ডঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায় : আমি প্রথমেই একটা কথা সরাসরি বলি। অতীতে ছাত্র রাজনীতির একটা আলাদা ঘরানা, আলাদা প্রাণ ছিল। এখন নানা কারণে সার্বিকভাবে এই পরিস্থিতির বদল হয়েছে। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আজ বাংলায় ছাত্র রাজনীতি করা বেশ কঠিন। বেশ চ্যালেঞ্জের, বিশেষত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পক্ষে। কিছু নতুনত্বের দরকারও আছে। কেন আমি একে কঠিন বলছি, তার ব্যাখ্যাও আমি দেব। কারণ চিরাচরিত সংজ্ঞা আর আচরণবিধি বদল হচ্ছে।
ধরা যাক সাতের দশক। ছাত্র আন্দোলন মানে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। বাম, অতিবাম, জাতীয়তাবাদী, সব স্রোতেই এক বিজ্ঞান। সরকারমুখী বা সরকারভিত্তিক কর্মসূচি নয়। কলেজগেট থেকে রাজপথের আন্দোলন। আমাদের সরকার, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায়, তখনও গ্রেপ্তার হয়েছি আমি বা আমরা। সুব্রতদা মন্ত্রী, তাঁর গাড়ি আটকে বাসট্রামে ছাত্রকনসেশন চেয়েছি। সুব্রতদা ট্রামের উপর দাঁড়িয়ে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে বলবেন। পরে সেটা হয়েওছিল।
তখন ছাত্র সংগঠনে রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্য, সংস্কৃতির চর্চা ছিল। যৌথ চর্চার মনোভাব ছিল। আসলে তখন যৌথ পরিবারের কাঠামো। মানসিক গঠন অন্যরকম। এখন নিউক্লিয়াসফ্যামিলি। অনেকেই কেরিয়ারভিত্তিক মানসিকতায়। এই ভিত্তিটাও বড় ফ্যাক্টর।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সহধর্মিণীর প্রয়াণে মুখ্যমন্ত্রীর শোকবার্তা
অতীতে কলেজ গেট কাঁপত কলেজ ও ছাত্রসমাজের উন্নয়ন নিয়ে। লাইব্রেরি, কমনরুম নিয়ে কতরকম ইস্যু। এখন তো ভালো দেওয়াল পত্রিকা, নিয়মিত সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা কালের নিয়মে হারিয়ে যাচ্ছে বহু জায়গাতেই। আমাদের সময় কলেজে সাহিত্যিক অচিন্ত্য, ফুটবলার চুনী, সুকুমার সমাজপতি থেকে বক্সার শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের উত্থান। বহুবিধ চর্চা, সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা। ছাত্র রাজনীতি যাঁরা করেছেন, সবরকম ছাত্রকে টানার চেষ্টা করেছেন। সুব্রতদা, প্রিয়দা, দীনেশ মজুমদার, বুদ্ধবাবু, গৌতম দেবরাও। মমতাও এই প্রবল লড়াই করেই উঠেছে। আমরা কারুর সমালোচনা করতে ভয় পেতাম না। মমতা এই লড়াই করতে কম মার খায়নি। মমতা বা আমরা ফাঁকা মাঠে গোল দিতাম না। দুপক্ষ থাকবে। তবেই তো গোল দিয়ে জিতে মজা!
সেসময় যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা বহু কলেজ গায়ের জোরে দখল করতে গেল। বিরোধী থাকবে না। এসবে মানুষ বিরক্ত হলেন। তারা চলে গেলেন। বামেরা এলো ক্ষমতায়। তারাও ক্রমশ একই কাজ করল। ফলে তাদের যেতে হল। কংগ্রেস, বাম, নকশাল- সবরকমই দেখলেন মানুষ। এখন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারে। ফলে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আরও দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
এখন টিভি, ফেসবুকের যুগ। প্রচার অনেক সহজ। আজ যত সহজে প্রচার পাওয়া যায়, আগে অনেক বেশি কাজেও সেটা ছিল না। আমি প্রযুক্তিকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু মানতে হবে স্বয়ং মমতাও তার ছাত্রজীবনে যে কঠিন লড়াই করেছে, তার কোনও প্রচার সে পায়নি। মনে রাখতে হবে আজকের এই সুলভ প্রচার যেন আন্দোলনবিমুখতা না আনে। কলেজ গেটের উন্মাদনার বদলে যেন ফেসবুকমুখী সংগঠন না হয়। ফেসবুক অবশ্যই থাকবে। কিন্তু সরাসরি জনসংযোগ বাদ দিয়ে নয়। কলেজ তো নেতা তৈরির কারখানা। ওই ছেলেটি বা মেয়েটি ভালো বলে, ও বেশি জনপ্রিয়, ওরা ভালো মিশতে পারে, এইভাবে দেখে দেখেই তো নতুনদের তুলে আনতে হয়। শুধু রাজনীতি নয়, চাই মেধা, চাই খেলাধূলা ও সংস্কৃতির বিকাশমুখী কর্মসূচি। শুধু ‘হ্যাঁ’ বলার কাজ করলে ছাত্র সংগঠন কারুরই কাজে লাগে না। ছাত্র সংগঠনকে ছাত্রসমাজকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে, বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। শুধু গানবাজনার আসর সাময়িকভাবে ভালো লাগতে পারে। কিন্তু তাতে স্থায়ী সাংগঠনিক লাভ হয় না।
আরও পড়ুন : ত্রিপুরায় ফের বিজেপির হামলা, তৃণমূলের চাপে ছাত্রীর জবানবন্দিতে রাজি পুলিশ
এবার আসি জরুরি কথায়। বাংলায় ছাত্র রাজনীতি করা এখন খুব কঠিন। বিশেষত তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের পক্ষে।
তার মূল কারণ হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ছাত্রছাত্রীদের জন্য এতরকম কাজ করেছেন এবং করে চলেছেন যে তারপর কোনো দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের জায়গাটাই কমে গেছে। অতীতে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সরকারও বহু ভালো কাজ করেছিলেন। অনার্সে বহু বিষয় আনা, ট্রামে কনসেশন ইত্যাদি। বামজমানায় প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়া বা কম্পিউটার চালুর বিরোধিতা করা ছাত্রসমাজের পক্ষে চরম ক্ষতিকারক হয়েছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত কাজ করছেন, ভাবা যায় না। নতুন সময়োপযোগী সিলেবাস থেকে বিনামূল্যে শিক্ষা, ব্যাগ, বই, জুতো, কন্যাশ্রী, সবুজসাথীর সাইকেলসহ বিভিন্ন স্কিম পাশে পেয়ে একটি ছাত্র বা ছাত্রী যখন কলেজে আসছে, তখন সে অনেকটাই তৃপ্ত। এতগুলি নতুন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আসন বৃদ্ধি, ভর্তির সরলীকরণসহ বহু পদক্ষেপ হয়েছে। ফলে ছাত্র সংগঠন আগে যেসব কারণে পড়ুয়াদের আকর্ষণ করত, সেই প্রয়োজনগুলি রাজ্য সরকার মিটিয়ে দিয়েছে। মহিলা কলেজ বাড়ছে। অন্যান্য ভাষায় স্কুলকলেজ হচ্ছে। সমাজের কোনো অংশ উপেক্ষিত নয়।
ফলে সরকারের কাজ যত বাড়ছে, ছাত্র সংগঠনের কাজ তত কঠিন হচ্ছে। বিশেষত তৃণমূল ছাত্র পরিষদের। এস এফ আই বা কেউ কেউ তো দেখি শিক্ষকদের কোনো বিষয়ে কথা বলছে। শিক্ষকদের স্বার্থে বহু কাজও সরকার করছে। আমি বলতে চাই ছাত্র সংগঠন ছাত্রদের নিয়ে বলার বিষয় পাচ্ছে না।
এখন করোনা পরিস্থিতি। ফলে কলেজভিত্তিক সংগঠন কঠিন। আমি জানি।তার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রমুখী পদক্ষেপগুলির জন্য দাবিভিত্তিক ছাত্র আন্দোলনের পরিসর কমে এসেছে। ফলে তৃণমূল ছাত্র পরিষদকে আরও দায়িত্ব নিয়ে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, ইভেন্ট, জনসংযোগের মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষ জনসংযোগ বাড়াতে হবে। যাতে ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনগুলি যেমন সরকার মেটাচ্ছে, পাশাপাশি তার অন্য উদ্ভাবনী শক্তি এবং কর্মযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। মমতার লড়াই, জীবন, প্রতিকূলতাকে জয় করার যুদ্ধ নতুন প্রজন্ম পছন্দ করে। এখন এই নতুন প্রজন্মের নক্ষত্রগুলিকে আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী সংগঠিত করাটাই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দায়িত্ব।
আজকের ভারত এগোতে চায়। এখানে ধর্ম, জাতপাত থাকবে না। এখানে সরকার নাগরিকদের পাশে থাকবে। এখানে নতুন প্রজন্ম তার বিকাশের মাধ্যমে সমাজকে সমৃদ্ধ করবে। ছাত্র রাজনীতির অতীতের প্রেক্ষিত এবং আজকের বাংলার ইতিবাচক পরিস্থিতি, এই দুই অভিজ্ঞতার মধ্যে সেতুবন্ধনের মধ্যে দিয়ে এগোতে হবে তৃণমূল ছাত্র পরিষদকে। তারা বহু যুদ্ধজয়ের সৈনিক। আগামী দিনেও তারাই ছাত্ররাজনীতিকে পথ দেখাবে।