“ওদের জন্যে পৃথিবীতে টেকাই হল দায়
এই গরিবগুলোর জন্যে
দিন রাত্তির পথে ঘাটে ভয়ঙ্কর জ্বালায়
যেন, হয়ে উঠেছে হন্যে।”
সতীশচন্দ্র ঘটকের লেখা কবিতার কয়েকটা লাইন।
লাইনগুলো মনে পড়ে গেল বিশ্ব-দারিদ্র্যের (Poverty after Epidemic) মাঝে ভারতের বিরাটত্ব প্রত্যক্ষ করে।
করোনা অতিমারি বিশ্ব জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়েছে। সেইসঙ্গে কোটি কোটি মানুষ জীবিকা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছেন। বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই অতিমারির কারণে ২০২০ সালে বিশ্বের যত মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়েছে, তার ৮০ শতাংশই ভারতীয়।
অতিমারিজনিত আর্থিক ক্ষতির কারণে বিশ্বের প্রায় ৭ কোটি মানুষ গরিব হয়েছে। তার মধ্যে ৫.৬ কোটিই ভারতীয়।
সারা বিশ্ব জুড়ে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দারিদ্রের মাত্রা বেড়েছে। ২০১৯ সালে অতি-দরিদ্র ছিল ৮.৪ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৯.৩ শতাংশ। এর ফলে বিশ্বজোড়া দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি গত কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম ধাক্কা খেল। সবমিলিয়ে সারা বিশ্বে দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭০ কোটির বেশি। বিশ্বব্যাঙ্কের পভার্টি অ্যান্ড শেয়ার প্রসপারিটি ২০২২ : কারেক্টিং কোর্স রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের জনসংখ্যা বেশি। ফলে সারা বিশ্বের নিরিখে এদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি।
এরই পাশাপাশি আর একটি সংবাদ নজর কেড়েছে। বিশ্বব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ভারত থেকে দারিদ্র্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত সরকারি তথ্য সেভাবে পাওয়া যায়নি। ২০১১ সাল থেকেই ভারত দারিদ্র্য-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বিশ্ব জুড়ে দারিদ্র্যের আনুমানিক হিসেব তৈরির ক্ষেত্রে তা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মোদি-শাহের জমানায় তথ্য গোপন সরকারি কর্মসূচি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই কর্মসূচিরই অঙ্গ দারিদ্র্য-বিষয়ক তথ্য সঙ্গোপন। মিথ্যাচার যে সরকারের অঙ্গভূষণ, সেই সরকারের ক্ষেত্রে এসব মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া থেকে শুরু করে গরিবি সংক্রান্ত তথ্য লুকিয়ে রাখা, সব ব্যাপারেই সিদ্ধহস্ত মোদি- শাহের সরকার।
আরও পড়ুন-কম্পিউটার ও কম্পিউটিং কিছু ফিরে কথা
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, সরকারি তথ্যের অভাবের কারণে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র কনজিউমার পিরামিড হাউসহোল্ড সার্ভে (সিপিএইচএস)-এর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে তাদের। সিপিএইচএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৫.৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কবলে চলে গিয়েছে।
ভারত থেকে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব নিয়ে এর আগে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ সরব হয়েছেন। এবার বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্টে তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল।
২০১১-’১২ সালে ভারতে দারিদ্র্য নিয়ে তথ্য সামনে এনেছিল ন্যাশনাল সাম্পেল সার্ভে অফিস অফ ইন্ডিয়া। বিশ্বব্যাঙ্ক বলেছে, ২০২০ সালে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা ৫.৬ কোটি বেড়েছে। এই সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন অনুমান পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল।
২০১৭ সালে বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেবে ১৩.৬ শতাংশ মানুষের মাথা-পিছু দৈনিক আয় ছিল ১.৯০ ডলার বা ১৫৬.৩৪ টাকার কম। ২০১৯ সালে আয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দারিদ্র্যের নতুন মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়। দৈনিক আয়ের সীমা হয় ২.১৫ ডলার (১৭৭ টাকা)। এর ভিত্তিতে ২০১৮ সালে ভারতে দারিদ্র্যের হার ১১.০৯ শতাংশ থেকে কমে ২০১৯ সালে হয় ১০.০১ শতাংশ। ২০২০ সালে দারিদ্র্যের হার এখনও চূড়ান্ত করেনি বিশ্বব্যাঙ্ক।
বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট যা-ই বলুক না কেন, সত্যিটা রোজ বাজারে গেলেই টের পাচ্ছে আমজনতা। মূল্যবৃদ্ধি লাগাম ছাড়া। বেকারত্ব ক্রমবর্ধমান। রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে। হেঁশেলে আগুন। হাতে-হাতে কাজ নেই। পেটে-পেটে ভাত নেই। গরিবির (Poverty after Epidemic) পরিধি যে বাড়ছে, সেটা বলাই বাহুল্য।
কেন্দ্রের জুমলা সরকার প্রবাদ-কাহিনির উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে ঝড় সামলানোর স্টাইলে তথ্য চেপে দারিদ্র্য নিয়ে আসল ছবিটা গোপন করতে চাইছে।
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
সরকারকে সতর্ক করে দিতে তাই অনিবার্য উচ্চারণ হয়ে ওঠে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার লাইন:
“অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এড়িয়ে বাড়াও নিজেরই ক্ষতি।
ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।”