পরানসখা বন্ধু হে আমার

রবীন্দ্রনাথ মানে নামহীন সম্পর্ক। বাড়িয়ে দেওয়া এক বন্ধুর ভরসার হাত। তাঁর আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছেন অনেকেই। তিনিও আলোকিত হয়েছেন দেশ-বিদেশের কয়েকজন বন্ধুর আলোয়। আজ বন্ধুত্ব দিবস, বাইশে শ্রাবণ কবির প্রয়াণদিবস। দুটি দিন মনে রেখে রবীন্দ্র-বান্ধবদের কথায় চৈতালী সিনহা

Must read

ঝড়ের রাতে অভিসার হোক কিংবা মল্লিকা বনে প্রথম কলির আনন্দে, বিরহের বীণাপাণি কিংবা মিলনের মালায়, জীবন যখন ছিল ফুলের মতো কিংবা রোদন ভরা এ-বসন্তের স্মৃতি রোমন্থন— জীবনের সর্বক্ষেত্রে যাঁর পরাক্রমী উপস্থিতি তিনি বাঙালির নিভৃত প্রাণের দেবতা— রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) বাঙালির ষড়জ থেকে ধৈবত, উত্তিষ্ঠত থেকে জাগ্রত পেরিয়ে নিবোধতর পথ। রবীন্দ্রনাথ মানে পঁচিশে বৈশাখ থেকে বাইশে শ্রাবণ হয়ে আবার পঁচিশে বৈশাখের এক অনন্ত পরিক্রমা। রবীন্দ্রনাথ মানে নামহীন এক সম্পর্ক, বাড়িয়ে দেওয়া এক বন্ধুর ভরসার হাত কিংবা সংগীতের বিলাবল রাগ যার সবই শুদ্ধ স্বর। যখন অগাস্টের প্রথম রবিবার বন্ধুত্ব দিবস আর বাইশে শ্রাবণ সূর্য ডোবার পালা একই সাথে চলে আসে তখন মীড়ের মতোই আসা-যাওয়া করে বন্ধু থেকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা রবীন্দ্রনাথ থেকে বন্ধু।

কাদম্বরী দেবী

সারাজীবন লোকের বন্ধু হয়ে ওঠা মানুষটির বন্ধু কারা ছিলেন? স্বজন, আত্মীয়, পরিবারবর্গ, পরিচিতজনেরা এবং নানাবিধ শুভানুধ্যায়ী পরিবেষ্টিত ছিল মানুষটির জীবন। কিন্তু সে-জীবনে বন্ধু ছিল কে? নামহীন কিংবা সম্পর্ক হীন এক বাঁধন, ভরসা ও বিশ্বাসের বাড়ানো হাতের শক্ত মুঠো, আবেগে চোখে চোখ রেখে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বন্ধু আদৌ ছিল সে মহামানবের?
খেলতে খেলতে দেখেছিলেন বাজার সরকারের চেনা মেয়েকে নতুন সম্পর্কের নামে জড়িয়ে যেতে। বালকের শীর্ণ মুষ্টিতে শাঁখা-পলা পরা বালিকার হাত বেঁধেছিল বন্ধুত্বের শক্ত বাঁধন। সাতের বন্ধু ছুঁয়েছিল নয়ের হাত পারিপার্শ্বিক আবিলতার ঊর্ধ্বে। পুতুলের বিয়ের আয়োজন দিয়ে শুরু করে পত্রিকায় লেখা, কবিতা পাঠের মাধ্যমে এক টুকরো স্বর্গ রচনা করেছিল তারা পৃথিবীর এক কোণে। একমাতৃহারা বালককে মায়ের খোঁজে দিয়েছেন স্নেহ, বড় বৌদির দায়িত্বে যত্নে সাজিয়েছেন জলখাবার, বন্ধুত্বের টানে হয়েছেন লেখার নিখুঁত সমালোচক। জোড়াসাঁকোর তিনতলার ঘরের বাইরের ছাত-বাগানে বসেছে গানের আসর, চন্দননগরের বাগানবাড়িতে নতুন দাদার এসরাজ নতুন বউঠানের গলা মেলানোর সাথে হাইফেনের মতো রয়ে গেছেন রবি। নতুন বৌঠান রবির সকালে ভৈরবী, দুপুরের আগে সারং, দুপুরের পিলু, বিকেলে মুলতানি, সন্ধ্যায় পূরবী, রাত্রিকালে বেহাগ হয়ে বন্ধুত্বের সীমানা ছাড়িয়ে অজান্তেই মধ্যরাত্রের মালব্য ও কৌশিকের যুগলে হয়েছিলেন বন্দি। খেলা ভাঙার খেলা শুরু হল যখন চব্বিশের রবীন্দ্রনাথ বাঁধা পড়লেন নয়ের ভবতারিণীর সঙ্গে। রবির মৃণালিনী এখন নায়িকার ভূমিকায়। ‘হেথা হতে যাও পুরাতন, হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে… বালককে খেলাইছে বালিকা’। বিষাদের তন্ত্রীতে বাজে চিরবিদায়ের বাঁশি। মাত্র ছাব্বিশেই বিষে নিলেন মুক্তির আশ্রয় কাদম্বরী দেবী— রবির নতুন বৌঠান।

