আমরা নিয়মিত যা আহার করি, বিভিন্ন কারণে সেটা সুষম আহার হয়ে ওঠে না। মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা আরও বেশি। তার বেশ কিছু কারণ আছে। মেন্সট্রুয়েশনের ফ্লো বেশি হওয়া, শরীরে মেদ জমা নিয়ে অনাবশ্যক আতঙ্ক, ওজন বাড়ার ভয়ে প্রয়োজনের বেশি ডায়েটিং, ছেলেমেয়েদের খেয়াল রাখা, পরিবারের দায়িত্ব সামলে আবার নিজের প্রফেশনাল লাইফ বজায় রাখতে গিয়ে সুষম আহারের সময় না পাওয়া, শারীরিক গঠনগত কিছু সমস্যা, মেনোপজ-পরবর্তী বেশ কিছু হরমোন এবং মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট জনিত সমস্যা, গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত পুষ্টির জোগানের অভাব, সন্তানকে ব্রেস্টফিডিং পিরিয়ডে সঠিক পুষ্টির অভাব ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোহলির অনিশ্চয়তা
সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, পুষ্টিগত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন মেয়েরা এবং মায়েরা। এখানে সেইরকম কিছু সমস্যা এবং তার সমাধান আলোচিত হল—
আয়োডিনের অভাব
২০ থেকে ৩৯ বছর বয়সি মেয়েদের প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে আয়োডিনের মাত্রা স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে কম। অর্থাৎ এই বয়সের মেয়েরা সচরাচর আয়োডিনের অভাবে ভোগেন। দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন আমাদের শরীরের প্রয়োজন থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য। এই হরমোন আমাদের দেহের পরিপাক প্রক্রিয়া থেকে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, গর্ভবতী মায়ের ভ্রূণের বৃদ্ধি বিকাশ থেকে স্তনের দুধ— এসবের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এর অভাবে শারীরিক দুর্বলতা, শীত-শীত ভাব, কাজে অনীহা, স্থূলতা, গলগণ্ড, গর্ভস্থ ভ্রূণের বিকাশগত সমস্যা দেখা দেয়।
আরও পড়ুন-শ্যামা
বর্তমানে নুনের সঙ্গে আয়োডিন মেশানো হচ্ছে এর অভাব রোধ করতে। কিন্তু, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস আছে যেসব মেয়ের, গর্ভবতী মায়েরা, নুন খায় কম। অনেক মেয়েই নুন বেশি খায় না শরীর ফুলে যাবে ভয়ে। তাই আয়োডিনের অভাব হয়ে যায়।
ডিম, পাউরুটি, ইয়োগার্ট, সামুদ্রিক মাছ, দানাশস্য, মাঠা তোলা দুধে যথেষ্ট পরিমাণ আয়োডিন থাকে। তাই মেয়েদের মেন্সট্রুয়াল এজে (মানে ১৫–৪৫) বছরের মধ্যের সময়ে খাদ্যাভ্যাসে উপরোক্ত উপাদানগুলো থাকা জরুরি।
আরও পড়ুন-যুদ্ধবিমানের জেট ইঞ্জিন বানাতে চায় ভারত-আমেরিকা
ভিটামিন ডি’র অভাব
হাড়ে ক্যালসিয়ামের সঠিক মাত্রা বজায় রাখা, মাংসপেশির সঠিক কর্মক্ষমতা বজায় রাখা এবং দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখা, এগুলো ভিটামিন ডি’র কাজ। গর্ভবতী ও নার্সিং মায়েদের ক্ষেত্রে তো ভিটামিন ডি-র চাহিদা আরও বেড়ে যায় ভ্রূণ বা সদ্যোজাত শিশুর হাড়ের বিকাশের জন্য।
