যে-কোনও উৎসবে মেতে উঠত ভবানীপুরের চট্টোপাধ্যায় পরিবার। তা সে নতুন বছর হোক, লক্ষ্মী পুজোই হোক বা বাড়ির কারও জন্মদিন। সারাবছর থাকতেন বিশেষ বিশেষ দিনের অপেক্ষায়। তবে অতি-বিখ্যাত এই পরিবারের সদস্যদের কাছে সেপ্টেম্বর মাসের গুরুত্বই আলাদা। কারণ? এই মাসেই তিনজনের জন্মদিন। ৩ সেপ্টেম্বর পরিবারের মধ্যমণি মহানায়ক উত্তমকুমার জন্মেছিলেন, ৭ সেপ্টেম্বর পুত্র গৌতম, ২৭ সেপ্টেম্বর উত্তমকুমারের স্ত্রী গৌরীদেবীর জন্মদিন। তিনটে দিনেই নাকি হত জমজমাট সেলিব্রেশন। ঘরভর্তি লোকজন, জমজমাট আড্ডা, খাওয়াদাওয়া।
আরও পড়ুন-রাজ্য সরকারের উদ্যোগে শুরু হল সিভিল সার্ভিস স্টাডি সেন্টার
জানা যায়, জন্মদিন উপলক্ষে চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে হত পার্টি। ছোটরা হইহল্লা করত সন্ধে পর্যন্ত। তারপর ছুটি। বড়দের লেটনাইট পার্টি শুরু হত রাত একটু গভীর হলে। একে একে সবাই ঢুকে যেতেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে। চলত খানাপিনা, নাচাগানা। ছোটদের কোনও সুযোগ ছিল না সেই পার্টি দেখার।
উত্তমকুমারের পুত্র গৌতম। গৌতমের স্ত্রী সুমনা চট্টোপাধ্যায়। বিবাহসূত্রে ১৯৭৮ সালে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যা হয়েছেন। মহানায়ক চলে গেছেন ৮০-তে। অর্থাৎ বিখ্যাত শ্বশুরমশাইকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন মাত্র দু বছর। স্নেহ এবং আশীর্বাদ, দুটোই পেয়েছেন। সুমনাদেবীর সঙ্গে কথা হল। মহানায়ক সম্পর্কে তিনি বললেন, আমার পরম সৌভাগ্য এমন একজন মানুষের পুত্রবধূ হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। শ্বশুরমশাই ছিলেন খুব ঘরোয়া। বাড়িতে সবার সঙ্গে খুব স্বাভাবিক ভাবে মিশতেন। দেখে মনেই হত না উনি মহানায়ক।
আরও পড়ুন-সেচ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজার নির্দেশ মন্ত্রীর
৩ সেপ্টেম্বর উত্তমকুমারের জন্মদিন কীভাবে পালিত হত? সুমনাদেবী জানালেন, বিয়ের পর ওঁর জন্মদিনের সাক্ষী থেকেছি। উনি সকালে এই বাড়িতে এসে মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ি-মা গৌরী দেবীর সঙ্গে দেখা করতেন। কথাবার্তা বলতেন। হাসি মুখে ভাব বিনিময় করতেন আমাদের সবার সঙ্গে। ওঁর ছেলে অর্থাৎ আমার স্বামী গৌতমকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করতেন। আমরাও ওঁকে প্রণাম করতাম। সবাই মিলে পালন করতাম ওঁর জন্মদিন। আমাদের আয়োজন দেখে উনি খুব খুশি হতেন। চোখে মুখে তার প্রকাশ ঘটত।
কী কী রান্না হত? সুমনাদেবী জানালেন, আমার শাশুড়ি-মা সকাল থেকে ব্যস্ত থাকতেন। রান্নাঘরে নিজের হাতে রাঁধতেন স্বামীর পছন্দের পদ। ভাত, পাঁচ রকমের ভাজাভুজি, পোনা মাছের কালিয়া, চিংড়ি, ইলিশ মাছের আইটেম, পায়েস ইত্যাদি। বাড়ি থেকে ওঁকে উপহার দেওয়া হত পায়জামা, পাঞ্জাবি। শাশুড়ি-মা নিজের হাতে তুলে দিতেন উপহার। শ্বশুরমশাই আসতেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে।
আরও পড়ুন-হোয়াটসঅ্যাপে হবে সমাধান
মনে পড়ছে, এক বছর আমি আমার শ্বশুরমশায়ের জন্মদিনে ভেটকি মাছের একটি আইটেম বানিয়ে ছিলাম। সেটা খেয়ে উনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আসলে আমার শাশুড়ি-মা আমাকে খুব একটা রান্নাঘরে যেতে দিতেন না। বলা ভাল, প্রয়োজন পড়ত না। ছিল রান্নার লোক। জন্মদিনে বাইরের লোকজন খুব একটা আসতেন না। আমরা পরিবারের সদস্য-সদস্যারাই ওঁকে ঘিরে আনন্দ করতাম। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্য সংখ্যা তখন অনেক। আনন্দ উৎসবে যোগ দিতেন সবাই। দিনের পাশাপাশি সেলিব্রেশন হত রাতেও। কাটা হত কেক। এইভাবে কাটত সারাদিন।
