বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য, ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, আধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র, বাস্তবচেতনা এবং প্রগতিচেতনা অত্যন্ত সুদৃঢ়। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক দর্শন অত্যন্ত জটিল ও উচ্চতর। সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করলেও তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী নেতৃবর্গকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতায় কবির প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ ও পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিবরণী থেকে জানা যায় যে রবীন্দ্রনাথ ‘গদর ষড়যন্ত্রে’র কথা শুধু জানতেনই না, বরং এই ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। আবার ১৯২৫ সালে একটা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনকে ‘চরকা-সংস্কৃতি’ বলে বিদ্রুপ করে কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেছিলেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কবির চোখে ছিল—
‘‘আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক উপসর্গ।”
এই কারণে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে তিনি বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ভারতবাসীকে অন্ধ বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে বাস্তবসম্মত উপযোগী দৃঢ় ও প্রগতিশীল শিক্ষার পন্থা গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জানলে অনেকেই অবাক হবেন যে, রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) রাজনৈতিক মতাদর্শ অনেককেই বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল এবং ১৯১৬ সালের শেষদিকে সানফ্রান্সিসকোয় একটা হোটেলে অবস্থানকালে একদল চরমপন্থী বিপ্লবী তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ হওয়ায় এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার দিশা প্রকৃতপক্ষে ঠিক কী ছিল তা আজও অজানা। একদিকে তিনি হিংসাত্মক পন্থার অভিভাবক সুলভ সমালোচক ছিলেন, আবার তার চেয়েও বেশি তাঁর লেখায় ও কাজকর্মে অতি স্পষ্টভাবে বারংবার পরিস্ফুট হয়েছে ওই দুঃসাহসী তরুণদের প্রতি তাঁর গভীর টান এবং সেটাও সেই একই অভিভাবকসুলভ।
‘ঘরে বাইরে’ ও ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যথাক্রমে সন্দীপ ও ইন্দ্রনাথের সক্রিয় উগ্রপন্থী রাজনীতির বিপক্ষে ছিলেন। পক্ষান্তরে ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরার অতি সক্রিয়তাকে কবি সমর্থন করেছিলেন। আবার ‘রক্তকরবী’র রঞ্জন ও নন্দিনী, ‘মুক্তধারা’র অভিজিৎ, ‘তাসের দেশে’র রাজপুত্র এদের দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেম ভেঙে অর্থাৎ রাজন্যদের একনায়কতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অহিংস পথে জনগণকে একত্রিত করে সমস্ত অন্যায় নিয়মকানুন ও অচলায়তন ভেঙে সমাজবদলের জয়গান করেছেন।
আরও পড়ুন: পাগলির সঙ্গে ঘর করলেন দশ বছর!
‘তাসের দেশ’ গীতিনাট্য রবীন্দ্রনাথ অনুজপ্রতিম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে উৎসর্গ করেছিলেন। কারণ সেই সময় ভারতবর্ষে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতা ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তাসের দেশ নাটকের শুরু একটা গান দিয়ে —
‘‘তুমি কষে ধরো হাল,
আমি তুলে বাঁধি পাল…”
এই গানটার মধ্যে দিয়ে কবি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেম ভেঙে বৃহৎ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে আহ্বান করেছিলেন। গানটায় প্রকৃতির যে ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়ের কথা বলা হয়েছে, তাকে যদি ভারতবর্ষের সেই সময়ের সমাজ ধরে নিই, তাহলে সেই সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতি-ধর্ম-লিঙ্গ ভুলে সবাইকে একত্রিত করে লড়াই করতে তিনি বলেছিলেন এবং সেই লড়াই অবশ্যই সমাজ থেকে, সিস্টেমের মাধ্যমে সিস্টেম ভাঙার লড়াই।
ব্যক্তিগত জীবনে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও, জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে মাঝেমধ্যে অংশগ্রহণ করতেন এবং নিজের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করতেন। কখনও-বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পথেও নামতেন। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের সময় কবি প্রচুর স্বদেশি দেশাত্মবোধক কবিতা ও গান রচনা করছিলেন এবং পথে পথে ঘুরে ঘুরে সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলেন। সেই সময় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা লেখা থেকে জানা যায়—
‘‘রবিকাকা বললেন রাখীবন্ধন করতে হবে। ঠিক হল সকালবেলা গঙ্গায় স্নান করে সবার হাতে রাখী পরানো হবে। সামনেই জগন্নাথ ঘাট, সেখানেই যাব। রবিকাকা বললেন সবাই হেঁটেই যাবো, গাড়িঘোড়া নয়। এদিকে সকালে রাস্তার দু’ ধারে বাড়ির ছাদ থেকে আরম্ভ করে ফুটপাত অবধি লোক দাঁড়িয়ে গেছে, মেয়েরা ফুল ছড়াচ্ছে, শাঁখ বাজাচ্ছে। দিনু গান গাইছে— ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল…।’ স্নান সারা হল। সঙ্গে ছিল একগাদা রাখী। হাতের কাছে ছেলে মেয়ে যারা ছিল কেউ বাদ পড়ল না, সবাইকে পরানো হল। পাথুরেঘাটা দিয়ে আসছি, দেখি বীরু মল্লিকের আস্তাবলে কতোগুলো সহিস ঘোড়া মলছে। হঠাৎ রবিকাকা ধাঁ করে বেঁকে গিয়ে ওদের হাতে রাখী পরিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। ওরা সকলেই মুসলমান। ওরা তো হতবাক।”
