প্রাঞ্জল টাইটান

সেই দশ হাজার বছর আগে থেকে মহাকাশ নিয়ে মানুষের কল্পনার শেষ নেই। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান সেই কল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে মহাকাশ ভ্রমণ থেকে শুরু করে চন্দ্রে পদার্পণ, মঙ্গলে যন্ত্রের অবতরণ— কোনও কিছুই আর বাদ রাখেনি। সদ্য সুনিতা উইলিয়ামসের সফল মহাকাশযাত্রা শনির উপগ্রহ টাইটানে যাওয়ার অসম্ভব কল্পনাকে সম্ভব করতে উদ্বুদ্ধ করছে। লিখলেন বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ড. রামকৃষ্ণ দত্ত

Must read

ঐতিহাসিক মহাকাশ পর্যবেক্ষণ
২০১৩ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডে, মধ্যপ্রস্তর যুগের ১২টি গর্ত এবং একই সঙ্গে একটি চাপ বা বক্র রেখার সন্ধান পাওয়া গেছে। যা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ বছরের পুরনো। এটিকে সবচাইতে পুরনো চন্দ্র ক্যালেন্ডার বলে মনে করা হচ্ছে। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছরের আগে থেকে ব্যাবিলনের চন্দ্র ক্যালেন্ডারের অস্তিত্ব ঐতিহাসিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং বলা যেতে পারে, সূর্য ও চন্দ্র-সহ মানুষের মহাজাগতিক পর্যবেক্ষণ ও আকর্ষণ প্রায় দশ হাজার বছরের পুরনো।
৫০০ বছর আগে থেকে সাম্প্রতিক বিজ্ঞান
১৯৬০ সাল বা তারও আগে, প্রায় সমস্ত সাধারণ বিজ্ঞান বইয়ের প্রচ্ছদ-পাতায় একটি টেলিস্কোপের ছবি ও একটি মাইক্রোসকোপের ছবি থাকত। যন্ত্র দুটির প্রধান উপযোগিতা যথাক্রমে দূরের বস্তুকে কাছে দেখার জন্য এবং ক্ষুদ্র বস্তুকে বড় করে দেখার জন্য। এক কথায় বিশেষ ভাবে জানবার যন্ত্র। গ্যালিলিও হচ্ছেন প্রথম বৈজ্ঞানিক যিনি এই টেলিস্কোপকে মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচনের জন্য ব্যবহার করেন। বস্তুত টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পর সৌরমণ্ডল-সহ নানা মহাজাগতিক রহস্য উন্মোচন হতে শুরু করে। সূর্য, চন্দ্র, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, উল্কাপাত, ধূমকেতু-সহ সৌরমণ্ডলের অন্যান্য গ্রহের অবস্থান, চন্দ্রের মতো অন্নগ্রহের উপগ্রহ-সংখ্যা, এদের গতিবিধি, আকাশের তারা, ছায়াপথ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ইত্যাদি সম্বন্ধে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিষ্কার ধারণা হয়। নিকোলাস কোপারনিকাস ১৪৭৩- ১৫৪৩, গ্যালিলিও ১৫৬৪-১৬৪২, কেপলার ১৫৭১-১৬৩০, নিউটন ১৬৪৩-১৭২৭, রোমার ১৬৪৪-১৭১০ ইত্যাদি প্রমুখ বৈজ্ঞানিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নানা সূত্র আবিষ্কার করেন। সূর্যের সাপেক্ষে বৃহস্পতি গ্রহের বিভিন্ন অবস্থানে এর উপগ্রহগুলির গ্রহণের সময়ের তারতম্য থেকে বৈজ্ঞানিক রোমার টেলিস্কোপের সাহায্যে আলোর গতিবেগ নির্ণয় করেন। যদিও ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বৈজ্ঞানিক মাইকেলসন ২টি আট কোনা আয়না, দূরবর্তী দুটি পাহাড়ের