এর অভাবে প্রধানত মেয়েরা সামান্য পরিশ্রমেই ক্লান্তি বোধ করা, দুর্বলতা, সমগ্র শরীরে ব্যথা, অবসাদ এই ধরনের সমস্যায় ভোগে। ডায়াবেটিস এবং পলিসিস্টিক ওভারির সমস্যায় ভোগা মেয়েদের ভিটামিন ডি-র অভাব দেখা যায় খুব বেশি।
মেয়েদের ৬০০ থেকে ৮০০ ইউনিট ভিটামিন ডি দৈনিক প্রয়োজন। প্রধান উৎস হল সূর্যরশ্মি। দৈনিক আধ ঘণ্টা অনন্ত সূর্যের আলোর ছোঁয়া পেলে ভিটামিন ডি-র অভাব হওয়ার কথা নয়। সঙ্গে সামুদ্রিক মাছ, কমলালেবুর রস, ডিমের কুসুম, কড মাছের লিভার, সার্ডিন, স্যালমন, ইওগার্ট ইত্যাদিতেও থাকে ভিটামিন ডি।
আরও পড়ুন-ডার্বির টিকিটের চাহিদা তুঙ্গে, বণ্টনে অব্যবস্থাও
ক্যালসিয়ামের অভাব
দৈনিক ১০০০ মিলিগ্রামের কাছাকাছি ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় এবং নার্সিং মায়েদের ক্যালসিয়ামের চাহিদা আরও বেড়ে যায়। মেয়েদের শরীরে ক্যালসিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ইস্ট্রোজেন, প্যারা থাইরয়েড, ক্যালসিটোনিন, এবং ভিটামিন ডি। মেনোপজের পরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের অভাবে মেয়েদের শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা যায়। যার ফলাফল স্বরূপ, অস্টিওপোরোসিস, অস্টিওপিনিয়ার মতো হাড়ের ক্ষয়জনিত দেখা দেয়। এ ছাড়াও, গা-হাত-পায়ে ব্যথা, মাংসপেশির দুর্বলতা, ক্লান্তি, মাসল ক্র্যাম্প এগুলো দেখা দেয়। হালকা আঘাতেই ভেঙে যায়, কোমর, মণিবন্ধ বা শিরদাঁড়ায় হাড়। অর্থাৎ এই সময়ে ফিমার নেক, কোলেস এবং ভার্টিব্রা ফ্র্যাকচার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
ফাইটো ইস্ট্রোজেন থাকে বেশ কিছু বৃক্ষজাত দ্রব্যে, যা মেনোপজ-পরবর্তী সময়ে ইস্ট্রোজেনের অভাব দূর করে। ফলে, হাড়ের ক্যালসিয়ামের অভাব, মেনোপজজনিত শারীরিক অসুবিধা যেমন, অস্বাভাবিক গরম লাগা, সামান্য কারণে রেগে যাওয়া, অবসাদ, যোনিপথে জ্বালা বোধ হওয়া, এগুলো থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকা যায়।
আরও পড়ুন-ভারত সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা কমছে, রিপোর্ট
ফক্স-সিড একধরনের বীজ যাতে প্রচুর পরিমাণে ‘লিগনান’ থাকে। এটি ফাইটো ইস্ট্রোজেনের প্রধান উৎস। এটি নিয়মিত গ্রহণে উপরোক্ত সমস্যাগুলো যেমন কমে, সঙ্গে স্তনের ক্যানসারের সম্ভাবনাও হ্রাস পায় অনেকাংশে।
সয়াবিনে থাকে ‘আইসোফ্ল্যাভোন’, যা ফাইটো ইস্ট্রোজেনের কাজ করে। হাড়ের ক্যালসিয়ামের মাত্রা বজায় রাখা, হট ফ্লাশ কমানো এবং ব্রেস্ট ক্যানসার রিস্ক কম করা সয়াবিনের ভাল গুণ। এ ছাড়াও এতে প্রচুর প্রোটিন এবং ভিটামিনস থাকে।
খেজুর, আলুবখরা, এপ্রিকটে যথেষ্ট পরিমাণ ফাইটো ইস্ট্রোজেন থাকে। তাই এগুলো পরিমাণমতো খেলে মেনোপজের পরে বেশ উপকার হতে পারে।
তিল যদি নিয়মিত পঞ্চাশ গ্রামের মতো খাওয়া যায়, এটি ওজন হ্রাসে, ফাইটো ইস্ট্রোজেনের অভাব মিটিয়ে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে উপকার করতে পারে।
এছাড়াও নিয়মিত দু’কোয়া রসুন বা জাম জাতীয় ফল সেবন শরীরের পক্ষে বেশ উপকারী। নিয়মিত দুগ্ধজাত খাবার, ইয়োগার্ট, চিজ এগুলো খেলে ক্যালসিয়ামের জোগান ঠিক থাকে।
আরও পড়ুন-ফাইনালে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে বিদেশিরাই
