সুখদুঃখের সঙ্গী
নতুন বইয়ের গন্ধ অতুলনীয়। মন মাতাল করে দেয়। ছোটবেলায় স্কুলে নতুন বই পেলে খুশি চেপে রাখা যেত না। উপহার পেলেও তাই। বাড়িতে ছিল ‘সঞ্চয়িতা’। বাবার কেনা। দিয়েছিলেন ‘বীরপুরুষ’ মুখস্থ করতে। পঁচিশে বৈশাখের আগে। বিশ্বভারতীর প্রকাশনা। কিছুটা পুরনো। পড়ার আগে প্রাণভরে নিয়েছিলাম পাতার গন্ধ। ‘আবোল তাবোল’ হাতে পাওয়ার পরেও ঘটেছিল একই ঘটনা।
গন্ধের পাশাপাশি আনন্দ লুকিয়ে থাকে স্পর্শেও। নতুন বইয়ের শরীর ছুঁয়ে দেখার মজাই আলাদা। পাতা ওল্টাতেও কিন্তু দারুণ লাগে। রোমাঞ্চ হয়।
আরও পড়ুন-কালিয়াগঞ্জে হামলা ও অশান্তি বিজেপির
বইমেলায় বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে কেনা হয় পছন্দের বই। সেইসঙ্গে থাকে আরও কিছু বই ছুঁয়ে দেখা এবং গন্ধ নেওয়ার সুযোগ। বই কখনও সুখের সঙ্গী। কখনও দুঃখের। অবসরেরও। লম্বা সফর। বই থাকে অনেকের হাতে। বাইরে হয়তো তুমুল বৃষ্টি। ঘরের ভিতর বইয়ের পাতায় চোখ। অক্ষর সরণি বেয়ে কেটে যায় বিনিদ্র রাত। বই কাঁদায়, হাসায় এবং ভালবাসায়।
আরও পড়ুন-ইদের দিনেই মুসলিমদের হাতে দুর্গা প্রতিমার বায়না!
অতীত এবং বর্তমান
মাঝেমধ্যে হা-হুতাশ শোনা যায়, বই পড়ার অভ্যাস নাকি ইদানীং কমে গেছে। প্রশ্ন জাগে, সেটা হলে কি বছর বছর এত নতুন বই ছাপা হত? পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর বিক্রি বাড়ছে বইমেলায়। অতীতের তুলনায় বর্তমান সময়ে বেড়েছে কেনার এবং পড়ার অভ্যাস।
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় নববর্ষ বই উৎসবে বললেন, ‘মানুষ বই পড়ে। প্রচুর বই পড়ে। আগে বরং পড়ত না। ছোটবেলায় দেখেছি বাড়িতে বই থাকত না। এখনকার মানুষ সেই তুলনায় অনেক বেশি বই পড়ে।’
আরও পড়ুন-রিজওয়ানুরের বাড়িতে মুখ্যমন্ত্রী, সঙ্গে ছিলেন অভিষেক-বাবুল
কঠিন চ্যালেঞ্জ
গত কয়েক বছরে মুদ্রিত বই বা প্রিন্টেড বুকের দিকে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে ই-বুক। লকডাউনের সময় থেকে কিছুটা হলেও বেড়েছে ডিজিটাল বইয়ের চাহিদা। বিশেষত নতুন প্রজন্মের মধ্যে। তাঁদের বক্তব্য, ই-বুকের দাম তুলনায় কম। ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, আইপ্যাড বা ই-রিডার ডিভাইসে হাজার হাজার ই-বুক রাখা যায়। মুদ্রিত বই সাজিয়ে রাখার জন্য লাইব্রেরি প্রয়োজন। ই-বুকের জন্য ওসবের বালাই নেই। তা ছাড়া ই-বুক আসায় কিছুটা হলেও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে গাছ। কারণ মুদ্রিত বইয়ের জন্য লাগে কাগজ। কাগজ তৈরি হয় গাছ কেটে।
আরও পড়ুন-ভিডিও বার্তায় অক্ষয় তৃতীয়া ও ইদের শুভেচ্ছা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী
পাল্টা যুক্তি
ই-বুকের বিপক্ষেও পাল্টা যুক্তি সাজিয়েছেন কেউ কেউ। তাঁদের বক্তব্য, মুদ্রিত বইয়ের মতো অনুভূতি পাওয়া যায় না ই-বুকে। থাকে না কাগজ-কালির গন্ধ, স্পর্শের আনন্দ। ডিজিটাল স্ক্রিনে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখের সমস্যা। যাঁরা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কিনতে পারেন না তাঁদের কাছে ই-বুক গুরুত্বহীন। অস্তিত্বহীন তাঁদের কাছেও, যাঁরা এর ব্যবহার জানেন না। বিশেষত বয়স্করা।
আরও পড়ুন-চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট, ২০২২ সালে ইউরোপে তাপপ্রবাহের জেরে মৃত্যু হয়েছে ১৫৭০০ জনের!
বাজার দখল
কোনও যুক্তিকেই অগ্রাহ্য করা যায় না। দুটিই থাকুক। নিজের নিজের মতো। তবে একটা শ্রেণির বদ্ধমূল ধারণা, আগামী দিনে ই-বুক পুরোপুরি দখল করে নেবে প্রিন্টেড বুকের বাজার। বিদেশে ই-বুক রমরমিয়ে চলছে। প্রিন্টেড বুকের অস্তিত্ব বিপন্ন। কয়েক বছরের মধ্যে নাকি এখানেও দেখা যাবে একই ছবি। সেটা ভাল না মন্দ সময় বলবে।
প্রশ্ন জাগে, ই-বুক বাজার দখল করে নিলে কলেজ স্ট্রিটের ভবিষ্যৎ কী? সে-ও বুঝি একদিন কালের অতলে তলিয়ে যাবে বটতলার মতো? সেই দিন কি কড়া নাড়ছে?