এই হল আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি অনায়াসে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বমানবতার প্রতীক।
আবার মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর। অনেকাংশে কবি গান্ধীজির স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাকে সমর্থন করতেন না। আবার তিনি প্রায়ই বলতেন, যে মানুষটার ডাকে দেশের সিংহভাগ মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করে না আর যাইহোক সেই মানুষটার মধ্যে একটা শক্তি আছে যাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি এই শক্তিকে শ্রদ্ধা করি। তাই তো তিনি গান্ধীজিকে ‘মহাত্মা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। গান্ধীজির অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনকে কবি কখনও সমর্থন করেছেন। আবার অসহযোগ আন্দোলনের একটা পর্যায়ে মহাত্মা গান্ধীকে লেখা খোলা চিঠিতে অহিংস আন্দোলন সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছিলেন—
‘‘আপনার শিক্ষা বিধাতার সাহায্য নিয়ে অহিংসার পথে লড়াইয়ের শিক্ষা। কিন্তু, এমন লড়াই শুধু নায়কদের জন্য সম্ভবপর, সাধারণের জন্য নয়। সাধারণ মানুষ মুহূর্তের উন্মাদনায় উদ্দীপ্ত হয় বারবার। তাই, অন্যায়ভাবে সে উদ্যম প্রতিহত হলে অপমানজনক সন্ত্রাস আর হিংসা সহজেই সেই লড়াইয়ের পথ হয়ে উঠতে পারে।”
মজার ব্যাপার মহাত্মা গান্ধী ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কাজের ও দর্শনের আকাশ-পাতাল ব্যবধান থাকলেও, উভয়ই উভয়ের দর্শনকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন।
১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড রবীন্দ্রনাথকে মর্মান্তিক আঘাত করেছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদে কবি মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে সেই সময় পাঞ্জাব প্রদেশে নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ঢুকতে চেয়েছিলেন কিন্তু গান্ধীজি রাজি হননি। আবার কলকাতায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে অনুরোধ করেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করার জন্য। প্রত্যুত্তরে চিত্তরঞ্জন দাশ জানিয়েছিলেন যে, তিনি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে দেবেন কিন্তু কবিকে একাই বক্তব্য রাখতে হবে। ফলে এই অবাস্তব চিন্তাভাবনা থেকে সরে এসে রবীন্দ্রনাথ একাই নিজের মতো করে এই নৃশংস হত্যালীলার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ঘটনার প্রতিবাদে, ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বড়লার্ট লর্ড চেমসফোর্ডকে লেখা চিঠিতে কবি জানালেন—
‘‘আমার এই প্রতিবাদ আমার আতঙ্কিত দেশবাসীর মৌনযন্ত্রণার অভিব্যক্তি।”
অস্পৃশ্যদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গান্ধীজি ও আম্বেদকরের মধ্যে যে বিরোধের সূত্রপাত হয় তার সমাধানে রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ফলে গান্ধীজিও তাঁর ‘আমরণ’ অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কবির ‘‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য” কবিতা ও ‘‘একলা চলো রে” গানটি গান্ধীজির বিশেষ প্রিয় ছিল। বিশেষ করে ‘‘একলা চলো রে…” গানটি মহাত্মা গান্ধীকে প্রবলভাবে অনুপ্রেরণা জোগাত।
আগেই বলেছি রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দিশা অর্থাৎ দর্শন প্রকৃতপক্ষে কোনদিকে তা বোঝা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কবি স্বদেশপ্রেমী হলেও কখনও উগ্র সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না, তা তিনি বহু লেখনীর মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। কিন্তু জানলে অবাক হবেন বহু নামীদামি সশস্ত্র বিপ্লবীদের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে আনাগোনা ছিল। তবে খুব কম লোকই এ-কথা জানতেন। সুরেন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ এই দুই ভাইয়ের কাছে এঁরা আসতেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ। এছাড়া রাসবিহারী বসু, উল্লাসকর দত্ত, বটুকেশ্বর দত্ত এবং আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই আসতেন ঠাকুরবাড়িতে। অনুশীলন সমিতির আদি পর্বের বিশিষ্ট কর্মী বিপ্লবী অবিনাশচন্দ্র নিজে ঠাকুরবাড়িতে এসে মাসে মাসে টাকা নিয়ে যেতেন। রিভলভার ও অন্যান্য অস্ত্র কেনার টাকাও আসত ঠাকুরবাড়ি থেকে। পরবর্তীকালে সোমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে যোগাযোগ সূত্রে কমিউনিস্ট নেতা মুজফফর আহমেদ, আব্দুল হালিম, নলিনী গুপ্ত প্রমুখ প্রায়শই ঠাকুরবাড়ি আসতেন। শোনা যায় ঠাকুরবাড়ির একতলায় একটা গোপন ঘরে রীতিমতো তাঁরা সকলে গুপ্ত মিটিং করতেন। এই সমস্ত খবর রবীন্দ্রনাথ জানতেন এবং অনেক সময় এঁদের সঙ্গে আলাপ আলোচনাও করতেন। আসলে বিপ্লব বা বিপ্লবীর আটপৌরে সংজ্ঞা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ কিছু কম ছিলেন না—
এ যেন এক অন্য রবি, যে রবি বিপ্লবী।