পম্প ডিজিজ

কোনও রোগই আর দুরারোগ্য নয়, ঠিক তেমনই পম্প ডিজিজ। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সঙ্গে উন্নত উৎসেচক প্রতিস্থাপন প্রযুক্তির মাধ্যমে সেরে উঠছেন এই বিরল রোগীরা। লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ।

Must read

পটভূমি
মানবদেহে মিষ্টি বলতে বোঝায় সুগার বা গ্লুকোজ, এই গ্লুকোজই শরীরে শক্তির জোগান দেয়, দেহে গ্লুকোজ খাদ্যশর্করা বা কার্বোহাইড্রেটের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে। প্রয়োজনীয় গ্লুকোজ ব্যবহৃত হওয়ার পর অতিরিক্ত গ্লুকোজ যৌগিক আকারে ‘গ্লাইকোজেন’ রূপে মানবদেহের স্কেলিট্যাল মাসল্ বা কঙ্কাল পেশি এবং লিভার বা যকৃতে সঞ্চিত থাকে। গ্লাইকোজেন-ই হল আমাদের শরীরে সঞ্চিত সুগারের কঠিন এবং যৌগিক রূপ। তাৎপর্যপূর্ণভাবে পম্প ডিজিজ হল এমন একটি বংশগত রোগ যার ফলে গ্লাইকোজেনের বিপাক ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কোষের মধ্যে মিষ্টি বা সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে কোষ তার নির্দিষ্ট কাঠামো বজায় রাখতে না পেরে ভেঙে যায়, এভাবেই আক্রান্ত কোষ, কলা এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ে। তবে রোগ চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু হলে অনেকক্ষেত্রেই এই রোগের কিছুটা হলেও নিরাময় সম্ভব, আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক দিন সুস্থ থাকেন।

আরও পড়ুন-রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, পরবর্তীতে স্বচ্ছভাবে শিক্ষক নিয়োগ হবে: ব্রাত্য বসু

রোগ রসায়ন
আমাদের শরীরের মধ্যে গৃহীত অতিরিক্ত গ্লুকোজ থেকে গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত হয় ‘গ্লাইকোজেনেসিস’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আবার শরীরের অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন মেটাতে সঞ্চিত গ্লাইক্লোজেন ‘গ্লাইকোজেনোলাইসিস’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ভেঙে গিয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। এই দুটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কোষের মধ্যে নির্দিষ্ট কতকগুলো উৎসেচকের অণুঘটনে সম্পন্ন হয়। ঠিক সেইরকম একটি প্রয়োজনীয় উৎসেচক হল ‘অ্যাসিড-আলফা-গ্লুকোসিডেজ’, যা গ্লাইকোজেনের বিপাক ক্রিয়া সম্পন্ন করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে। এটি কোষের লাইসোজোমে সংঘটিত হয়।
লাইসোজোমের ভূমিকা
লাইসোসোম বা লাইসোজোম হল এক ধরনের কোষীয় অঙ্গাণু যা সাধারণত প্রাণী কোষে পাওয়া যায়। কোষের সাইটোপ্লাজমে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট লিপো-প্রোটিন সহযোগে গঠিত মেমব্রেন দ্বারা আবৃত যে অঙ্গাণুটি নানাবিধ হাইড্রোলাইটিক উৎসেচকের ধারক বা বাহক হিসেবে কাজ করে তাকেই লাইসোজোম বলে। লাইসোজোমের প্রধান কাজ হল মৃত কোষ বা পুরনো লোহিত কণিকা ধ্বংস করা, সংক্রামক ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করা, তঞ্চিত রক্ত ধ্বংস করা এবং ক্যারোটিন তৈরি করা। লাইসোজোমকেই কোষের পরিচ্ছন্ন কক্ষ বলা হয়ে থাকে এবং এখানেই গ্লাইকোজেন ভেঙে শক্তি প্রদান করে। আমাদের শরীরের আন্তঃকোষীয় অঙ্গাণু লাইসোজোমের মধ্যে ওই নির্দিষ্ট উৎসেচকটি তার কাজ করে। ওই উৎসেকটির একেবারেই অনুপস্থিতি কিংবা আংশিক উপস্থিতিই এই রোগের কারণ।

আরও পড়ুন-১৯–এ উনিশের বদলা

গুণসূত্রের প্রবাহ
আক্রান্তের দেহে একটি নির্দিষ্ট অটোজোমের পরিব্যক্তির কারণে ‘অ্যাসিড-আলফা-গ্লুকোসিডেজ’ উৎসেকটির পরিমাণ কমে যায় এবং কখনও কখনও একবারেই অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। তাই বিরল ব্যাধি ‘পম্প’ অবশ্যই একটি জিনগত সমস্যা, এবং বাবা ও মা উভয়ই যখন ওই নির্দিষ্ট পরিব্যক্তির জিনের বাহক তখনই তাঁদের অপত্যরা এই রোগে আক্রান্ত। অনেক সময়ই মা-বাবার দেহে কোনওপ্রকার লক্ষণ দেখা দেয় না, তবুও সন্তানদের মধ্যে এই রোগ ফুটে ওঠে।
রোগের পরিভাষা
পম্প যেহেতু একটি অম্ল-শর্করা উৎসেচকধর্মী রোগ তাই একে অনেকসময়ই ‘অ্যাসিড-মল্টেজ ডিজিজ’ নামেও চিহ্নিত করা হয়। আবার এই রোগটি কোষে গ্লাইকোজেনের সঞ্চয় বা অনিয়ন্ত্রিত সঞ্চয়জনিত, তাই চিকিৎসা শাস্ত্রে এর নাম অনেক ক্ষেত্রেই একটি ‘গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ’। বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রায় ১৯ প্রকারের গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ্ দেখা যায়; পম্প ডিজিজ হন টাইপ-II প্রকারের। এই রোগটির মূল উৎসস্থল হল লাইসোজোম, এখানেই মাত্রাতিরিক্ত গ্লাইকোজেন জমা হয়ে পড়ে, তাই অনেকেই একে একটি ‘লাইসোজোম স্টোরেজ ডিজিজ্’ও বলে থাকেন।

আরও পড়ুন-ওড়িশায় দুর্ঘটনার কবলে কলকাতাগামী বাস, মৃ.ত ৫, আহত ৪০, শোকপ্রকাশ বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর

রোগের স্বরূপ
আমাদের শরীরে ওই নির্দিষ্ট উৎসেচকের উপস্থিতির হার অনুযায়ী রোগটি আক্রমণের সময়কাল ও তার তীব্রতা নির্ধারিত হয়। প্রথমত, অ্যাসিড-আলফা-গ্লুকোসিডেজ নামক উৎসেকটির পূর্ণ বা নিকট-পূর্ণ অনুপস্থিতির জন্য শিশুশ্রেণির মধ্যে পম্প দেখা দেয়। জন্মপরবর্তী সময় থেকেই বাচ্চার দেহে ফুটে ওঠে রোগের স্পষ্ট চিহ্ন। আক্রান্তের শরীরের মাংসপেশিগুলো শিথিল হয়ে পড়ে, হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, হৃৎপিণ্ড, যকৃত ও এমনকী জিহ্বা আকারে বেড়ে যায়, খাদ্যগ্রহণ করতে অসুবিধা হয়, দুর্বলতা, কাঁপুনি, ঝিমুনি, মাথা ভার, ঘাম ও এমনকী দেহ ঠান্ডা হয়ে যায়, মারাত্মক পর্যায়ে ওজন কমে যায় এবং রোগীর মৃত্যু হয়। দ্বিতীয়ত, ওই নির্দিষ্ট উৎসেচকটির আংশিক উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির দরুন আমাদের দেহে একটু দেরিতে এই রোগের প্রভাব দেখা যায়। জন্মের পর দশ বছরের মধ্যে কিংবা তারপরে, কৈশোর পূর্ববর্তী কিংবা প্রাপ্তবয়স্কে এই রোগ অনেকসময় হানা দেয়। রোগীর দেহের কঙ্কাল পেশি ও নানা অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে পড়ে, শ্বাসতন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করে না, তীব্র ক্ষুধা অনুভব করে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, ত্বকের রং বিবর্ণ হয়ে পড়ে, মাথা ভারহীন মনে হয়, মনোযোগ ও চিন্তাভাবনা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, এবং অনেক সময় মারাত্মকভাবে রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হৃদযন্ত্র অকেজো হয়ে যায় এবং রোগীর মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন-তৃণমূলনেত্রীকে টার্গেট করতেই সন্দেশখালি-চিত্রনাট্য, দাবি টিকায়েতের

আশার আলো
সমগ্র ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীর মধ্যে প্রায় ৭-৮ হাজার বিরল রোগের দেখা পাওয়া যায়, তার মধ্যে পম্প অন্যতম হলেও সাম্প্রতিককালে চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তনের সাথে সাথে এই রোগের তীব্রতাও অনেক কমেছে। পম্প রোগের ক্ষেত্রে যেহেতু শরীরে গ্লাইকোজেনের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যায়, সেইজন্য ব্লাড সুগারের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। তাই আক্রান্তের শরীরের রক্ত চাপ, সুগার, কোলেস্টেরল, লিপিড প্রোফাইল, প্রস্বাব ও কিটোন পরীক্ষা, পেটের ছবি, হৃদরোগ, ফুসফুস সংক্রান্ত পরীক্ষা, এবং জেনেটিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই নির্দিষ্ট হতে হবে এই রোগের শনাক্তকরণ। সচরাচর চিকিৎসকরা এই রোগের উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা করেন, এবং কোষে উৎসেচক প্রতিস্থাপন পদ্ধতির সাহায্যে অনেক রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের কথা
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের আগে এই রোগ সম্পর্কে মানুষের কোনও সঠিক ধারণাই ছিল না। যদিও ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ডাচ চিকিৎসক জোয়ানস্ ক্যাসিয়ানাস্ পম্প আবিষ্কার করেন, এটিই প্রথম কোনও গ্লাইকোজেন স্টোরেজ ডিজিজ, মানুষ এব্যাপারে জানেন ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে যখন বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ডুভে লাইসোজোম আবিষ্কার করে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সহকর্মী বিজ্ঞানী হেনরি হার্স প্রথম উপলব্ধি করেন যে গ্লাইকোজেনের বিপাক ক্রিয়ায় লাইসোজোম উৎসেচকের ভূমিকার কথা। এরপর এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ে। পৃথিবী জুড়ে প্রায় প্রতি ৪০০০০-৩০০০০০ জনের মধ্যে একজন এই রোগে আক্রান্ত। গত ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের একবারে শেষের দিকে ভারতবর্ষের প্রথম পম্প রোগী চব্বিশ বর্ষীয়া নিধি সিরোল প্রায় কোমাচ্ছন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তাই এইসব দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে লড়তে চাই মনোবল এবং উপযোগী জনসচেতনতা।

Latest article