চূড়ায় বসিয়ে, সেই আয়নার ঘূর্ণনের সাহায্যে আলোর প্রতিফলন করে আলোর গতিবেগ নির্ণয় করেন এবং নোবেল পুরস্কার পান। তাই বলা যেতে পারে আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানের ভিত্তি মোটামুটি ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে এবং টেলিস্কপের হাত ধরে। সেই জন্য আজও টেলিস্কোপ তৈরির আধুনিক সংযোজন হাবলস টেলিস্কোপ যার অবস্থান পৃথিবীর ৫১৫ কিলোমিটার উঁচু কক্ষপথে এবং মহাকাশের নানা ঘটনার ছবি তুলছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলজনিত কোনও বাধা ছাড়া।

আরও পড়ুন-দিঘায় বেজে উঠল মাঙ্গলিক সানাই, জগন্নাথধামে সকাল-সন্ধে শান্তিযজ্ঞ

সীমাবদ্ধতা
সমস্ত যন্ত্রের মতো টেলিস্কোপেরও সীমাবদ্ধতা আছে। এটি দিয়ে শুধু মহাজাগতিক বস্তুর গতি ও অবস্থান জানা যায়। কিন্তু মহাজাগতিক বস্তু কোন কোন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে গঠিত তা বোঝা যায় না। এই দুরূহ সমস্যার সমাধান করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি বিজ্ঞানী প্রফেসর মেঘনাদ সাহা। ১৯২০ সালে তার বিখ্যাত গাণিতিক আলো আয়নকরণ (ফটো আইওনিজশন) সমীকরণ। এর সাহায্যে মহাজাগতিক বস্তুর রাসায়ানিক গঠন থেকে নানা তথ্য জানা যায়। অর্থাৎ ঘরে বসে মহাবিশ্বে কোথাও জল, বরফ, অক্সিজেন ইত্যাদি রাসায়ানিক পদার্থ আছে কি না ও তার তাপমাত্রা কত ইত্যাদি অনেক জটিল তথ্য জানা যায়। বস্তুত বলা যায় আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান এই সমীকরণ ছাড়া অন্ধ। এহেন কাজের জন্য অনেক বার নোবেল কমিটিতে তাঁর কাজের মূল্যায়নের জন্য গৃহীত হয়। কিন্তু প্রত্যেক বারে, এই কাজে সরাসরি মানুষের প্রয়োজনের বাইরে বলে উপেক্ষিত হয়। (এই ব্যাপারে সমস্ত নোবেলপ্রাপ্ত কাজের যারপরনাই সম্মান জানিয়ে আলোর বেগ নির্ণয়ে নোবেল প্রাপ্তির সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করে)।
মহাকাশ যাত্রা
১৯৫৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক সাফল্যের সঙ্গে উৎক্ষেপণ ও সফলভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণের পর সমস্ত পৃথিবীতে মহাকাশ যাত্রার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এরই কিছুদিনের মধ্যে প্রথম প্রাণী হিসাবে লাইকা নামক একটি সারমেয়কে (কুকুরকে) মহাকাশে পাঠিয়ে এবং সফলভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিয়ে প্রমাণ করে মহাকাশে মানুষের পদক্ষেপ সম্ভব। ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল মহাকাশে ১০৮ মিনিটে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসে রাশিয়ার পাইলট এসট্রনোমার ইউরি গ্যাগারিন। আমেরিকাও এ-ব্যাপারে পিছিয়ে থাকেনি। নানা মহাকাশ যান উৎক্ষেপণের পর আমেরিকা থেকে অ্যাপোলো ১১ মহাকাশ জানে ১৯৬৯ চাঁদের মাটিতে প্রথম পদার্পণ করেন
মহাকাশচারী নেইল আর্মস্ট্রং। রাশিয়া থেকে চাঁদে মানুষ প্রেরণে দুর্ঘটনার পর বর্তমানে চাঁদে মানুষ প্রেরণ কিছুটা হলেও প্রতিযোগিতা কমেছে। ভারতে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ সংস্থা (ইসরো) চাঁদে উপগ্রহ পাঠানোর পর, আবার মঙ্গলেও পাঠানোর চেষ্টা হচ্ছে। আমেরিকা মঙ্গলগ্রহেও মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে, মঙ্গলের দূরত্ব চাঁদের দূরত্বের প্রায় ১৪৫ গুণ বেশি। এ ছাড়া, মঙ্গলে ভাইকিং ১ এবং ভাইকিং ২, ১৯৬৮-তে যাত্রা শুরু করে প্রায় এক বছর লেগেছিল পৌঁছতে। ১৯৭৬-এ অবতরণ করে। প্রায় ৮ বছর ছিল মঙ্গলে। তাই বর্তমান প্রযুক্তিতে মানুষ মঙ্গলে পাঠিয়ে আবার ফিরিয়ে আনা একটি চ্যালেঞ্জ। যদিও অনেক মানুষ আছেন যাঁরা চরম যাত্রার (ফিরবেন না) জন্য তৈরি। আমেরিকা থেকে নাসা দুটি খুব কম বয়সি প্রাঞ্জল অতি-বুদ্ধিমতী মেয়ে আলিশা কারসন ও জাসলিন কাউর জোসানকে ট্রেনিং দিচ্ছে মঙ্গলযাত্রার জন্য। সম্ভবত ২০৩৫ সালে এই মঙ্গলযাত্রা শুরু হবে। ওদের জন্য আগাম মঙ্গল কামনা রইল। সম্প্রতি সুনীতা উইলিয়ামসের অকল্পনীয় ৯ মাস মহাকাশ অভিযান, মঙ্গলগ্রহে পদার্পণের সাফল্যকে আরও বেশি হাতছানি দিচ্ছে। মঙ্গল গ্রহ থেকে বৃহস্পতি গ্রহ ও শনি গ্রহের দূরত্ব আরও অনেক-অনেক বেশি। আবার সূর্য থেকে আরও অনেক দূর বলে বিদ্যুৎ শক্তির জন্য সোলার সেল ব্যবহার করা যায় না।
তাই অ্যাটমিক সেল ব্যবহার করা হয়, যা অন্তত ৫০ বছর ধরে ঘণ্টায় ২৫ ওয়াট বিদ্যুৎ দিতে পারবে। কাজেই বৃহস্পতি ও উপগ্রহ সমেত শনি গ্রহের তথ্য সন্ধানে মহাকাশযান পাইওনিয়ার ১০, ১৯৭২-এ এবং পাইওনিয়ার ১১, ১৯৭৩-এ অগস্ত্য যাত্রা (আর ফিরবে না) শুরু করে সৌরমণ্ডলের বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সৌরজগৎ থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য ভয়েজার ১ এবং ভয়েজার ২, এখন থেকে প্রায় ৪৮ বছর আগে ১৯৭৭-এ প্রেরিত মহাকাশযান দুটি সৌরসংসার ত্যাগী হয়ে এখনও যাত্রা চলেছে। যাদের কাছ থেকে বেতার তরঙ্গ আসতে প্রায় কুড়ি ঘণ্টা সময় লাগে। যেমন সূর্য থেকে আলো আসতে ৮ মিনিট সময় লাগে। এদের সকলের লক্ষ্য বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ পর্যবেক্ষণ ও অতিক্রম করা, যা খুব সুন্দর ভাবে পালন করে উপগ্রহ সমেত বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বৈজ্ঞানিকদের হাতে এসে গেছে। মহাকাশযানগুলির যাত্রাসময় এত বেশি লাগার কারণ হিসাবে ইসরোর চন্দ্র অভিযানের ৪৩ দিন সময় লাগার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। যেখানে অন্যান্য দেশ ৩ দিনেই চাঁদে মহাকাশ যান পাঠিয়ে দিচ্ছে। ইসরো খুব কম শক্তিযুক্ত রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে মহাকাশ যানের আবর্তন সংখ্যা পৃথিবী এবং চাঁদের চারিদিকে বাড়িয়ে এবং কৌশলে চাঁদের আকর্ষণ শক্তি কাজে লাগানোর জন্য সময় বেশি লেগেছে। নাসাও কম শক্তি ব্যবহার করে, উপগ্রহ সমেত বৃহস্পতি ও শনি গ্রহ পর্যবেক্ষণ করে সৌরমণ্ডল অতিক্রান্ত-সহ বহির্বিশ্ব যাত্রা পথে প্রতিটি গ্রহের চারিদিকে আবর্তন সংখ্যা বাড়িয়েছে এবং প্রতিটি গ্রহের আকর্ষণ শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। এই সমস্ত মহাকাশ যান সমূহের তথ্য অনুযায়ী শনির উপগ্রহ টাইটানের বায়ুমণ্ডলের সাথে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের এক বিশেষ সাদৃশ্য পাওয়া গেছে। তাই আরও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের জন্য টাইটান ১, টাইটান ২, ক্যাসিনি ইত্যাদি মহাকাশ যানগুলি শুধুমাত্র উপগ্রহ টাইটান পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল। এদের তথ্যসমূহ পৃথিবীর সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করা হচ্ছে। এখানে মনে রাখতে হবে টাইটানের বেশির ভাগ তথ্য প্রফেসর মেঘনাদ সাহার আলো আয়নকরণ সমীকরণ ব্যবহার করে নির্ণয় করা হয়েছে।

আরও পড়ুন-বিস্ফোরণে উড়ে গেল সেনাট্রাক, বালুচ বিদ্রোহীদের হামলায় খতম ১০ পাকসেনা

টাইটানের বিভিন্ন স্তরের তথ্য
শনির গ্রহের ১৪৬ উপগ্রহ যা সৌরমণ্ডলে আর কোনও গ্রহের নেই। শনির এই ১৪৬টি উপগ্রহের মধ্যে টাইটান সবথেকে বড়। এটি বুধ গ্রহের থেকেও বড়। এই গ্রহটি আবিষ্কার করেন ক্রিস্টিয়ান হাইগেন্স, ১৬৫৫ সালে। টাইটানের ব্যাস ৫১৫০ কিলোমিটার, পৃথিবীর বাসের অর্ধেকের কাছাকাছি। পৃথিবীর উপরিতল ও অভ্যন্তরীণ গঠনের সাথে অনেক মিল আছে টাইটানের। পৃথিবীর যেমন একদম কেন্দ্রের কাছে তরল পদার্থ, ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা সূর্যের উপরিস্থলের তাপমাত্রার সমান। তারপর বিভিন্ন অপেক্ষাকৃত নিম্ন তাপমাত্রার গলিত তরল আস্তরণের পর একদম উপরিতল শক্ত মাটি ও সমুদ্র। টাইটানের ক্ষেত্রে অনেকটা সেইরকম, তবে রাসায়ানিক গঠন আলাদা এবং তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের থেকেও অনেক কম। তবে আভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা সম্বন্ধে এখনও নিখুঁতভাবে জানা যায়নি। টাইটানের একদম উপরে শক্ত পদার্থের সঙ্গে অনেক আগ্নেয়গিরির মতো মুখ (৯০টি শনাক্ত করা গেছে)। তার নিচে জালির মতো ১০ কিমি গভীরতার মিথেনের ঘন আস্তরণ। এরও নিচে বরফের আস্তরণ তারপর বরফের নিচে জলের সমুদ্র। যেহেতু প্রাণিজগতের জন্য মিথেন এবং জলের প্রয়োজন, তাই বৈজ্ঞানিকেরা টাইটানে জীবনের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ভীষণ আশাবাদী। টাইটানের তাপমাত্রা -১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো হওয়ায় জীবনের অস্তিত্ব ক্ষীণ বলে কেউ কেউ মনে করেন। আবার উপরিস্তরে মিথেনের আস্তরণের জন্য অভ্যন্তরের তাপমাত্রা বেশি হতে পারে বলেও অনেকে জীবন সম্বন্ধে আশাবাদী। তারপর ১০ কিলোমিটার নিচে বরফের আস্তরণের মতো সন্ধান পাওয়ায়, জীবনের অস্তিত্ব আরও বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ জলের ধর্ম অনুযায়ী, এই পৃথিবীতে উপরের স্তরে বরফ থাকলেও নিচে জলের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি। কেননা জলের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রির কম হলে আয়তন বেড়ে যায়। অন্য পদার্থের ধর্মের থেকে আলাদা। এটিকে জলের বাতিক্রান্ত প্রসারণ বলে। জলের এই বাতিক্রান্ত প্রসারণের জন্য সমুদ্রের ওপর বরফে পরিণত হলেও বরফের নিচের জলের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকবে। কোনও অবস্থাতে সম্পূর্ণ সমুদ্র বরফে পরিণত হবে না। যে কারণে পৃথিবীর যে সমুদ্রে উপরিস্তর সম্পূর্ণ বরফ (বিশেষ করে মেরু প্রান্তে), সেখানেও বরফের নিচে জলের মধ্যে অনায়াসে নানা জলজ উদ্ভিদ থেকে নানা প্রাণী জীবনযাপন করছে। আর টাইটানে বরফস্তরের নিচে জলস্তরের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ পাওয়া গেছে যা মানুষের কল্পনার পদক্ষেপ আরও সমৃদ্ধ করছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে কেন্দ্রের কাছে তাপমাত্রা সূর্যের উপরিস্থলের তাপমাত্রার মতো, আর তুলনামূলক ভাবে টাইটানের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ভীষণ কম হওয়াতে, কিছু কিছু বৈজ্ঞানিক মনে করছেন যে টাইটান অন্য সৌরজগতের অন্তর্গত, কোনও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিস্ফোরণের পর সৌরমণ্ডলে এসে বিশাল শনিগ্রহের আকর্ষণে বাধা পড়ে উপগ্রহের মতো ঘুরতে শুরু করে। অর্থাৎ ধারণা করা যায়, সৌরজগতের বাইরেও প্রাণ থাকতে পারে।
ভূমির উপরিস্তর বা বায়ুমণ্ডলের তথ্য
সূর্য থেকে টাইটানের দূরত্ব প্রায় দশ এ ইউ (সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বকে বলে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট : এ ইউ)। অর্থাৎ সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের দশ গুন। এই কারণে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও টাইটানের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ তিন দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর সর্বনিম্ন শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের থেকে ১৮০ ডিগ্রি কম, অর্থাৎ -১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যেমন ট্রপোস্ফিয়ার, ট্রপোপস, স্ট্রাটোস্ফিয়ার, স্ট্রাটোপাস, মেসোস্ফিয়ার, মেসোপস, থের্মোস্ফিয়ার ইত্যাদি আছে, আশ্চর্যজনক ভাবে টাইটানেও প্রায় এই রকম নানাস্তরের সন্ধান পাওয়া গেছে এবং এখনও পর্যন্ত এই স্তরগুলির একই নাম দেওয়া হয়েছে। ট্রপোস্ফিয়ারে ৯৫ শতাংশ নাইট্রোজেন গ্যাস, ৫ শতাংশ মিথেন গ্যাস। স্ট্রাটোস্ফিয়ারে ৯৮ শতাংশ নাইট্রোজেন গ্যাস, ২ শতাংশ মিথেন গ্যাস আর সামান্য হাইড্রোজেন গ্যাস। মাঝে মাঝে তরল মিথেনের বৃষ্টিপাত হয়। কারণ মিথেন গ্যাস -১৮২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তরলে পরিণত হয়। আর নাইট্রোজেন গ্যাস -২১০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তরলে পরিণত হয়। যেহেতু টাইটানের ভূমিসমতলের তাপমাত্রা -১৮০ ডিগ্রির মতো, তাই বায়ুমণ্ডল সামান্য অস্থির হয়ে ঊর্ধ্বমুখী গতি হলেই মিথেন গ্যাস তরলে পরিণত হয়ে বৃষ্টির আকারে টাইটানের মাটিতে (বৃষ্টির মতো) নেমে আসে। নাইট্রোজেন গ্যাস পৃথিবীর (৭৮%) মতো টাইটানের বায়ুমণ্ডলে থেকে যায়। টাইটানের ভূসমতলের নিচে যে জালের মতো ১০ কিলোমিটার গভীর মিথেন গ্যাসের ভাণ্ডার আছে সেগুলি নিম্ন তাপমাত্রার আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়। অর্থাৎ একটি মিথেন চক্রের সৃষ্টি হয়। নিম্ন তাপমাত্রার বৈজ্ঞানিক নাম ক্রায়োজেনিক। ভূমণ্ডলে যানচলাচলের জন্য যে ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়, সেগুলির তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের থেকে অনেক বেশি ডিগ্রি তাপমাত্রায় কর্মক্ষম। কিন্তু টাইটান (-১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তথা মহাশূন্যে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের থেকে অনেক কম। তাই মহাকাশ যান পৃথিবীর আকর্ষণের বাইরে যেতে ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন ব্যবহার করে, যেগুলিতে নাইট্রোজেন জ্বালানি হিসাবেও ব্যবহার হতে পারে। এই ঘটনা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে নিম্ন তাপমাত্রায় আগ্নেয়গিরি ঘটা সম্ভব। অক্সিজেনের অভাবে নাইট্রোজেন গ্যাস অকেজো হয়ে বায়ুমণ্ডলে থেকে যায়। নাইট্রোজেনের পারমাণবিক ভর অনেক বেশি এবং নাইট্রোজেন গ্যাসের প্রাচুর্যের কারণে টাইটানের বায়ুমণ্ডলের চাপ পৃথিবীর থেকে অনেক বেশি। প্রায় দেড়গুণ। এই একটি কারণে মানুষের কল্পনা আকাশচুম্বী। টাইটানে, অনেকটা পৃথিবীর মতো, ভূসমতলে স্পেস স্যুট-এর প্রয়োজন পড়বে না, তবে অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া চলবে না। বেলুন বা গ্যাস বেলুন ফুলিয়ে রাখা যাবে। চাঁদ যেমন ২৮ দিনে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, তেমনি উপগ্রহ টাইটান ১৬ দিনে শনি গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে। টাইটানের ভর আর অভিকর্ষজ ত্বরণ পৃথিবীর থেকে প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। পৃথিবীতে কেউ ৫ কেজি ওজন তুলতে পারলে টাইটান উপগ্রহে সে কুড়ি কেজি ওজন তুলতে পারবে। পৃথিবী থেকে কোনও বালক বা বালিকা টাইটান উপগ্রহে গেলে একেবারে সুপারবয় বা সুপারগার্ল হয়ে যাবে। ১০ ফুট উঁচু দেওয়াল অনায়াসে লাফিয়ে পেরিয়ে যাবে। নাসার ড্রাগনফ্লাই মিশন যা ২০২৮-এ যাত্রা শুরু করে ২০৩৪-এ টাইটান উপগ্রহে মহাকাশ যান নামাবে এবং কোনও দিন মানুষ যেতে পারবে কিনা সেজন্যে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাথে মহাজাগতিক শরীরবিদ্যার পর্যবেক্ষণ করবে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা থেকে শুরু করে নানা রকম রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ জানবার জন্য আবহাওয়াবিদদের রেডিও সন্দি রেডিও উইন্ড-এর মতো উলম্ব গতি বেলুন পর্যবেক্ষণ করা হবে। এখনও কল্পনার জগৎ হলেও অকল্পনীয় নয় টাইটানে পদার্পণ।

Latest article