আন্না তড়খড়

জীবনের প্রথম বন্ধু বিয়োগের ব্যথা রবীন্দ্রনাথ বয়েছেন হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠে সারা জীবন। তার প্রকাশ এসেছে গানে, কবিতায়। ভগ্নহৃদয়, সন্ধ্যাসঙ্গীত, য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, প্রকৃতির পত্র, শৈশব সঙ্গীত, ভানু সিংহের পদাবলী, চৈতালী, মানসী-সহ নানা লেখা কবি তাঁকে উৎসর্গ করেছেন।
কবির জীবনরঙ্গে আন্নার প্রবেশ বোম্বাইয়ে। কবি তখন সবেমাত্র কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে। আন্না ছিলেন বিদুষী, বুদ্ধিমতী ও রূপলাবণ্যে ভরপুর তরুণী। বোম্বাইয়ের শেরিফ ডাঃ পাণ্ডুরঙের মেয়ে আন্না তড়খড়ের এই বন্ধুত্ব খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও বেশ তাৎপর্যময় ছিল রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) জীবনে। কবির কাছ থেকে ভালবেসে একটি ডাক নাম চেয়েছিলেন। কবি সে-নাম দিয়েছিলেন নলিনী। নলিনী নামটি খুবই প্রিয় ছিল। কবির প্রথম জীবনে রচিত বহু কাব্য, কবিতায়, নাটকে এই নাম এসেছে বহুভাবে। অনেক দিন পরও কবির সঙ্গে তাঁর পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। নলিনী নামটি রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) নানা রচনাতেই ঘুরে ফিরে এসেছে। তাঁর গানের রূপটি আবার ধরা আছে ‘রবিচ্ছায়া’তে। কবিকাহিনী তো রচিতই হচ্ছিল আন্নার সঙ্গে সময় কাটানোর সমকালে। ফলে তার মধ্যে আনা রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের ছাপ খুঁজে পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। এরপর নলিনী আবার ফিরে এসেছেন ‘ভগ্নহৃদয়’ নাট্যকাব্যে। নলিনী নামে একটি গদ্যনাট্য লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘নলিনী’র সংশোধিত গীতিনাট্যরূপ হল ‘মায়ার খেলা’। অনেক পরে লেখা হয় ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের ‘ক্ষণিকা’ ও ‘কিশোর প্রেম’ নামের দুটি বিখ্যাত কবিতা। আনা রবীন্দ্রনাথের থেকে ছ বছরের বড় ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ তখন আমেদাবাদে সেশন জাজ। তাঁর আগ্রহেই দেবেন্দ্রনাথ রাজি হন রবীন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টার হবার জন্য বিলেতে পড়তে পাঠাতে। আমেদাবাদে কিছুদিন থাকার পর রবীন্দ্রনাথকে সত্যেন্দ্রনাথ পাঠিয়ে দেন বোম্বাইয়ের এক পরিবারের কাছে, গৃহবিদ্যার্থীরূপে। ডাক্তার আত্মারাম পাণ্ডুরঙ-এর কন্যা আন্না তখন সদ্য বিলেত থেকে ফিরেছেন, তিনি নানা ইউরোপীয় ভাষা ও আদবকায়দা জানেন। পাণ্ডুরঙ পরিবারে মাস দুয়েক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময়টায় আন্না রবীন্দ্রনাথের শিক্ষয়িত্রী হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রনাথকে বিলিতি আদবকায়দা ও ইংরেজি শেখাবার ভার পড়ে তাঁর ওপর। তবে এই সম্পর্ক ছাত্র-শিক্ষিকার সম্পর্কেই কেবল আবদ্ধ থাকেনি।

