পুরনো জিনিস পুনরায়

রিডিউস, রিইউস, রিসাইক্লিং— এই থ্রি আর-ই হল প্রাকৃতিক সম্পদ সাশ্রয় এবং পরিবেশ রক্ষার হাতিয়ার। কীভাবে, লিখছেন সায়েন্স কমিউনিকেটর ড. সীমা মুখোপাধ্যায়

Must read

মনে পড়ে ঠাকুমা দিদিমাদের পুরনো কাপড় দিয়ে নকশিকাঁথা বানানোর কথা। পুরনো কাপড়ের পাড় থেকেই সুতো তুলে কী অপরূপ রঙিন নকশিকাঁথা তাঁরা বানাতেন। রিডিউস, রিইউস বা রিসাইক্লিং-এর কথা তাঁরা জানতেন না। কিন্তু সংসারে ব্যবহার্য জিনিসপত্রাদি পুনরায় ব্যবহারের কৌশল তাঁদের জানা ছিল। মূলত রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ সংস্থা আশির দশকে আবর্জনা সমস্যা-সমাধানের জন্য এক গুচ্ছ পরিকল্পনার সুপারিশ করে। তার মধ্যে প্রধান প্রধান বিষয়গুলি হল অপ্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবহার কমানো রিডিউস (reduce), সৃষ্ট আবর্জনার পুনঃব্যবহার বা রিইউস (reuse) এবং পুনঃচক্রীকরণ বা রিসাইক্লিং (recycling)। এই সুপারিশগুলি থ্রি আর (3R) রূপে বহুল প্রচলিত।

আরও পড়ুন-আইনজীবীদের কালাদিবস

রিসাইক্লিং
এখানে রিসাইক্লিং বলতে পৃথকীকৃত বর্জ্য থেকে নতুন পণ্য বা নতুন পণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের রূপান্তরকে বোঝানো হয়েছে। লোহা, কাঁচ বা অ্যালুমিনিয়াম রিসাইক্লিং করার পর সমমানের জিনিসপত্র তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু প্লাস্টিক রিসাইক্লিং-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম।
রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে বর্জ্য পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করার ব্যবস্থা করলে প্রাকৃতিক সম্পদের সাশ্রয় হয়। এক টন বাতিল অ্যালুমিনিয়াম রিসাইক্লিং করলে চার টন খনিজ বক্সাইট বেঁচে যায়। ৯৫% শক্তি সাশ্রয় হয়। ৪০% জল খরচ কমাতে পারে এবং ৭৫% শক্তি সাশ্রয় হয়। ১.২ টন বাতিল কাগজ থেকে এক টন রিসাইকল্ড কাগজ তৈরি করা সম্ভব। যেখানে আড়াই টন কাঠ প্রয়োজন এক টন কাগজ তৈরি করতে। হিসেব করে দেখা গিয়েছে প্রতি টন পুরনো কাগজ রিসাইক্লিং করে কাগজ তৈরি করলে সাশ্রয় হয় ৫৮% জল এবং ৬৪% শক্তি। গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ কমে। বাঁচানো যায় ১৭টি বৃক্ষকে। কিন্তু প্লাস্টিক রিসাইক্লিং-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী ঘটে দেখা যাক।

