রাজামৌলির ‘নাটু নাটু’র গানটির অস্কার-জয় যখন বিগ স্ক্রিনে তখন ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’ যেন প্রদীপের তলার সেই ছোট্ট অন্ধকারটুকু। বিনোদনের ধামাকায় সর্বক্ষণ মজে থাকা এ-দেশের মানুষ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি যে কী ঘটেছে আদতে! একদিকে মাটি-কাঁপানো গান ‘নাটু নাটু’ অন্যদিকে অবলা অনাথ প্রাণীর নিস্তরঙ্গ জীবনালেখ্য। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! তবু দুয়েরই ঠিকানা অস্কার। কারণ যে-কোনও মৌলিকতাই স্বীকৃতির দাবি রাখে। আর তামিল এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’ একটু আলাদাই কৃতিত্বের দাবিদার— কারণ, এই জয়ের নেপথ্যে রয়েছেন নারী।
আরও পড়ুন-ধর্ম যার যার, উৎসব সবার
থেপ্পাকাডু এলিফ্যান্ট ক্যাম্পের অনাথ দুই হস্তিশাবক ‘রঘু’ আর ‘আম্মো’র নিশ্চুপ ভাষা সোচ্চারিত হয়ে ছুঁয়ে গেছে ৯৫তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের মঞ্চকে। এই দুই অবলার চুপকথাকে সরবে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠত্বের আসনে তুলে দিলেন যাঁরা তাঁরা হলেন গুনীত মোঙ্গা, কার্তিকী গঞ্জালভেস সঙ্গে তাঁদের অন্যতম সহযোদ্ধা বঙ্গকন্যা সঞ্চারী দাস মল্লিক। সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র বিভাগে ভারতের হয়ে প্রথম অস্কার পেলেন আসলে তাঁরাই। কোনও সাফল্যই একক প্রচেষ্টায় আসে না, তার কান্ডারি দু-একজনই হন। ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’ নিশ্চয়ই সেরা টিমওয়র্ক যার কান্ডারি নারী। আর শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটি যখন নারীর মাথায় তখন সেই প্রাপ্তির অনুভূতি আলাদাই হয়।
অস্কারজয়ী তথ্যচিত্রের নেপথ্যের সেই নারীরা হলেন প্রযোজক গুনীত মোঙ্গা, পরিচালক কার্তিকী গঞ্জালভেস এবং সহকারী সম্পাদক সঞ্চারী দাস মল্লিক। কীভাবে এল তাঁদের সেই সাফল্য…
আরও পড়ুন-নেত্রীর নেতৃত্বে জোট বাঁধছে বিরোধীশক্তি
সেরা প্রযোজনায়
রবিবার সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসের ডলবি থিয়েটারে জমকালো অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের মঞ্চে ৯৫তম অস্কার সম্মাননা ঘোষণা করার পরমুহূর্ত থেকেই তাঁর নাম এবং সেই সঙ্গে তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গিয়েছিল। তিনি হলেন প্রযোজক গুনীত মোঙ্গা।
অস্কার জিতে নেওয়া ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’ ছবির এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসর হলেন গুনীত। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে বেশ পরিচিত নাম গুনীত। তাঁর প্রযোজনা সংস্থা শিখ্যা এন্টারটেনমেন্ট ইতিমধ্যে গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর পার্ট ওয়ান, পার্ট টু, লাঞ্চবক্স, পাগলাইত, মাসান, জুবান, ১২৩২ কেএমএস ইত্যাদি বেশ চর্চিত ছবি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। অস্কার অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার অনুভূতিও তাঁর কাছে নতুন নয়। আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর পরিচিতি রয়েছে। ২০১৯ সালে ইরানিয়ান-আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক রায়কা জেটাবচির ‘পিরিয়ড অ্যান্ড অফ সেনটেন্স’ ছবিটি সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র হিসেবে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পায় যার প্রযোজক টিমে ছিলেন গুনীত। ভারতের জন্য এই প্রথম অস্কার এল তাঁর হাত ধরেই। তিনিই প্রথম ভারতীয় প্রযোজক যিনি ‘অ্যাকাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স’-এর অন্তর্ভুক্ত সদস্য। এখানেই তাঁর পরিচিতি শেষ হয়ে যায় না বিদেশের একটি বিখ্যাত পত্রিকায় সেরা বারো উইমেন আচিভারের অন্যতম নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন-যৌথ নেতৃত্বেই বীরভূমে লড়বে তৃণমূল
গুনীতের বহুমুখী কর্মজীবনের শুরু প্রোডাকশন কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। কাজ করেছেন সালাম ইন্ডিয়া, রঙরসিয়া, ওয়ানস আপন এ টাইম ইন এ মুম্বই ছবির জন্য। এরপর অনুরাগ কাশ্যপের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। আন্তর্জাতিক ছবির কাজে তাঁর হাতেখড়ি গ্রেগ হেলভের শর্ট ফিল্ম ‘কভি’র মাধ্যমে। যেটি গল্পের জন্য স্টুডেন্ট অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পায়। সেই সময় থেকেই ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছেন সাফল্যের পথে।
অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের মঞ্চই এবার তাঁকে সেই স্বীকৃতি দিল। এর আগে ১৯৬৯ এবং ১৯৭৯ সালে দুটি ভারতীয় ছবি ‘দ্য হাউজ দ্যাট আনন্দ বিল্ট’ এবং ‘অ্যান এনকাউন্টার উইথ ফেসেস’ এই বিভাগে মনোনয়ন পেলেও অস্কার জিততে ব্যর্থ হয়। অবশেষে অস্কার পেল ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’। এই অভূতপূর্ব জয় প্রসঙ্গে গুনীত বলেন, ‘‘এই জয় সব নারীর জন্য। ১.৪ বিলিয়ন মানুষের জন্য।”
আরও পড়ুন-নারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত, স্বীকার শুভেন্দুর, গ্রেফতারের দাবি তৃণমূলের
সেরা পরিচালনায়
মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট যেখানে রয়েছে ১৪০ বছরের প্রাচীন থেপ্পাকাডু এলিফ্যান্ট ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে কাহিনি শুরু হয় পরিচালক কার্তিকী গঞ্জালভেসের স্বল্পদৈর্ঘ্যর তথ্যচিত্র ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’-এর। সত্যজিৎ রায়, এ আর রহমান, নাটু নাটু অস্কার জিতলেও প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে এই তামিল তথ্যচিত্রটি। যার অন্যতম আর-এক কান্ডারি হলেন কার্তিকী। কী এমন ছিল এই তথ্যচিত্রে যা নির্মাতার মুকুটে জুড়ল সেরার পালক! একটু দেখে নিই…
এই ছোট্ট ডকু ছবিটির কুশীলবেরা বড়ই সাধারণ। মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা মাহুত-দম্পতি বোমান ও বেলি আর তাঁদের সন্তান দুই অনাথ হস্তিশাবক রঘু আর আম্মো। দুর্ঘটনায় আহত রঘুর দায়িত্ব বনদফতর সঁপে দেয় বোমান আর বেলির হাতে। বেলির আগের পক্ষে স্বামীর একটি মেয়ে ছিল যে মারা যায়। এখন নাতনিই সম্বল। বোমানকে বিয়ে করার পর একসঙ্গে এই মহৎ কর্মে নিয়োজিত হন তাঁরা। রঘুকে হাতে পেয়ে তার ক্ষত সারিয়ে পরমস্নেহে বড় করে তোলে তাকে। কিন্তু একদিন রঘুর দায়িত্ব পড়ে যায় অন্যের কাঁধে। তাঁদের সঙ্গে আর থাকা হয় না রঘুর। রঘুকে পেয়ে বেলি যেন ফিরে পেয়েছিল তাঁর হারানো সন্তানের অনুভূতি। কিন্তু আবার যেন সে সন্তানহারা হয়। ওই সময় আর-এক অনাথ হস্তিশাবক আম্মোর দায়িত্ব পান তাঁরা। রঘুর চলে যাবার পর মাহুত-দম্পতির অন্তিম আশ্রয় হয়ে ওঠে আম্মো। সবাক মানুষের সঙ্গে অবলা পশুর নির্বাক ভাষার কী ভীষণ মায়াময়তা— সেই গহিন ভালবাসা, স্নেহের সম্পর্কের সঙ্গে হাতিকে দেবজ্ঞানে পুজো-অর্চনা— সবটাই কুশলীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কার্তিকী। পাশাপাশি রিজার্ভ ফরেস্টের অপার্থিব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এলিফ্যান্ট ক্যাম্পের হাতিদের জীবন, পশুদের ঘিরে সমগ্র কুট্টুনায়কন উপজাতির জীবনচিত্র, মধু সংগ্রহ ইত্যাদি সব দৃশ্যই যেন ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’-এ জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর পরিচালনার গুণে।
আরও পড়ুন-বাড়ছে বাজেট, বিদায় নিশ্চিত স্টিফেনের
ছবির ক্যামেরার কারিগরি অসাধারণ।
যার কৃতিত্বও কার্তিকীরই। কারণ নিঁখুত ক্যামেরা করার কৌশল রপ্ত করেছেন কার্তিকী তাঁর পেশাসূত্রেই। নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত কার্তিকী গঞ্জালভেস। একটা সময় ক্যামেরা অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন ডিসকভারি এবং অ্যানিমাল প্ল্যানেট চ্যানেলে। ২০২০ সাল থেকে তিনি সোনি-র ‘আর্টিসান অফ ইমেজারি’ ইন্ডিয়া কমিউনিটির অন্যতম সদস্য। প্রকৃতি এবং বন্যপ্রাণীদের নিয়ে কাজ করার সুবাদে ঘুরেছেন বহু বিস্তীর্ণ অঞ্চল। উটিতে জন্ম এই প্রতিভাধর চিত্রপরিচালকের জীবনই হল প্রকৃতি এবং বন্যপ্রাণীদের নিয়ে। ২০২২ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’। এই তথ্যচিত্রটির সঙ্গে মনোনীত হয়েছিল ‘হাউল আউট’, ‘হাও ডু ইউ মেজার এ ইয়ার’, ‘দ্য মারথা মিশেল এফেক্ট’ ও ‘স্ট্রেঞ্জার অ্যাট দ্য গেট’ও। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে এই তথ্যচিত্রটি পুরস্কার পাবার পর পরিচালক কার্তিকী বলেন, ‘‘এই পুরস্কার আমি উৎসর্গ করছি আমার মাতৃভূমি ভারতকে।’
আরও পড়ুন-বাড়ছে বাজেট, বিদায় নিশ্চিত স্টিফেনের
সম্পাদনার সেরা সহযোদ্ধা
অস্কার-মঞ্চে বঙ্গকন্যা সঞ্চারী হলেন খোদ তিলোত্তমা কলকাতার মেয়ে। এমন স্বপ্ন বাঙালির পূরণ হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে। যদিও বিখ্যাত সেই মঞ্চে উঠে অস্কার নেননি সঞ্চারী কিন্তু টিম ‘দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার্স’-এর সহযোদ্ধা তিনি। নেপথ্যের নায়িকা। এই ছবিটির সহ-সম্পাদনা করেছেন সঞ্চারী দাস মল্লিক। তিনি সেই বাঙালিকন্যা যাঁর কেরিয়ারের শুরুর দিকেই অস্কারের মতো অ্যাওয়ার্ড এসে গেছে তাঁর পুরস্কারের ঝুলিতে। ২০২১-এ এই তথ্যচিত্রটির শ্যুটিং শুরু হয় তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন মা শুভা দাস মল্লিক। পাঁচ জন ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে শ্যুটিং হয়েছে এই তথ্যচিত্রের। সবমিলিয়ে ৫০০ ঘণ্টার ফুটেজ ছিল। সেই ফুটেজকে ৪০ মিনিটে নামিয়ে আনা খুব সহজ কাজ ছিল না। যা সঞ্চারী করে দেখিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে। সঞ্চারীর রক্তে সিনেমা কারণ তাঁর মা শুভা দাস মল্লিক নিজে একাধারে অধ্যাপক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। সেন্ট জেভিয়ার্স ইনস্টিটিউটে মাস কমিউনিকেশন পড়িয়েছেন ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০০ সাল অবধি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে একটি ছবি তৈরি করেছিলেন শুভা দাস মল্লিক। ছবির নাম ‘ক্রসউইন্ডস ওভার ইছামতী’। এই ছবির সম্পাদনা করেছিলেন সঞ্চারী নিজে। ২০১২-তে এই ছবি মুম্বই আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও দেখানো হয়। এরপর ২০১৬ সালে শুভা দাস মল্লিকের পিয়ানোর উপর নির্মিত আর একটা ছবি ‘ক্যালকাটা সোনাটা’রও সম্পাদনা করেছেন সঞ্চারী। আগামীতে আরও একটি ছবি করবেন সঞ্চারীর মা, যার সম্পাদনার দায়িত্বও দিয়েছেন মেয়েকেই।
আরও পড়ুন-সাংসদ পদ খারিজ রাহুলের, বিক্ষোভে সামিল কংগ্রেস নেতারা
এমনকী সঞ্চারীর দাদু মনোজেন্দু মজুমদার ছিলেন চলচ্চিত্রের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। তিনি ছিলেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির একজন ফাউন্ডার মেম্বার। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে চার বন্ধুকে নিয়ে এই ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্ববরেণ্য পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সঞ্চারীর দাদু ছিলেন তাঁদেরই মধ্যে একজন। ছোট থেকেই চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি দেখার অভ্যেস সঞ্চারীর। সেই মেধা, মনন, স্পৃহা, চলচ্চিত্রের সঙ্গে সেই আত্মিক সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ হল তাঁর ‘অস্কার’ প্রাপ্তি। বর্তমানে মুম্বইয়ে বিজ্ঞাপন ও তথ্যচিত্র সম্পাদনার কাজের সঙ্গে যুক্ত সঞ্চারী। তথ্যচিত্রটি অস্কার জেতার পর সঞ্চারী মিডিয়াকে বলেছিলেন, ‘‘পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকাসনে বসে আমরা লাফিয়ে উঠেছিলাম। চারদিকে কে তাকাল, কে দেখল… এসব পাত্তা না দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলাম। তবে হ্যাঁ, গোটা জার্নিটা মনে থাকবে আমার।”