আয়রনের অভাব
মেয়েদের মধ্যে আয়রনের অভাব খুব সহজেই দেখা যায়। এর কারণ, প্রত্যেক মাসে মেন্সট্রুয়েশনের সময়ে রক্তপাত, গর্ভাবস্থায় আয়রনের চাহিদা বৃদ্ধি এবং নার্সিং মায়েদের অতিরিক্ত আয়রনের চাহিদা ঠিকমতো না মেটা।
গর্ভাবস্থায় সকালবেলার বমিভাব আয়রনের প্রভাবে আরও বেড়ে যায় বলেই অনেক মা আয়রন সাপ্লিমেন্ট খেতে চান না। এছাড়াও অনেকের আয়রন খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। ফলে তাঁরা আয়রন খেতে চান না।
আয়রনের অভাবে অ্যানিমিয়া, ক্লান্তি, অবসাদ, শরীর ঝিমঝিম-করা, পা এবং শরীর ফুলে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া, হৃদ্স্পন্দন বেড়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
আরও পড়ুন-ধ্বংসের মুখোমুখি আমাদের সংবিধান
শিম, শিমের বীজ, সবুজ শাকপাতা, খেজুর, খেজুরগুড়, কুলেখাড়া পাতার রস, দানাশস্য ইত্যাদিতে প্রচুর আয়রন থাকে। তবে অন্ত্র থেকে আয়রন শোষণের জন্য ভিটামিন সি অর্থাৎ টক ফল খাওয়া প্রয়োজন। নাহলে আয়রন রক্তে আসে না।
তবে যেসব খাবার রক্তের ক্যালসিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি করে তাদের আয়রন বাড়ানোর খাবারের সঙ্গে একসঙ্গে খেলে অন্ত্র থেকে আয়রনের শোষণ কমে যায়।
আরও পড়ুন-আচার্যই উপাচার্য! চালভাজাই মুড়ি? আইনিপথে ক্ষুব্ধ শিক্ষামন্ত্রী
ভিটামিন বি-১২ এবং ফোলিক অ্যাসিডের অভাব
আমাদের লোহিত রক্তকণিকা তৈরিতে এই দুই ভিটামিনের ভূমিকা অপরিহার্য। এদের অভাবে যে অ্যানিমিয়া দেখা যায় তাকে মেগালোব্ল্যাস্টিক বা ম্যাক্রোসাইটিক বা পার্নিসিয়াস অ্যানিমিয়া বলে। এ ছাড়াও স্নায়ুতন্ত্রের গঠনেও বি-১২-এর ভূমিকা রয়েছে। ভ্রূণের স্নায়ুটিউব বা নিউরাল টিউব তৈরিতে ফোলিক অ্যাসিড অপরিহার্য। সাধারণত একটু বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে এই ভিটামিন দুটির অভাব দেখা যায়। তাছাড়া, গর্ভাবস্থায় এই দুই ভিটামিন অতি-আবশ্যক। এদের অভাবে ভ্রূণের স্নায়ুতন্ত্রের গঠন অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে। তাকে বলা হয় নিউরাল টিউব ডিফেক্ট। নবজাতকের শরীরে ‘স্পাইনা বাইফিডা’, ‘মেনিনগোসিল’, ‘এনকেফালোসিল’, ‘মেনিনগো-এনকেফালোসিল’ এইগুলো হতে পারে ফোলিক অ্যাসিডের অভাবে।
আরও পড়ুন-উত্তরাখণ্ড-হিমাচলের পর বন্যায় বিধ্বস্ত উত্তরপ্রদেশ, বিপর্যস্ত ২লক্ষ মানুষ
তাই আয়রন, ফোলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি-১২ গর্ভবতী মায়েদের জন্য অপরিহার্য।
ফোলিক অ্যসিড সবুজ শাক-সবজি থেকে পাওয়া গেলেও, বি-১২ শুধু প্রাণিজ খাবার থেকেই পাওয়া যায়। যেমন, দুগ্ধজাত খাবার, সামুদ্রিক মাছ, চিজ, বার্গার, বান ইত্যাদি। যাঁরা সম্পূর্ণ নিরামিষ আহার করেন, তাদের বি-১২-এর অভাব দেখা দিতে পারে।
অনেক মহিলার পাকস্থলীতে ইন্ট্রিনসিক ফ্যাক্টর নামে একটি পদার্থের অভাব দেখা যায়, যেটা বি-১২ শোষণে অপরিহার্য। ফলে ওই ভিটামিনের অভাব তৈরি হয়। এদের ভিটামিন বি-১২ ইঞ্জেকশন দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে।