রাতুল দত্ত: জ্বলজ্বলে দুটি চোখ। শরীরের আকারের তুলনায় একটু বড়ই। আঁধার রাতে তাকালে একটা ভৌতিক ভয়ই লাগে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার! তার ওপর ধারালো চোখা ঠোঁট, বাপ রে বাপ! মনে হয় এখনি একটা ঠোকর দিয়ে উপড়ে নেবে চোখ। কিন্তু আসলেই সে নিরীহ। এমনি এমনি কাউকে আক্রমণ করার রেকর্ড সে কোনদিনই করেনি। সুনাম, সম্মান জুটলেও একই সঙ্গে তার ভাগ্যে জুটেছে দুর্নাম, অপবাদ আর কুসংস্কারের অত্যাচার। মানুষ এই পাখিকে নিয়ে তৈরি করেছে গল্প, সংস্কার কিংবা লোকবিশ্বাস। যেমন, কয়েক দশক আগেও ক্যামেরনের মানুষ পেঁচাকে কোনো নাম ধরে ডাকত না। ‘যে পাখি ভয় দেখায়’ এই কথাটি বললেই সেখানে সবাই বুঝে নিত কোন পাখির কথা বলা হচ্ছে। নিরীহ আর ভয়ঙ্কর সুন্দর এই পাখিটির নাম পেঁচা। আমরা তাকে ডাকি হুতুম পেঁচা, লক্ষ্মী পেঁচা, ঈগল পেঁচা বলে।
আমাদের প্রিয় অনুভূতিগুলোকে, ভাবনাগুলোকে পাখিদের সাথে মিলিয়ে দেখার নিরন্তর চেষ্টা করেছেন রূপসি বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ। বাংলার পাখিদের নিয়ে দারুণভাবে আগ্রহী ছিলেন তিনি। তাঁর অসংখ্য কবিতার লাইনের ফাঁকে ফাঁকে বাংলার নানা প্রজাতির পাখিরা উঁকি দিয়ে রয়েছে। নানা পাখিদের মতো নিশাচর নিম প্যাঁচাও তার রচনায় স্থান পেয়ে পাণ্ডুলিপিকে করেছে সমৃদ্ধ। তবে এখন আর সারাদিন খোঁজাখুজি করেও একটা পেঁচার সন্ধান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ আমাদের দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এই ভয়ঙ্কর সুন্দর পাখিটি।
কখনো মানুষের কোনো ধরনের অনিষ্ট করে না এরা; বরং কিছুটা উপকারেই আসে। ইঁদুর খেয়ে মানুষের ফসল রক্ষা করে। এদের মাংস ভক্ষণে অরুচি থাকায় শিকারিরাও এ পাখি শিকার করে না খুব একটা। এত কিছুর পরও ওরা আজ অস্তিত্ব সংকটে। এর প্রধান কারণটি হচ্ছে পরিবেশ বিপর্যয়। খাদ্য সংকটও আরেকটি কারণ। তার ওপর রয়েছে গাছের প্রাকৃতিক কোটর স্বল্পতা এবং পুরনো দর-দালান হ্রাস পাওয়াতে ওদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে ব্যাপকভাবে। এতে চিরচেনা এসব পাখি সাধারণ মানুষের কাছে আজকাল অচেনা হয়ে পড়ছে।
পেঁচার বিশেষ ১০ বৈশিষ্ট্য
১. পেঁচার ঘাড়ের বৈশিষ্ট্য বিস্ময়কর। এদের ঘাড়ে ১৪টি অস্থিসন্ধি থাকে। মানুষের ঘাড়ে থাকে এর অর্ধেক। এ অনন্য দেহ বৈশিষ্ট্যের জন্য পেঁচার ঘাড় ২৭০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুরে যেতে পারে। ২. কিছু কিছু পেঁচার নকল চোখ থাকে, যেমন- নর্দান পিগমি আউল। এদের মাথার পেছনে কালো রঙের কিছু পালক আছে যা দেখলে অবিকল চোখ বলে মনে হবে। ৩. পেঁচা দুই কানে দুই রকম শব্দতরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে। ৪. গ্রেট হর্ন্ড পেঁচাসহ কিছু প্রজাতির পেঁচারা সাঁতার কাটতে পারে। এরা ডানার সাহায্যে সাঁতরে তীরে পৌঁছায়। ৫. কিউবার ‘জায়ান্ট আউল’ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকৃতির পেঁচা। এদের উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন ফুট। যদি এদের ওড়ার ক্ষমতা থাকতো, তবে এদেরকেই বলা যেত উড়তে জানা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি। ৬. আর্কটিকে বসবাসকারী তুষার পেঁচারা শীতের মৌসুমে দক্ষিণ দিকে তিন হাজার মাইল পর্যন্ত ভ্রমণ করে। ৭. পেঁচারা বাসা তৈরি করতে পারে না। ৮. সব পেঁচা নিশাচর নয়। গ্রেট গ্রে, নর্দান হক্, নর্দান পিগমিসহ পেঁচার আরও কয়েকটি প্রজাতি রয়েছে যারা দিনের বেলা শিকার করে। কারণ, এরা যেসব অঞ্চলে বসবাস করে সেখানে রাতের বেলা তেমন কোনো শিকার পাওয়া যায় না। ৯. মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতে পেঁচা অনেক উপকারী ভূমিকা পালন করে। এসব অঞ্চলের পেঁচাদের প্রধান শিকার ইঁদুর। আর এই ইঁদুর হচ্ছে ফসলের শত্রু। ১০. নারী পেঁচারা আকৃতিতে পুরুষ পেঁচার চেয়ে বড়।
বিশ্বের অদ্ভুত দর্শন ২৫ প্রজাতির পেঁচা
(১) রেখাযুক্ত মেছো প্যাঁচা (২) রাফাস মেছো প্যাঁচা (৩) পেল মেছো প্যাঁচা (৪) তাওনি মেছো প্যাঁচা (৫) বাফি মেছো প্যাঁচা (৬) বাদামি মেছো প্যাঁচা (৭) ব্ল্যাকিস্টনের মেছো প্যাঁচা (৮) ফিলিপিনো ইগল প্যাঁচা (৯) একুন ঈগল প্যাঁচা (১০) ডাস্কি ঈগল প্যাঁচা (১১) ফরেস্ট ঈগল প্যাঁচা (১২) মালয় ঈগল প্যাঁচা (১৩) শেলির ঈগল প্যাঁচা (১৪) ভেরক্স ঈগল প্যাঁচা (১৫) উসাম্বারা ঈগল প্যাঁচা (১৬) ফ্রেশারের ঈগল প্যাঁচা (১৭) ধূসরাভ ঈগল প্যাঁচা (১৮) স্পটেড ঈগল প্যাঁচা (১৯) কেপ ঈগল প্যাঁচা (২০) ভারতীয় ঈগল প্যাঁচা (২১) ফারাও ঈগল প্যাঁচা (২২) ইউরেশিয়ান ঈগল প্যাঁচা (২৩) ছোট শিং প্যাঁচা (২৪) বড় শিং প্যাঁচা (২৫) তুষার প্যাঁচা। পৃথিবীতে কয়েক ধরনের পেঁচা বেশ উল্লেখযোগ্য। এগুলো হলো : সাদা ফোটার পেঁচা (Spotted Owl), ঈগল পেঁচা (Eagle Owl), শিংওয়ালা পেঁচা (Great Horned Owl), লম্বা কানের পেঁচা (Long-eared Owl), মুখোশধারী পেঁচা (Masked Owl) ইত্যাদি। এদের মধ্যে ঈগল পেঁচা দেখতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।
প্যাঁচার ওপর নির্যাতন ও হত্যা
নির্বাচনের সময় কর্তৃপক্ষ ভোটারদের মন জয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ‘উপহার সামগ্রী’ বিতরণ করার ব্যাপারে আগ্রহী থাকে। এখানে বিষয়টি উলতপুরান। কয়েক বছর আগে তেলেঙ্গানায় স্থানীয় নির্বাচনের সময় প্রশাসনের নজরে আসে, সীমান্ত রাজ্য কর্ণাটক থেকে প্রচুর পেঁচা, এই রাজ্যে আসছে। উদ্দেশ্য অসৎ। বিশ্বাস, প্যাঁচার শরীরের কোন কোন অংশ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে বলে স্থানীয়ভাবে বিশ্বাস করা হয়। স্থানীয় কুসংস্কার অনুযায়ী প্যাঁচা নাকি প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাজয় নিশ্চিত করতে পারে! কর্নাটক বনবিভাগের এক কর্মকর্তার বক্তব্য, সন্দেহভাজনরা জানিয়েছে তেলেঙ্গানার অনেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ওপর যাদুটোনা করার জন্য প্যাঁচা দরকার! এতে করে নাকি তাদের মনোবলও ভেঙে পড়ে! ভারতের অনেক গ্রামে এমনও ঘটে যে, পেঁচা মেরে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জামা, মরা প্যাঁচার শরীরে বেঁধে সেটি প্রতিপক্ষের বাড়ির সামনে ফেলে দিয়ে আসা হয়।
প্যাঁচা পাচারের ব্যবসা একটা বিরাট ব্যবসা। উত্তর ভারতে প্যাঁচার চাহিদা প্রচুর এবং দক্ষিণ ভারতও পেছিয়ে নেই। যারা তন্ত্র সাধনা করে তা ব্যাপকভাবে প্যাঁচা ব্যবহার করে। গবেষকদের মতে, কত অমানবিক আর অমানষিক হলে এসব আচার পালনের সময় প্যাঁচার চোখে পিন ফোটানো হয় বা তাদের ডানা ভেঙে দেওয়া হয়। বিশ্বের অনেক দেশে প্যাঁচাকে জ্ঞানী পাখি হিসাবে দেখা হলেও ভারতে কাউকে প্যাঁচার সঙ্গে তুলনা করার মানে হল তাকে ছোট করা বা অপমান করা। অন্যদিকে, প্যাঁচা ধেড়ে ইঁদুর খায়, সাপ, খায়। কোন কোন প্রজাতির প্যাঁচা পরিবেশের জন্য উপকারী। ফলে এটা খুবই দু:খের বিষয় এধরনের কুসংস্কারের খপ্পড়ে পড়ে প্যাঁচা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে বসেছে। প্যাঁচার প্রজনন প্রক্রিয়াও খুব শ্লথ। বড় প্যাঁচা বছরে – কখনও কখনও দুবছরে একটি কি দুটি বাচ্চা দেয়। ফলে তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির হারও খুবই কম।
ভারতীয় উপমহাদেশে একসময় বিশ্বাস করা হতো, পেঁচার ঔষধি গুণ আছে। আর তাই পেঁচার হাড়-মাংস-রক্ত দিয়ে তৈরি করা হতো রাতকানাসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ। রাশিয়ার শিকারিরা শিকারে যাওয়ার সময় পেঁচার নখর সঙ্গে রাখত। তারা মনে করত, শিকারে গিয়ে মরে গেলে পেঁচার নখরই তাদের স্বর্গে নিয়ে যাবে। দেওয়ালির মত পূজোপার্বণে হাজার হাজার পেঁচা বিল দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে পেঁচার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফসলের জমিতে পোকা-মাকড় মারার জন্য অতিরিক্ত বিষ ব্যবহারের ফলে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি নানা প্রতিকূলতায় দিন দিন আমাদের দেশ থেকে পেঁচা হারিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন আমাদের দেশে পেঁচার সংখ্যা কমছে। প্রাকৃতিকভাবে বালাই ব্যবস্থাপনার জন্য পেঁচার জুড়ি নাই। এদের বাঁচিয়ে রাখা আমাদেরই কর্তব্য।