পূর্ণেন্দু বসু: রাতভর ধর্না। সংসদের চত্বরে। কিন্তু খোলা আকাশের নিচে। গান্ধী মূর্তির কাছে। সবাই বিরোধী দলের সাংসদ। সংসদের ভেতরে যেসব অগণতান্ত্রিক কাণ্ড চলেছে, তারই বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান অধিবেশন সেদিনের মতো মুলতুবি করে দেন, কিন্তু তার আগে আটজন বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করেন। এরপর রুদ্ধকণ্ঠ-বিরোধীরা নেমে আসেন গান্ধী মূর্তির পাদদেশে। প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতে বেছে নেন ছাদহীন স্থান, তা-ও আবার সূর্যাস্তের পরও। এমন দৃশ্য এর আগের সাত দশকে এদেশ দেখেনি। প্রথম দেখল গত বছর।
আরও পড়ুন- বাচিক শিল্পী গৌরী ঘোষের প্রয়াণে মুখ্যমন্ত্রীর শোকবার্তা
সংসদকক্ষে যখন আলোচনার সুযোগ নেই, স্বৈরশাসনের শিকল যখন সেখানে পদে-পদে বাধা তৈরি করে, বিরুদ্ধমত দাবিয়ে রাখতে সাংসদদের বরখাস্ত করাটাই হয়ে ওঠে শাসকের হাতিয়ার, বিধিসম্মত সংসদীয় আলোচনার পরিসরটাকেই যখন বোবা করে দেয় তারা, তখন বিরোধীদের আর কী-ই বা করার থাকে? খোলা আকাশের নিচেই তখন প্রতিবাদ আগুন খোঁজে। প্রতিস্পর্ধী মুক্তকণ্ঠ খোঁজে অবাধ বিস্তার। শিকল ছিঁড়ে হাত খুঁজে নিতে চায় স্বাধীনতার নক্ষত্র। তাই বিরোধীরা খোলা আকাশের নিচেই রাত কাটিয়েছেন গতবছর। কিন্তু তাতেও টনক নড়ল কই? এবারের বাদল অধিবেশনেও সেই কণ্ঠরোধ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি। সেই সাসপেনশনের খাঁড়া নামিয়ে প্রতিবাদের কণ্ঠরোধের আয়োজন। সেই বিরোধী পক্ষের বলার জন্য বরাদ্দ সময়ে ব্যাপক কাটছাঁট।
আরও পড়ুন- পুরনো চুক্তিতেই আইএসএলে থাকছে ইস্টবেঙ্গল, দলগঠন নিয়ে ক্লাব কর্তারা কী বললেন ?
এক কথায়, এবারও তাবৎ অগণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্লজ্জ প্রয়োগের সাক্ষী থাকল বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের সংসদ। অথচ, এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সংবিধান অনুসারে, ভারত একটি ‘গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র’। বেন্থাম বলতেন, স্বৈরতন্ত্রের পীড়ন ও শোষণের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর অস্ত্র হল এই গণতন্ত্র। এই ব্যবস্থাই মানুষের রক্ষণমূলক এজেন্ট। তিনি মনে করতেন, গণতন্ত্রে যদি ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ না পায় তবে তার নৈতিক, মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ ব্যাহত হয়, কাঙ্ক্ষিত ‘human excellence’ অধরাই থেকে যায়।
আরও পড়ুন- বাংলার মহিলাদের “ভিখারি” সম্বোধন করে বিপাকে দিলীপ ঘোষ, হল এফআইআর
সেজন্যই সংবিধান প্রণেতারা গণতন্ত্রকেই সদ্য স্বাধীন ভারতের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আরএসএস-বিজেপি পরিচালিত সরকার তো সেসব চায় না। সেজন্যই সংসদীয় গণতন্ত্রের তাবৎ রীতিনীতিপদ্ধতি জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ। রাজ্যসভার রীতিনীতি পদ্ধতি প্রক্রিয়ার যে লিখিত রূপ আমরা পাই, তাতে স্পষ্ট লেখা আছে, ‘বিরোধীপক্ষের কর্তব্য হল বিরোধিতা করা’। যদি সরকার পক্ষ কোনওভাবে বিরোধী পক্ষের এই ভূমিকা খর্ব করতে চায়, তবে সেটা হবে দলতন্ত্রের কাছে সংসদীয় গণতন্ত্রের পরাজয় (‘It would be the clearest proof of the triumph of party spirit over parliamentary spirit if any government set out to whittle away the rights of the opposition.’)।