আরও পড়ুন-আবাসের টাকা চেয়ে ফের চিঠি

ডাউনসাইক্লিং
রিসাইক্লিং এরপর যে প্লাস্টিক পাওয়া যায় তা নিম্নমানের। প্লাস্টিকের মান রিসাইক্লিং-এর পর ক্রমশ নেমে যায়। ২-৩ বারের বেশি রিসাইক্লিং করাই যায় না। প্লাস্টিকের পানীয় জলের বোতল রিসাইক্লিং করে পুনরায় সেই মানের প্লাস্টিকের বোতল তৈরি প্রায় অসম্ভব এবং খরচ সাপেক্ষ। তাই প্লাস্টিক রিসাইক্লিংকে বলা হয় ডাউনসাইক্লিং। অবশ্য রিসাইক্লিংয়ের পর যে প্লাস্টিক পাওয়া যায়, সেই প্লাস্টিক দিয়ে চেয়ার, টেবিল, বালতি, মগ, নিকাশি নালার পাইপ, স্পোর্টস-এর বিবিধ সরঞ্জাম, এমনকী জ্যাকেট থেকে জুতো— নানান কিছু বানানো সম্ভব। সম্প্রতি বিশ্বের নামকরা একটি স্পোর্টস সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক সংস্থা ভার্জিন প্লাস্টিক (প্রথমবার তৈরি) ব্যবহার না করে সমুদ্রের ধারে পড়ে থাকা কাঁড়ি কাঁড়ি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করে তাকে পরিষ্কার করে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা অবশ্যই শুভ উদ্যোগ। প্লাস্টিকের জিনিসপত্র তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করতে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর হাত পড়ল না। বাতিল বর্জ্যকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করার এই প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়।
প্লাস্টিক রিসাইক্লিং-এর একটি পদ্ধতি হল ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে গ্রানিউল বা প্লাস্টিকের দানা তৈরি করে তা থেকে নানান ধরনের জিনিসপত্র তৈরি করা হয়। ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি বা শক্তি উৎপাদনও সম্ভব। এ-ব্যাপারে প্রচুর গবেষণা চলছে। বর্তমানে রাস্তা তৈরির কাজে প্লাস্টিক-বর্জ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এক টন প্লাস্টিক দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৩.৭৫ মিটার প্রস্থের রাস্তা তৈরি করা যায়। এতে প্রায় সমপরিমাণ বিটুমিন বাঁচানো সম্ভব। এ-ছাড়া প্লাস্টিক-বর্জ্য থেকে ডাউন সাইক্লিং পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের বিভিন্ন জিনিসপত্রাদি তৈরি করার জন্য ঘর-বাড়ি, অফিস-কাছারি, বাজার-হাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বাতিল প্লাস্টিক সংগ্রহ করার ব্যাপারে আরও সংগঠিত ভাবে চিন্তাভাবনা করার প্রয়োজন রয়েছে।

আরও পড়ুন-আবাসের টাকা চেয়ে ফের চিঠি

আপসাইক্লিং
বর্জ্য বস্তুকে ব্যবহার্য করার সঙ্গে আরেকটি কথা জড়িয়ে আছে। কথাটি হল আপসাইক্লিং। আপসাইক্লিং বা ঊর্ধ্বচক্রীকরণ পদ্ধতিতে বর্জ্যবস্তুটির আগের অবস্থা বজায় রেখে নতুনভাবে ব্যবহার করা হয়। এককথায় বলতে গেলে বাতিল জিনিসকে নব রূপে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা অর্থাৎ সৃজনশীল সৃষ্টির মাধ্যমে অনন্য শিল্প সমন্বিত ব্যবহার্য বস্তুতে রূপান্তরিত করার প্রয়াস। যেমন প্লাস্টিকের জলের বোতলকে কেটে তলার অংশে টেপ দিয়ে নকশা করে ফুলদানি হিসেবে ব্যবহার করা যায় আবার বোতলের ওপর ছোট ছোট করে পুরনো কাগজ আটকে তার উপর পুরনো কাপড় টান টান করে লাগিয়ে রং করে রুচিমাফিক চিত্রায়িত করে সুন্দর বাহারি কলমদানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এতে শুকনো ফুলের পুষ্পসজ্জাও চিত্তাকর্ষক হতে পারে। আর জলের বোতলের উপরের অংশ ফুলের পাপড়ির মতো করে কেটে রঙিন টেপ লাগিয়ে সহজেই বড় বড় প্লাস্টিকের ফুল বানানো যায়। নানা উৎসবে নানা ভাবে এগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর ৭০০ কোটির প্রকল্প উপহার