আরও পড়ুন-তছরুপের অভিযোগে ভাঙল যৌথ মঞ্চ, এফআইআরও
তাঁদের মতে
তেমনটা কিন্তু মনে করেন না এই সময়ের সাহিত্যিক-প্রকাশকরা। বরং তাঁরা শোনালেন আশার কথা। সাহিত্যিক বীথি চট্টোপাধ্যায় জানালেন, ‘যখন নতুন ই-বুক শুরু হল আমিও ভেবেছিলাম হয়তো ছাপানো বই পড়া কমে যেতে পারে। তারপর দেখলাম একইসঙ্গে ই-বুক পড়া হচ্ছে, আবার ছাপানো বই-ও পড়া হচ্ছে। নামী-দামি লেখকদের বই আগের মতোই ছাপা হচ্ছে। প্রতিবছর বইমেলায় অজস্র বই বিক্রি হচ্ছে আবার ই-বুকও রমরম করে চলছে। আসলে তথ্য সংগ্রহের দিকটা পূরণ করে দিচ্ছে ই-বুক। কিন্তু বই পড়ার একটা আনন্দের দিকও রয়েছে। একটা বই হাতে নিয়ে না দেখলে সেই আনন্দের ষোলো আনা পূর্ণ হয় না। যেমন ভিডিও কলে কথা বলা কখনও মানুষে মানুষে মুখোমুখি দেখা হওয়ার বিকল্প হয় না৷ তেমনই এক-একটা বই-ও মানুষের মতো। বই-এর সঙ্গেও সুখ-দুঃখের সম্পর্ক আমাদের। ই-বুক তাই আমরা দেখব, যখন দরকার হবে। আবার বই-ও পড়ব। ছাপানো বই ছাড়া নিজের জীবন এখনও আমি কল্পনা করতে পারি না।’
আরও পড়ুন-তছরুপের অভিযোগে ভাঙল যৌথ মঞ্চ, এফআইআরও
প্রকাশক শুভঙ্কর দে অর্থাৎ অপু বললেন, ‘বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে ই-বুক এখনও পর্যন্ত তেমনভাবে সমাদৃত হয়নি। বরং তাঁরা মুদ্রিত বই কিনে পড়তেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কিছু মানুষের সংগ্রহে আছে অসংখ্য বইয়ের পিডিএফ। কিন্তু পিডিএফগুলোর বদলে তাঁরা পড়েন মুদ্রিত বই। সুতরাং ই-বুক যে এই সময়ে অগণিত মানুষ পড়ছেন, তেমনটা নয়। সেই সংকটের জায়গাটা এখনও আসেনি। আমরা মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি কিছু ই-বুক প্রকাশ করেছি। দূরের পাঠকদের কথা ভেবে। আধুনিক টেকনোলজি এসেছে। তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ই-বুকের পাশাপাশি এসেছে অডিও বুকস। তবে নতুন মাধ্যমে এসেছে বলেই পুরনো মাধ্যমের অস্তিত্ব মুহূর্তে বিপন্ন হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। কোনটা থাকবে, কোনটা থাকবে না, সেটা ভবিষৎ বলবে। মুদ্রিত বই হাতে নিলে যে অনুভূতি হয়, সেটা মোবাইল বা ল্যাপটপে হয় না। এই কারণেই হয়তো মুদ্রিত বইটা থাকবে।’
আরও পড়ুন-করোনা নিয়ে সতর্ক স্বাস্থ্য দফতর
তিনি আরও বলেন, ‘এখন বৈপ্লবিক বদল ঘটেছে কেনাকাটায়। আগে অনেকে কলেজ স্ট্রিট আসতেন বই কেনার জন্য। এখন রাজ্য জুড়ে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ৪৫০-র বেশি বইমেলা। তার ফলে নতুন নতুন বই পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকদের কাছে। পাশাপাশি রয়েছে অনলাইনে বই কেনার সুযোগ। বেশি উপকৃত হচ্ছেন দূরের মানুষরা। কারণ তাঁরা চট করে কলেজ স্ট্রিট আসতে পারেন না। মূলত তাঁদের জন্য অনলাইনে বিক্রি বাড়ছে।’
আরও পড়ুন-অস্ত্রোপচার সফল, শ্রেয়স খেলবেন বিশ্বকাপেও
কথা হল প্রকাশক দীপ্তাংশু মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি জানালেন, ‘মুদ্রিত বইয়ের অস্তিত্ব বিপন্ন এটা আমি একেবারেই মনে করি না। আমরা একশোর মতো ই-বুক প্রকাশ করেছি। মুদ্রিত বইয়ের তুলনায় তার বিক্রি খুবই কম। দশ শতাংশও নয়। ই-বুক বিক্রি হয় বাইরে। বাঙালি এখনও পর্যন্ত মুদ্রিত বই হাতে নিয়ে পড়তেই অভ্যস্ত এবং পছন্দ করে।’
বইয়ের জন্য নির্ধারিত দিনে
আজ ২৩ এপ্রিল। বিশ্ব বইদিবস। নানাভাবে উদ্যাপিত হচ্ছে। কোথাও বসছে আলোচনাসভা, কোথাও বইমেলা। অনেকেই আজ নতুন বই কিনবেন। পড়বেন। বইপ্রেমীদের মেতে ওঠার দিনে এটুকু আশ্বস্ত হওয়া গেল, শরীর এবং গন্ধ নিয়ে মুদ্রিত বই আরও দীর্ঘকাল আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকবে।