শাল-পিয়ালের জঙ্গলে ঘেরা বেলপাহাড়ি (Belpahari Jhargram)। অরণ্যের পাশাপাশি আছে ছোট-বড় পাহাড়। একটা সময় ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত। বর্তমানে ঝাড়গ্রামে। পশ্চিমবঙ্গের ভ্রমণ মানচিত্রে এই অঞ্চলটি বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে পর্যটকদের আনাগোনা। কেউ ঘুরে চলে আসেন, কেউ নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ কাটিয়ে আসেন একটি-দুটি দিন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আজকের নয়, চিরকালের। তবে বাইরের জগতের মানুষের কাছে বেলপাহাড়ি (Belpahari Jhargram) পরিচিত হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। জানা যায়, ছয়ের দশকের সময় থেকে দূরের লোকজনদের যাতায়াত বাড়ে। অন্য জেলার, অন্য রাজ্যের। তবে একটা সময়ের পর অঞ্চলটি অশান্ত হয়ে ওঠে। বিশেষত এক যুগ আগে।
২০১১ সালে রাজ্যে ঘটে রাজনৈতিক পালাবদল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর উদ্যোগেই শান্তি ফিরে আসে জঙ্গলমহল বেলপাহাড়িতে। আবার পদধূলি পড়তে থাকে পর্যটকদের। বর্ষায় তো বটেই, পুজো, শীত, বসন্তের দিনেও ভালই হয় লোকসমাগম।
অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা বেলপাহাড়ি। জনকোলাহল তেমন নেই। তবে সারাদিন শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির। নানা রকমের পাখি। কিছু চেনা, কিছু অচেনা। তাদের ডাকেই ঘুম ভাঙে নরম ভোরে।
আদুরে রোদ ছড়িয়ে পড়ে জঙ্গলের গাছে গাছে, পাতায় পাতায়। আলোকিত হয়ে ওঠে পাহাড় চূড়াগুলো।
বর্ষায় বেলপাহাড়ির প্রকৃতি অন্যরকম রূপে সাজে। ছড়িয়ে পড়ে মায়া। ভেজা মাটি, ভেজা-ভেজা গাছগাছালির গন্ধ পরিবেশকে মাতাল করে তোলে। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে কোন এক অজানায়। তবে একা না যাওয়াই ভাল। এই অঞ্চলে ঘুরতে হয় দলবেঁধে। জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করে বুনো পশু, হাতির দল। তাই সতর্ক থাকতে হয়।
বেলপাহাড়ি অঞ্চলে আছে বেশ কয়েকটি বেড়ানোর জায়গা। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ঢাঙিকুসুম। ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া। বেলপাহাড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। চিরসবুজ এক গ্রাম। আছে পাহাড়। অসমতল রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। আলো ছড়ায় নানা রঙের বুনোফুল। দূর থেকে শোনা যায় ডুংরি জলপ্রপাতের শব্দ। পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এই জলপ্রপাত। এ-ছাড়াও আছে হদহদি ঝর্না। তার শোভাও কোনও অংশে কম নয়।
এই অঞ্চলে মূলত আদিবাসীদের বসবাস। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ পাথর কেটে থালা-বাটি-বাসন ইত্যাদি জিনিসপত্র তৈরি করেন। কিছু মানুষ করেন চাষের কাজ। মাঝেমধ্যেই তাঁরা নিজেদের মধ্যে মেতে ওঠেন উৎসবে। বেজে ওঠে ধামসা-মাদল। শুরু হয় নাচগান। কয়েকদিন আগে এখানে হুল দিবস পালিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: পার্থেনিয়াম নির্মূলকরণে নামল এনসিসি, এনএসএস ক্যাডেটরা
কাঁকড়াঝোড় অরণ্য খুব একটা দূরে নয়। বেলপাহাড়ির লাগোয়া। এখানেও আছে একাধিক পাহাড়ি জলপ্রপাত এবং ঝর্না। বর্ষায় কোনও ভাবেই চোখ ফেরানো যায় না। কিছু দূরে ঘাঘরা পর্যটন কেন্দ্র। আছে ওয়াটার ফলস, তারাফেনি নদী।
পর্যটকদের হাতছানি দেয় আমলাশোল পাহাড়। এই পাহাড়ের পদে পদে ছড়িয়ে রয়েছে রোমাঞ্চ। বিশুদ্ধ প্রকৃতিপ্রেমীর জন্য এই জায়গা আদর্শ।
বেলপাহাড়ি থেকে মোটামুটি ১০ কিলোমিটার দূরে আগুইবিল গ্রাম। অপরূপ সৌন্দর্য এই গ্রামের। চারপাশে উঁকি মারে ছোট বড় পাহাড়, সবুজ অরণ্য। বিভিন্ন রকমের গাছ। মহুয়া, শাল, শিমুল, কেন্দু, বহেড়া। গ্রামে আছে বড় মাপের জলাধার।
পাহাড়ি পথে বহু মানুষ ট্রেকিং করতে আসেন। ফেলেন তাঁবু।
আরও একটি বেড়ানোর জায়গা গাড়রাসিনি হিল। পাহাড়ের চূড়ায় আছে মন্দির, দেবীগুহা। পাহাড়ে ওঠা খুব কষ্টসাধ্য। তবু মনের জোরে অসাধ্য সাধন করেন অনেকেই। খাঁদারানি ড্যাম এখান থেকে খুব দূরে নয়।
সবমিলিয়ে বৃষ্টিদিনে বেলপাহাড়ি বেড়ানোর আদর্শ জায়গা। টুকটাক ঘুরতে পারলে ভাল, নাহলে শহুরে কোলাহল থেকে দূরে, সবুজ প্রকৃতির কোলে দু-একটা দিন নির্ভেজাল ছুটি কাটাতেও মন্দ লাগবে না। নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে মধ্যবিত্তের কর্মব্যস্ত জীবনে।
কীভাবে যাবেন?
হাওড়া থেকে ট্রেনে ঝাড়গ্রাম। সেখান থেকে বাসে বেলপাহাড়ি। দূরত্ব মোটামুটি ৩৭ কিলোমিটার। টানা গাড়িতে ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, কলকাতা থেকে বেলপাহাড়ি যাওয়া যায়। জঙ্গলের বুক চিরে উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতে মন্দ লাগবে না।
কোথায় থাকবেন?
ঝাড়গ্রামে আছে লজ, রিসর্ট এবং হোটেল। থাকা যায় বেলপাহাড়িতেও। আছে গেস্ট হাউস, কটেজ। এ-ছাড়াও আছে সরকারি আবাস। আগে অবশ্যই যোগাযোগ করে যাবেন। সুবিধার জন্য দেখে নেওয়া যেতে পারে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ওয়েবসাইট। সঙ্গে নেবেন ওষুধপত্র, টর্চ, মোবাইল ফোনের চার্জার।