কাজে লাগান চিপসের প্যাকেটও
মুখোরোচক নানান স্বাদের চানাচুর চিপস বা কুড়কুড়ে, নানান স্বাদের রকমারি বিস্কুট ইত্যাদি সুস্বাদু রাখতে পাওয়া যায় প্লাস্টিকের মোড়কে। মুচমুচে রাখার জন্য মোড়কের ভিতরের দিকটা রূপালি রঙের আস্তরণ দেওয়া থাকে। এই ধরনের প্লাস্টিকের প্যাকেট কিন্তু কোনওভাবেই রিসাইক্লিং করা যায় না কারণ বেশিরভাগ চিপসের প্যাকেট তৈরি করা হয় পলিপ্রোপাইল ও অ্যালুমিনিয়ামের আস্তরণ জুড়ে। তাই এই ধরনের প্যাকেট যেখানে সেখানে না ছুঁড়ে বা ময়লা ফেলার পাত্রে না ফেলে আলাদা করে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তবে প্যাকেটের রুপালি অংশটি নানাভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। আমরা নানা পার্বণে রঙিন রাংতা কিনে আনি ডেকরেশনের জন্য। ওই কাজে এই ধরনের প্যাকেটকে দারুণ কাজে লাগানো যেতে পারে। চাইনিজ পেপার কাটিং স্টাইলে ভাঁজ করে কেটে নানান সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। সেগুলো দিয়ে সুন্দর করে জায়গাটা সাজানো যেতে পারে। আবার মঞ্চে নাচের গয়না বা অভিনয়ের জন্য আকর্ষণীয় উত্তরীয় বা অন্য পোশাক বানানো যেতে পারে পাতলা প্লাস্টিকের চাদরের উপর রূপালি নকশা বসিয়ে। বাড়িতে অনেক বাতিল এক্সরে শিট থাকে। এই শিটের উপর রুপালি অংশ কেটে কেটে সুন্দর নকশা করে দেয়াল চিত্র করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন-জাকির-সাকেতের হেনস্থা নিয়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ মুখ্যমন্ত্রীর

প্লাস্টিক দূষণ ঘর থেকেই
বর্তমানে ৫০ মাইক্রনের কম পাতলা পলিব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও নানাভাবে ঘরে আসছে। অনেকেই একটা বড় প্লাস্টিকের প্যাকেটে সেগুলো রেখে দেন। এই পলিব্যাগ কাগজ বিক্রিওয়ালা নেয় না। বাড়ির রোজকার এঁটো-কাটা সবজির খোসা-সহ অন্যান্য জঞ্জাল এই পলিব্যাগে ভরে জঞ্জালের গাদায় পাঠানো হয়। অর্থাৎ প্লাস্টিক দূষণের সূচনা ঘর থেকেই। পাতলা প্লাস্টিকের পলিব্যাগ তুলোর পরিবর্তে ব্যবহার করে নরম পুতুল (সফট টয়) বানানো সম্ভব। মাছ, কচ্ছপ, কাঁকড়া, ব্যাং ইত্যাদি নানান কিছু বানানো যায়। সহজেই বানানো যায় হ্যাঙ্গিং টয় বা ঝোলানো পুতুল। পাপেট বা নানান ধরনের ফুলও বানানো যেতে পারে।

আরও পড়ুন-বিরোধীদের ভাতে মারার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

রিসাইক্লিং এবং আপসাইক্লিং— দুটিই পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। পরিত্যক্ত বর্জ্যকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করাই এর উদ্দেশ্য। দুটি ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক সম্পদ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় না কিন্তু রিসাইক্লিং-এর ক্ষেত্রে বস্তুটিকে নতুন করে তৈরি করা হয় এবং এর জন্য শক্তি ও জলের প্রয়োজন হয়। আপসাইক্লিং পদ্ধতিতে জল বা শক্তির ব্যবহার প্রায় হয় না বললেই চলে। অথচ এর মাধ্যমে বাতিল জিনিস জঞ্জালে পরিণত হয় না এবং সৃজনশীলতা ও আত্মশুদ্ধির সুযোগ রয়েছে। এই ধরনের কাজ শিশুদের পরিবেশবান্ধব পরিবেশ গড়তে সাহায্য করবে। শিশুমনে সৃজনশীল মানসিকতা গড়ে তুলতে খুবই জরুরি এই প্রয়াস।

Latest article