আরও পড়ুন-জলের অপচয় রুখতে পাইপে বসছে মিটার
মহানায়কের আর এক পুত্রবধূ মহুয়া চট্টোপাধ্যায়। কথা হল তাঁর সঙ্গেও। খুব ছোট থেকেই উত্তমকুমারের জন্মদিন উদযাপনের সাক্ষী তিনি। জানালেন, আমার বাবা ডাঃ লালমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন মহানায়কের বন্ধু এবং ব্যক্তিগত চিকিৎসক। ৩ সেপ্টেম্বর উত্তমকুমারের জন্মদিন পালিত হত উৎসবের মেজাজে। ছোটবেলার স্মৃতি ফিকে হয়ে যায়নি আমার। মনে পড়ছে, বাবার হাত ধরে যেতাম ওঁদের বাড়িতে। দেখতাম, সকালে গৌরীদেবী নিজের হাতে রান্না করতেন। পাঁচ রকমের ভাজা, মাছ, পায়েস ইত্যাদি। খাঁটি বাঙালি রান্না। যা উনি পছন্দ করতেন। মহানায়ক খেতে এবং খাওয়াতে খুব ভালবাসতেন। তবে আহার করতেন পরিমিত। দিনেরবেলায় যা কিছু হত পুরোটাই বাঙালি মতে। নিজে পরতেন ধুতি-পাঞ্জাবি। মুখে লেগে থাকত অতি-বিখ্যাত ভুবন ভুলানো হাসি।
আরও পড়ুন-শিলিগুড়িতে নজরদারি প্রকল্প, শহরে ১০০ সিসিটিভি ক্যামেরা, মাদকাসক্তদের জন্য নবজীবন
সন্ধেবেলায় কাটা হত কেক। আসতেন আত্মীয় পরিজন, বন্ধু-বান্ধব এবং ইন্ডাস্ট্রির লোকজন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কেও দেখেছি। প্রায় একশ-দেড়শো মানুষ জড়ো হতেন। বসত গানবাজনার আসর। রাতের মেনুতে থাকত পোলাও, ফিস ফ্রাই, কাবাব, দই পোনা, মাছের কালিয়া, চিংড়ির বল, মাংস ইত্যাদি। মহানায়ক মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করতেন। বিশেষত পান্তুয়া, রসগোল্লা। সকালে ধুতি-পাঞ্জাবির বাঙালিবাবু রাতে পুরোপুরি সাহেব হয়ে যেতেন। পরতেন প্যান্ট-শার্ট।
নিমন্ত্রণের সময় উনি অতিথিদের বলতেন, কেউ যেন উপহার না আনে। যদি আনতেই হয়, শুধুমাত্র ফুল।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের উপেক্ষা কাটোয়ার সারমেয় গবেষককে
কোনও বিশেষ স্মৃতি? মহুয়াদেবী স্মরণ করলেন, একবার ওঁর জন্মদিনে কলকাতায় তুমুল বৃষ্টি নেমেছিল। রাস্তাঘাটে জমে গিয়েছিল জল। অতিথিরা কেউই প্রায় আসতে পারেননি। সেদিন শুটিং সেরে বৃষ্টি মাথায় বাড়িতে ফিরেছিলেন মহানায়ক। চট্টোপাধ্যায়ের পরিবারের সদস্যদের নিয়েই দিনটা পালন করা হয়েছিল। পরিবারের সদস্য-সংখ্যার সংখ্যা কিন্তু খুব কম নয়। বাড়ির লাগোয়া আরও অনেক বাড়ি। সবাই মিলে মেতে উঠেছিলেন আনন্দে।
মহুয়াদেবীর সংযোজন, মহানায়কের পাশাপাশি বাড়িতে গৌরীদেবী এবং গৌতমের জন্মদিনও জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হত। মহানায়ক নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু তদারকি করতেন।
আরও পড়ুন-শিলিগুড়িতে নজরদারি প্রকল্প, শহরে ১০০ সিসিটিভি ক্যামেরা, মাদকাসক্তদের জন্য নবজীবন
উত্তমকুমারের জন্মদিন এখন কীভাবে পালন করা হয়? মহুয়াদেবী বললেন, এখন ওঁর জন্মদিনে বাড়িতে বিশেষ কিছু হয় না। খুলে রাখা হয় দরজা। অনেক মানুষ আসেন। একটি ঘরে সাজানো থাকে মহানায়কের ছবি। পরানো হয় মালা। ভক্তরা এসে শ্রদ্ধা জানান। ছবির সামনে প্রণাম করেন। কেউ কেউ এসে চুপচাপ বসে থাকেন। কেউ ওঁর সিনেমার গান করেন। একটার পর একটা গান গেয়ে যান আপনমনে। আসেন বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। কেউ কেউ বসে ওর ছবি আঁকেন।
আরও পড়ুন-প্রযোজক ও পরিচালক উত্তমকুমার
৪২ বছর হল মহানায়ক নেই। তবু তিনি আছেন স্বমহিমায়। বাঙালি দর্শকদের হৃদয় জুড়ে। আজ রেডিও, টেলিভিশনে শোনানো হবে তাঁর গান, কোনও কোনও চ্যানেলে দেখানো হবে তাঁর ছবি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় স্মরণ করা হবে তাঁকে। এইভাবেই ধীরে ধীরে পেরিয়ে যাবে তাঁর ৯৬।