না।
কেন খরচ এত বেড়ে গেল সেটা বুঝতে হলে মূল্যবৃদ্ধির হার মনোযোগ দিয়ে দেখতে হবে। দুটি থালির জন্য ভাত ও ডাল লাগে গড়ে ১২৫ গ্রাম করে। যে চালের দাম পাঁচ বছর আগে ছিল ৩২ টাকা এখন তা বাড়তে বাড়তে কেজিপিছু ৪৩ টাকা। যে অড়হর ডালের দাম পাঁচ বছর আগে ছিল কেজিপিছু ১০৫ টাকা, তিন বছর আগেও যেটা পাওয়া যেত ১১৮ টাকায়। এখন সেই অড়হর ডালের কেজিপিছু দাম বেড়ে হয়েছে ১৬৯ টাকা। ফলে ১২৫ গ্রাম চাল কিনতে পাঁচ বছর আগে খরচ হত ৪ টাকা, এখন সমপরিমাণ চাল কিনতে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ টাকা। ১২৫ গ্রাম অড়হর ডাল কিনতে এক বছর আগেও লাগত ১৪ টাকা ৮০ পয়সা (পাঁচ বছর আগে লাগত ১৩ টাকা), সমপরিমাণ একই ডাল কিনতে এখন ব্যয় হচ্ছে ২১ টাকা। পেঁয়াজ, আলু, আদা, রসুন, আটা, লঙ্কা— সবার ক্ষেত্রেই এই সত্য প্রযোজ্য।
উল্টোদিকে মহারাষ্ট্রে বিগত পাঁচ বছরে অস্থায়ী কর্মীদের দৈনিক মজুরি ৩০১ টাকা থেকে ৪১৪ টাকা হয়েছে। স্থায়ী কর্মীদের মাসিক বেতন পাঁচ বছর আগে ছিল গড়ে ২০,৫২১ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৬,৩৩৫ টাকা।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, যাঁরা দিনমজুর তাঁদের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর আগে অর্জিত দৈনিক মজুরির ২২.৫ শতাংশ ব্যয়িত হত প্রতি মাসে। এখন সেই অঙ্কটা বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.২ শতাংশ হয়েছে। অনুরূপভাবে যাঁরা দিনমজুর নন, মাস মাইনে পাওয়া কর্মচারী তাঁদের মাসিক বেতনের ৯.৯ শতাংশ চলে যেত দিনে দুটো থালির সমান খাবার খেতে। এখন তাঁদের মাসিক বেতনের ১২.৮ শতাংশ চলে যাচ্ছে স্রেফ খাওয়া খাতে।
এখানে দুটো কথা বলা প্রয়োজন।
এক, উল্লিখিত গবেষকদ্বয় জানিয়েছেন, মহারাষ্ট্র থেকে তথ্য সংগ্রহের সুবিধার জন্যই তাঁরা গবেষণা ক্ষেত্র হিসেবে মহারাষ্ট্রকে নির্বাচন করেছেন।
দুই, যদি কোনও পরিবার থালি প্রস্তুতির উপকরণের জন্য আরও ভাল কিছু কেনে, যেমন সূর্যমুখী তেলের বদলে ঘি ব্যবহার করে, তবে তাদের খাওয়াবাবদ ব্যয় আরও বাড়বে এবং বাস্তবে সেটাই হয়ে থাকে। মোদিবাবু ২০০ টাকা গ্যাসের (Coocking Gas Price) দাম কমিয়ে এই সমস্যা থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবেন না। সেটা উনি নিজেও জানেন। শুধু ভোটের মুখে আত্মপ্রচারের ঢাক আরও বেশি জোরে বাজানোর জন্য তিনি ও তাঁর গেরুয়া পার্টি গ্যাসের দাম কমানো নিয়ে এত প্রচারের আয়োজন করেছে।
আর একটা কথা।
গত মাসেই জোহানেসবার্গে ব্রিকস-এর বিজনেজ ফোরামের নেতৃবর্গের আলোচনা মঞ্চে মোদিজি গলা ফাটিয়ে বলেছিলেন, শীঘ্রই ভারত ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের (অর্থাৎ ৪১,৩৬,০২,৫০,০০,০০,০০০ টাকার) অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এই ঘোষণা নতুন কিছু নয়। ২০১৮-তে কেন্দ্রীয় শিল্প বাণিজ্য মন্ত্রকের তরফেও এরকম একটা ঘোষণা শোনা গিয়েছিল। তখন ২০২৫-কে লক্ষ্যবর্ষ ধার্য করা হয়েছিল। এই আবহে মোদিজি এবারের স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে ভাষণদানকালে বলে বসলেন, ২০১৪-তে বিশ্বঅর্থনীতিতে ভারতের স্থান ছিল দশমে। বর্তমানে নাকি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হল ভারতের। আর উনি যদি তৃতীয়বারের জন্য গদি দখল করতে পারেন, তাহলে নাকি ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির গরিমা অর্জন করবে। এসব গালভরা কথা আর আলটপকা বলা মিথ্যে শুনতে মন্দ লাগে না। কিন্তু গোল বাধে তখনই যখন বাস্তবের তথ্য- পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই।
তখন দেখি, ভারতের মাথা পিছু আয় এবং মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
তখন বুঝতে পারি, ভারতের জনসংখ্যার যা পরিমাণ, সেই পরিমাণ জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্বঅর্থনীতিতে এক নম্বর না-হতে পারলে অধিকাংশ ভারতবাসীর জীবনযাপনের মানোন্নয়ন সম্ভবপর হবে না। ২০২১-এ প্রায় সমসংখ্যক অধিবাসী নিয়ে চিনের মাথাপিছু আয় ছিল ১৭,৫০৪ ডলার (পিপিপি বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি অনুসারে)। ভারতের তখন মাথাপিছু আয় ওই পিপিপি-র মাপকাঠিতে ৬,৫৯০ ডলার। মাথাপিছু আয়ের নিরিখে চিন বা আমেরিকাকে ছুঁতে গেলে শুধু মোদিবুলিতে কাজ হবে না। অভ্যন্তরীণ সম্পদের উৎপাদনশীলতা অনেক, অনেক বেশি হারে বাড়াতে হবে। বাস্তব বিনিয়োগ ও মানবসম্পদ বিনিয়োগের হারেও একটা বৃহৎ উল্লম্ফন দরকার।
সে-সব কোথায় কী!
মোদিজি স্বপ্নের ফানুস ফেরি করে বেড়াচ্ছেন।
আরও পড়ুন: দুয়ারে সরকারে প্রবীণরাও বার্ধক্যভাতার আবেদন করতে পারবেন