আরও পড়ুন- জিআই ট্যাগের জন্য আবেদন: দুধ, ছানা ছাড়াই মিষ্টি

রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) ব্যক্তিত্ব ও কাব্যপ্রতিভায় আনা অনুরক্ত হন। সম্পর্ক বদল হল। বিদ্যার্থী বসলেন গুরুর আসনে, আর শিক্ষয়িত্রী হলেন নবীন কবির কাব্যসংগীত সৌন্দর্যমুগ্ধ অনুরাগময়ী প্রিয়শিষ্যা। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের কবিকাহিনী ভারতী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তার অনুবাদ আনাকে শোনাতেন রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore)। কিন্তু শুধু অনুবাদে আনার মন ভরেনি। প্রিয়-কবির কাব্যরস আস্বাদনের জন্য তিনি বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ বিলেতে থাকার সময় কবিকাহিনী গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং তা পাঠানো হয় আনার কাছে। বিবাহের পরেও আনা রবীন্দ্রনাথকে ভুলে যাননি। রবীন্দ্রনাথের দেওয়া আদরের ডাকনাম নলিনীকে তিনি মনের মধ্যে রেখেছিলেন; দেশি ও বিলিতি সংবাদপত্রতে নানা প্রবন্ধ, গদ্য ও পদ্য লেখার সময় আনা নলিনী নামটি ব্যবহার করতেন।
‘খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা— খুঁজে নিতে দাও সেই আনন্দের হারানো কণিকা। কবে সে যে এসেছিল আমার হৃদয়ে যুগান্তরে গোধূলিবেলার পান্থ জনশূন্য এ মোর প্রান্তরে লয়ে তার ভীরু দীপশিখা। দিগন্তের কোন্ পারে চলে গেল আমার ক্ষণিকা।’

উইলিয়াম রোটেনস্টাইনের সঙ্গে

জীবনের আলো-আঁধারি পথে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রায় শেষ বিকেলে কবি দেখা পান তাঁর ‘ওগো বিদেশিনী’ বন্ধুর। রাম জন্মের আগেই রামায়ণের লেখা প্রবাদের মতো বন্ধুর জন্মের আগেই রচিত হয়েছিল কবির স্বীকারোক্তি, ‘আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ’। চব্বিশের তরুণ জমিদারের শিলাইদহের কুঠিবাড়ির পাশে বয়ে চলা পদ্মার ঢেউ প্রায় চল্লিশ বছর পর কি এক মহাজাগতিক নির্দেশে মিশেছিল মিরালরিওর দোর ছুঁয়ে যাওয়া প্লাতার প্রায়তটরেখাহীন জলের সাথে সে কথা ছেষট্টির বিখ্যাত কবি জানতেন না। শুধু জানতেন বিখ্যাত আর আলোকিত জীবনের অলিতে গলিতে থাকে বড়ই একাকীত্বের অন্ধকার। তাই বারবার উজ্জ্বল আলোর বৃত্তের বাইরের অন্ধকারে খুঁজে বেড়ায় বন্ধুত্বের উষ্ণ আশ্রয়— একটু সহমর্মিতার সুরে পূরবীর আলাপ।
নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তখন বিশ্ববিখ্যাত। সুদূর পেরু যাওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন তেষট্টি বসন্ত পেরোনো প্রায় বিকেলের সূর্য। হোটেলে দেখতে এলেন গুণমুগ্ধ পাঠক, নবীন প্রতিভা— সে বিদেশিনী। একদশক আগেই জীবনের এলোমেলো সময়ে নোবেল পাওয়া গীতাঞ্জলির অনুবাদ কবিতাগুলির মধ্যে সে বিদেশিনী খুঁজে পেয়েছিলেন মনের শান্তি। তাই এতদিন পর প্রিয় মানুষ টিকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে এসে, হোটেলে ফেলে রাখতে পারলেন না। উঠলেন এক আত্মীয়বাড়ি মিরালরিওতে। গড়ে উঠল এক সম্পর্ক— দেশ, মহাদেশ, বয়স, ভাষা যার অন্তরায় নয়। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা প্লাতা সেই সম্পর্কের সাক্ষী রইল। আর্জেন্টিনার নারীবাদী লেখিকা, চৌত্রিশের ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো— তেষট্টির রবীন্দ্রনাথের বিজয়া। লেখা হলো পূরবী কাব্যগ্রন্থ— বিদেশি ফুল সাক্ষী থাকল পাণ্ডুলিপির বিচিত্র কাটাকুটির… ‘যে তোমারে বোঝে ভালোবেসে/তাহার হৃদয়ে তব ঠাঁই/আর কোথা নাই।’ ‘বিজয়ার করকমলে’ পূরবী। ঊনষাট দিনের নিবিড় সান্নিধ্য, চার বছর পর আর একবার দেখা আর চিঠিপত্র বন্ধুত্ব বজায় ছিল সূর্যাস্ত পর্যন্ত। সূর্য ডোবার খবর জেনে রথীন্দ্রনাথকে টেলিগ্রাম করেন : থিংকিং অব হিম।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ

‘ভারতে কোন বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য, আচার্য জগদীশ’। কবির ভাষায় ‘আমার জীবনের প্রথম বন্ধুত্ব জগদীশের সঙ্গে | আমার চিরাভ্যস্ত কোণ থেকে তিনি আমাকে টেনে বের করেছিলেন যেমন করে শরতের স্নিগ্ধ সূর্যোদয়ের মহিমা চিরদিন আমাকে শোবার ঘর থেকে ছুটিয়ে বাইরে এনেছে |’ বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক দুজনেই বিশ্বখ্যাত। রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) বিজ্ঞান চেতনা আর জগদীশচন্দ্র বসুর ‘অব্যক্ত’ সাহিত্যে বিচরণ বাল্যকাল থেকে বন্ধুত্বের আবেশ ফল। শিলাইদহতে পদ্মায় বোটে ভ্রমণ, কচ্ছপের ডিম সংগ্রহ, বালুচরে রোদস্নান একত্রে। জগদীশচন্দ্র বসু হলেন মুক্তদর্শনের অধিকারী বিজ্ঞানী আর রবীন্দ্রনাথও ছিলেন এই মুক্তদর্শনে বিশ্বাসী। তাই প্রাণের টান ছিল শেষ দিনটি পর্যন্ত। বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করার সময় বিজ্ঞানীকে অর্থের সংকট থেকে উদ্ধার করেন সাহিত্যিক। বন্ধুর নামে খেয়া ভাসিয়েছেন, লিখেছেন বনবাণী।
‘হে সাধকশ্রেষ্ঠ, তব দুঃসাধ্য সাধন লভে জয়—
সতর্ক দেবতা যেথা গুপ্তবাণী রেখেছেন ঢাকি
সেথা তুমি দীপ্তহস্তে অন্ধকারে পশিলে একাকী,
জাগ্রত করিলে তারে। দেবতা আপন পরাভবে
যেদিন প্রসন্ন হন, সেদিন উদার জয়রবে
ধ্বনিত অমরাবতী আনন্দে রচিয়া দেয় বেদি
বীর বিজয়ীর তরে, যশের পতাকা অভ্রভেদী
মর্তের চূড়ায় উড়ে।’
ভারতীয় শিল্পকলার টানে ভারতে এসেছিলেন উইলিয়াম রোটেনস্টাইন। ঠাকুরবাড়ির নামী চিত্রশিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সাথে বাংলার নব্যশিল্পচর্চা নিয়ে আলোচনার মাঝে কী এক আশ্চর্য টানে শ্রোতা থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। এই আশ্চর্য টান একদিন গভীর বন্ধুত্বের শিকড় রচনা করল। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি আঁকেন আর সেই প্রতিকৃতি ‘গীতাঞ্জলি’ বইয়ে রয়েছে। ‘গীতাঞ্জলি’র ইংরেজি অনুবাদ ‘Song Offerings’-এর জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার অন্তরালে রোটেনস্টাইনের অবদান কিছু কম নয়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেই রবীন্দ্রনাথের প্রথম এই বন্ধুর কথাই মনে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ জানতেন এই বিদেশি বন্ধুটি সবচেয়ে খুশি হবেন রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে। সত্যিই তাই প্রথমে টেলিগ্রামে আর তারপর দীর্ঘ চিঠিতে দূর বিদেশ থেকে ভেসে এসেছিল রোটেনস্টাইনের শুভেচ্ছা বার্তা। রবীন্দ্রনাথের নিজের করা ইংরেজি কবিতার অনুবাদগুলি রোটেনস্টাইনের উদ্যোগেই পৌঁছে যায় এন্ড্রু ব্রাডলি, স্টপফোর্ড ব্রুক এবং ইয়েটসের কাছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রোটেনস্টাইনের মুগ্ধতা তখন চরমে। নিজেই আয়োজন করেছেন সাহিত্যসভা। ইয়েটস সেখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। রোটেনস্টাইনের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের অনেক খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে এই বন্ধুত্বের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ রোটেনস্টাইনকে বলেছিলেন, ‘স্বভাববন্ধু’! গোটা গীতাঞ্জলি উৎসর্গ করে ছিলেন তাঁকে।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্কটিশ কবি ইয়েটসের দেখা হয়েছিল উইলিয়াম রোটেনস্টাইনের বাড়িতে। সেই থেকে দুজন ভাল বন্ধু হয়ে উঠলেন, তাঁদের সেই বন্ধুত্ব টিকেছিল ৩৭ বছর। যদিও এর মাঝে কিছুটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল। গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছিলেন ইয়েটস।
আরও আছেন কতজন, স্বনামে, বেনামে— রবিকিরণে আলোকিত নানা চরিত্র, কবির বন্ধু নামে পরিচিত। কিন্তু পোশাকি সম্পর্ক, শুভানুধ্যায়ী কিংবা গুণমুগ্ধ ইত্যাদি ছাপিয়ে আটপৌরে বন্ধু হয়ে ওঠার ক্ষমতা আদৌ কার ছিল? আদৌ এমন কে ছিলেন তাঁর জীবনে যার সাথে পাইনের ছায়ামাখা কোনও পাহাড়ি পথের বাঁকে হাঁটতে হাঁটতে বলতে পেরেছিলেন— ‘যে আমারে চায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি’।
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে॥
এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে,
গভীর কী আশায় নিবিড় পুলকে
তাহার পানে চাই দু বাহু বাড়ায়ে॥
আসলে মহীরুহর গা বেয়ে লতা ওঠে, অন্য মহীরুহর সাধ্য নেই তাকে ছায়া বা আশ্রয় দেওয়ার। খ্যাতি এক অভিশাপ যেটা বিখ্যাত বয়ে চলে জীবনভর। পাশে থাকে স্তাবক, গুণমুগ্ধ, উপকৃত, কৃতজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি। তারা কেউই সম্পর্কের উপরে গিয়ে বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না। একলা চলো রে বলে মনকে সান্ত্বনা দিলেও এক অন্তহীন হাহাকারের মতো মন খুঁজে বেড়ায় এমন কাউকে— আজি সঘনও শ্রাবণও রাতে/ বন্ধু রহো, রহো সাথে।

Latest article