দেবাশিস পাঠক: বিদ্রোহের গনগনে আঁচকে বলিষ্ঠ ভাষার আঁচড়ে প্রকাশ করা সহজ কথা নয়। বিশেষত যদি সেই কাজে সরিয়ে রাখতে হয় ব্যক্তিগত ভাল-লাগা, মন্দ-লাগাকে। নিজস্ব আবেগের জাহির-যাপনকে দমিয়ে রাখতে হয় প্রতি মুহূর্তে।
কিন্তু এই কঠিন কাজটিই সাবলীল সহজিয়া ভঙ্গিতে করেছেন অধ্যাপক ড. দেবনারায়ণ সরকার। তাঁর ‘ভারতের তিনশত বছরের কৃষক বিদ্রোহ ও প্রাতিষ্ঠানিক উপেক্ষা’ নামাঙ্কিত গ্রন্থটিতে।
আরও পড়ুন-ময়দানের মহীরুহ
বইটির শুরু হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইতিহাস দিয়ে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও তৎপরবর্তী প্রহরে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রয়োগ দিয়ে এই বইয়ের শুরু। মন্বন্তর-উত্তর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তেই যে উপপ্লবের বীজতলা তৈরি হয়েছিল, সেকথা লেখক তুলে ধরেছেন মাস্টারমশাই সুলভ মুনশিয়ানায়। একাধিক কৃষক বিদ্রোহের কথা ছাত্রপাঠ্য ইতিহাস বইতে থাকলেও নরহর চৌধুরী বা নরহরি চৌধুরীর মতো ঘাতক জমিদারদের কথা সাধারণত স্কুলবেলায় বাংলার ছাত্রছাত্রীরা জানতেই পারে না। দেবনারায়ণ আমাদের এ বিষয়ে আগ্রহী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। একইভাবে ত্রিপুরার সমশের গাজির বিদ্রোহ, চট্টগ্রামে চাকমা বিদ্রোহ, শান্তিপুরের তাঁতিদের সংগ্রাম, রংপুরে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই, এসবকিছুই সাবলীল ঢঙে বর্ণিত হয়েছে। এসবের মধ্যে দেবী সিংহ ছিলেন দেবী চৌধুরানির সমসামরিক। দেবী চৌধুরানি ছিলেন কৃষক-দরদি। দেবী সিংহ তদ্-বিপরীত। খাজনা না পেলে তিনি পাইকদের নিয়ে চাষিদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালাতেন। আঙুলে দড়ি বেঁধে ক্রমাগত পাক দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। চাষিরা যন্ত্রণায় কাতরাত। তখন হাতুড়ির বাড়ি মেরে তাদের আঙুলের ছাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া হত। মেয়েদের জন্য ছিল অন্য ব্যবস্থা। তাঁদের বিবস্ত্র করে বেতের বাড়ি মারা হত। তারপর তাঁদের চোটগুলো মশালের আগুন দিয়ে পোড়ানো হত। উলঙ্গ রমণীর কাতর চিৎকারে নরপশুদের উল্লাস বৃদ্ধি পেত।
আরও পড়ুন-কোন অধিকারে তদন্ত? ইডি নিরুত্তর বিচারপতির প্রশ্নে
আজকাল যাঁরা হিন্দু সামন্তপ্রভুদের ঔদার্য আর মুসলমান পিরদের সাম্প্রদায়িক অন্ধত্ব নিয়ে নানা কথা বলেন, আলোচনা করেন এবং সেসবের মধ্যে বঙ্গজীবনে বহু কালাগত সাম্প্রদায়িকতার শিকড়ের খোঁজে সময় নষ্ট করেন, তাঁদের জন্য এই বইতে একাধিক চমকপ্রদ তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। কৃষ্ণদেব রায়ের মতো জমিদাররা মুসলমানদের দাড়ির ওপর কর ধার্য করেছিলেন। মুসলমানদের নামাজ পাঠের জায়গাটা পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। দারোগা রামরাম চক্রবর্তী রিপোর্ট দিলেন, কৃষ্ণদেবকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তিতুমিরের লোকজনই ওই নামাজ-ঘরটি পুড়িয়ে দিয়েছে। গুজরাত দাঙ্গায় এমনকী সম্প্রতি নুহতেও এরকম বহুবিধ অজুহাত প্রদর্শিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন-প্রশাসনে স্বচ্ছতার লক্ষ্যে বিজয়ীদের অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করাচ্ছে তৃণমূল
এরপর বিশ শতকের কথা। সেখানে নকশাল বাড়ি আন্দোলনের ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, সেকথা জানাতেও লেখক ভোলেননি। তবে নকশাল আন্দোলন-কেন্দ্রিক উপন্যাসের তালিকায় ‘গড অব স্মল থিংস’ থেকে শুরু করে মানব চক্রবর্তীর ‘কুশ’ পর্যন্ত নানা উপন্যাস উল্লিখিত হলেও অশোককুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘আট-নটার সূর্য’ এই তালিকায় কেন বাদ পড়ে গেল, সে-প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই গেল।
একুশ শতকের কৃষক আন্দোলনের কথা মানে আমাদের চেনা সময়ের অ্যালবাম। সেখানে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম তো রয়েইছে, রয়েছে সাম্প্রতিক অতীতে কৃষি আইন প্রণয়ন ও কৃষক বিদ্রোহের চাপে সেগুলো প্রত্যাহারের প্রসঙ্গও। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ১৯ নভেম্বর, ২০২১-এ নরেন্দ্র মোদি বেতার ভাষণে কৃষি আইন প্রবর্তনের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এটা যেমন সত্য তেমনই ওই আইন প্রবর্তন করে কোনও ভুল তিনি করেছিলেন, এমন কথা একবারের জন্যও বলেননি। বরং বলেছেন, প্রদীপের আলোতুল্য কিছু সত্যি কথা সরকার চাষিভাইদের বোঝাতে পারেনি বলেই কৃষি আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে তারা। তাই “বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার পুনরায় তার ক্ষমতা সুদৃঢ় করতে পারলে আগামীতে এই আইন আরও সুদৃঢ়ভাবে প্রবর্তনের সম্ভাবনা রয়েই গেল।” সে-কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন গ্রন্থকার।
আরও পড়ুন-জোড়া গোল, সুপার সিক্স প্রায় নিশ্চিত লাল-হলুদের
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায় যদি ভারতের ইতিহাসের অংশ হয় তবে দ্বিতীয় অধ্যায় পুরোপুরি ভারতীয় অর্থনীতির অঙ্গন। ইতিহাস ও অর্থনীতিতে আগ্রহী যেকোনও পড়ুয়ার কাছে এই গ্রন্থ একটি জরুরি উপস্থাপনা, একথা বলেই বক্ষ্যমান আলোচনায় ইতি টানা যেত।
কিন্তু মূলত চারটি কারণে তা যাচ্ছে না।
এডওয়ার্ড হ্যালেট কার, ইতিহাস কী, কিংবা কাকে বলে ইতিহাস, সেই আলোচনা প্রসঙ্গে নির্দ্বিধভাবে বলেছেন, “History is a long struggle of man, by exercise of his reason, to understand his environment and to act upon it.” কিন্তু “Man now seeks to understand, and act on, not only his environment, but himself, and this has added, so to speak, a new dimension to reason and a new dimension to history.”
ইতিহাসের এই নতুন মাত্রা আলোচ্য বইটির প্রথম অধ্যায়ের প্রতিটি খাঁজে উজ্জ্বল।
আরও পড়ুন-হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন অভিনেতা পবন
হ্যালেট কার আরও একটি কথা বলতেন। জেলের মুনশিয়ানা তার মাছ ধরায়। কিন্তু তথ্য সংগ্রহ করলেই ইতিহাসবিদ তাঁর মুনশিয়ানার প্রমাণ দিতে পারেন না। তাঁর মুনশিয়ানার প্রকাশ সংগৃহীত তথ্যাদির আকর্ষক উপস্থাপনায়।
“The historian collects them (the facts), takes them home, and cooks and serves them in whatever style appeals to him.” অর্থাৎ, ইতিহাসবিদের সার্থকতা কেবল মৎস্য শিকারির সাফল্যের সঙ্গে উপমিত হতে পারে না। তার সঙ্গে অন্বিত রন্ধনকুশলীর কৃতিত্ব ও পরিবেশনকারীর মনোজ্ঞতা।
দেবনারায়ণ সরকারের উপস্থাপন-ভঙ্গির মঞ্জুষা এই বক্তব্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে বইটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আরও পড়ুন-মোদি সরকারের দ্বিচারিতা, বিপন্ন বাংলার শিক্ষিত যৌবন
নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট সোলো একদা প্রশ্ন তুলেছিলেন, “Why does a public discussion of economic policy so often show the abysmal ignorance of the participants?”
সেই অতলস্পর্শী অজ্ঞতা, ভারতীয় অর্থনীতির বিষয়ে সাধারণের জ্ঞানাভাব মোচন করবে এই বই, সেকথা জোর দিয়ে বলা যায়।
অ্যালডাস হাক্সলি বলতেন, উপেক্ষিত বা অবজ্ঞাত হচ্ছে বলেই বিষয়গুলো উবে যাচ্ছে না। Facts do not case to exist because they are ignored.
উপেক্ষিত, অবজ্ঞাত, সাধারণভাবে অনালোচিত ও অনালোকিত বিষয়গুলো তুলে ধরেছে বলেই এই বইকে অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থাদির তালিকায় রাখা উচিত। এখানে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়, তথ্যের পত্রাবলির ভেতর দিয়ে ঝরে পড়েছে জীবনের রোদ আর চেতনার বৃষ্টি।