আরএসএস–বিজেপি-র কাছে এসবের যে কানাকড়িও মূল্য নেই, তা এবারে বাদল অধিবেশনে একেবারে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কী চেয়েছিলেন বিরোধী পক্ষের সাংসদরা? যেমন, তাঁরা কৃষি বিল নিয়ে আলোচনা চেয়েছিলেন। এই বিলগুলি প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকেরা লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকার তাঁদের সঙ্গে দশ-বারোবার আলোচনাতেও বসেছেন। কিন্তু জট কাটছে না। কারণ, কৃষকদের স্পষ্ট দাবি, ওইসব কালাবিলের আমূল প্রত্যাহার এবং তারপর সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নতুন আইন প্রণয়ন। আর সরকারের ফন্দি হল— বিল সংশোধনের ললিপপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করা। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনেই এমনটা হয়। সেখানে আইনের অনুশাসন থাকে না, গণতন্ত্রের মূল্যবোধ উপেক্ষিত হয়, জনমতের কণ্ঠ রোধ করা হয়, বিরুদ্ধমত উপেক্ষিত হয়। এবং একটি একক কর্তৃপক্ষ বা কোনও নির্দিষ্ট কোনও গোষ্ঠী রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েম করে।
আরও পড়ুন- চিনা মাঞ্জা থেকে বিপদ আটকাতে সেতুর দু’পাশে লোহার জাল
আজকের ভারতে ঠিক এইগুলোই ঘটছে। আরএসএস-বিজেপি যেন ধরেই নিয়েছে, ওরা যেহেতু নির্বাচিত সরকার পক্ষ, সেহেতু ওরা যা খুশি তাই করতে পারে। এ জন্যই সংসদের বাইরে কৃষকের কান্না কেউ শুনছে না। আর সংসদের ভেতরে বিরোধীদের বলতেই দেওয়া হচ্ছে না। বিরোধীরা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী কৃষি বিল এবং পেগাসাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংসদে আলোচনা করুন, প্রশ্নের জবাব দিন। কৃষি বিলের মতো পেগাসাসও ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে।
জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোনে যে একইভাবে আড়িপাতা হয়নি, তার কোনও গ্যারান্টি নেই। কিন্তু, এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নীরব। আর সংসদ চালানোর কাজ যাঁদের, তাঁরা সুকৌশলে এসব ইস্যুতে সরকারকে পাশ কাটিয়ে যেতে সাহায্য করছেন। এটাই আরএসএস-বিজেপি-র কর্ম-কৌশল। জরুরি অবস্থা জারি করলে নির্বাচনে কী হাল হয়, সে-শিক্ষা তাঁরা অতীত-ইতিহাস থেকে বুঝে গিয়েছেন। তাই ওই পথে না হেঁটে অন্য স্ট্র্যাটেজি নিয়েছে এই নিও-ফ্যাসিবাদী শক্তি।
এরা ভোটের সময় অন্য ভারতের স্বপ্ন দেখায়। আর ভোটে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেলে নিজেদের অ্যাজেন্ডা পূরণ করতে নেমে পড়ে। তখন ৩৭০ ধারা বিলোপ করা হয়, রামমন্দির মাথা চাড়া দেয়, মুসলমানদের অনাগরিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। ভারতের গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হলে, ভারতের সংবিধানকে বাঁচাতে গেলে তাই আজ জোট বাঁধতেই হবে। কার কোথায় কতটা শক্তি সেই নিয়ে দর-কষাকষি না করে, সবরকম সংকীর্ণ রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ দূরে সরিয়ে রেখে এখন সবার উচিত সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজে শামিল হওয়া। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের ঊর্ধে উঠে এখন ওয়ান পয়েন্ট প্রোগ্রাম হল, এই গণতন্ত্র-বিরোধী, জনবিরোধী, স্বৈরাচারী শক্তি যাতে ফের নির্বাচনে না জিততে পারে, সেটা সুনিশ্চিত করা। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস তাই ডাক দিচ্ছে, আর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে জোট বেঁধে ভোটের জন্য তৈরি হওয়াটাই এই সময়ের একমাত্র দাবি।