২০২০-র জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে তাঁর ঘনিষ্ঠ আমলাদের অন্যতম নৃপেন্দ্র মিশ্রকে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের কাজের অগ্রগতি পরিদর্শনের জন্য পাঠিয়েছিলেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল রাম মন্দির নরেন্দ্র মোদির কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০১৯-এর নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্ট যখন ১০৪৫ পৃষ্ঠার রায় প্রদান করেছিল তখনই অনুমিত হয়েছিল, স্পষ্ট ভাবেই বোঝা গিয়েছিল, জয়ী পক্ষ বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে অবিলম্বে নয়া ইতিহাস লেখার কাজ শুরু করবে, কারণ বিজয়ীরা তেমনটাই করে থাকে। যাই-ই হয়ে থাক না কেন ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’র সংকল্প ছিল যে লক্ষ লক্ষ হিন্দুর, তাঁদের কাছে পুরো বিষয়টা ছিল স্বপ্ন পূরণের মতো।
আরও পড়ুন-উন্নয়নেই লোকসভায় ভাল ফল : ফিরহাদ
অর্থের জোগান, পরিকল্পনা, স্থাপত্যের নকশা, কোনও কিছুরই ঘাটতি ছিল না, কিন্তু সময় আর বাস্তবায়ন, এই দুটো বিষয়ই হল আসল কথা। পিছনে ফিরে তাকালে এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বিরাট উদ্যোগ উদ্যম প্রয়াস ছাড়া সাধারণ নির্বাচনের আগে ২০২৪-এর গোড়াতেই এই দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল মন্দির নির্মাণকর্ম সম্পূর্ণ করাটা সম্ভবপর ছিল না।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রীয় শ্রমিক সম্মেলনে শ্রম কোড বাতিলের দাবি
যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ হয়েছে। ২০২০-র অগাস্ট মাসেই প্রধানমন্ত্রী মোদিজি ভূমিপূজন বা ভিত পুজো সারতে পেরেছেন। এরপর ২২ জানুয়ারি, ২০২৪-এ রুদ্ধশ্বাস এক ঐতিহাসিক ঘটনা নিশ্চিত করার জন্য কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে উপেক্ষা অবজ্ঞা করা যেতেই পারে। সেটাই যথোপযুক্ত কাজ।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রেস ব্যুরো বলছে, উপেক্ষিত অবহেলিত ধুলোবালিতে ভর্তি ছোট শহর অযোধ্যা একবিংশ শতাব্দীর তীর্থ কেন্দ্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। ধর্মীয় মন্দিরের বিষয়ে প্রচার করাটা সরকারি তথ্য দফতর (পিআইবি)-এর কাজ কিনা সেটা নিঃসংশয়ে বলা যাচ্ছে না, তবে লক্ষণীয়ভাবে পিআইবি রিপোর্টের তিন চতুর্থাংশ জুড়ে রয়েছে ডিজিটাল পেমেন্টের গুণকীর্তন। ইতিহাস বলছে এবং সর্বক্ষেত্রে এটাই হয় যে তীর্থযাত্রায় ঈশ্বর এবং ব্যবসা-বাণিজ্য পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয় এবং এটাও সংশয়াতীত সত্য যে অযোধ্যা নামক সৌভাগ্যবান শহরটির পরিকাঠামো ও অর্থনীতি, দুটোরই উন্নতি ঘটবে।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠল লাদাখ, গণতন্ত্র ফেরত চাই,আলাদা রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে এবার আন্দোলন
তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এসবের সৌজন্যে ভাটিকান বা মক্কার মতো অযোধ্যাও হিন্দু বিশ্বাসের সর্বপ্রধান কেন্দ্রের মর্যাদা গৌরব অর্জনে সমর্থ হবে। সামান্য চেষ্টা করলে প্রাচীনত্বের দিক থেকে অযোধ্যা জেরুজালেমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে সমর্থ হবে। আব্রাহামীয় ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে দুটি ক্ষেত্রে আমাদের সনাতন ধর্মের পার্থক্য ছিল। তাঁদের মতো সনাতন ধর্মের একটিমাত্র ধর্মগ্রন্থ বলে এতদিন কিছু ছিল না এবং তাঁদের মতো হিন্দু ধর্মবিশ্বাসীদের একামেবদ্বিতীয়ম ধর্মগ্রন্থ বলে কিছু ছিল না। এখন এই দুটি ক্ষেত্রেই শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার পথে। হয়তো অযোধ্যাকে তাবৎ হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে একমাত্র পীঠস্থান বা ধর্মবিশ্বাসের ভরকেন্দ্র হিসাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে দশকের পর দশক, শতাব্দীর পর শতাব্দী লেগে যাবে। কিন্তু প্রবল প্রচেষ্টার শুরুটা এই জমানাতেই হয়ে গেল। এখন প্রশ্ন হল, এই প্রবল প্রয়াস কি কোনওভাবে সেই ‘শাশ্বত ধর্ম’কে আরও শক্তিশালী করতে সমর্থ হবে, যে ধর্ম বিকেন্দ্রীভূত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বৈতবাদী ভাবনাশ্রয়ী, আর সেই কারণে পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, কিঞ্চিৎ রহস্যাবৃত? এই ধর্ম ভারতের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়ে সকল আঞ্চলিক ও কৌম গোষ্ঠীকে আপন পরিসরে জায়গা করে দিয়েছে। চারধাম ভারতের চার কোণে চারটি মঠ বিবিধের মধ্যে মিলনের বার্তাবাহী। এই ভাবধারাতেই চারিদিকে হাজার হাজার তীর্থস্থান গড়ে উঠেছে। আমাদের দ্বাদশ জ্যোতির্ধামে পূজিত হন শিব, বিষ্ণু পূজিত হন চতুর্ধামে। ৫২টি শক্তিপীঠ দেবীশক্তির জন্য উৎসর্গীকৃত— অসমের কামাখ্যা থেকে বালুচিস্তানের হিংলাজে, কাশ্মীরের সারদা থেকে দাক্ষিণাত্যের কন্যাকুমারী পর্যন্ত সর্বত্র মাতৃশক্তি পূজিত।
আরও পড়ুন-পেটিএম করবেন না, ব্যবসায়ীদের অন্য অ্যাপ ব্যবহারের পরামর্শ সর্বভারতীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের
ভারতের ঐক্যসাধন প্রকল্পে রামায়ণ ও মহাভারতের বিরাট আবদান অনস্বীকার্য। মহাকাব্যদ্বয়ের মুখ্য চরিত্রদের চোদ্দো বছরের বনবাস যাপন পর্ব মহাকাব্যের কবিদের ভারতের কোণায় কোণায় সংগুপ্ত। অগণিত আপাতভাবে গুরুত্বহীন স্থানকে ধর্মীয় মিথের মানচিত্রে টেনে আনতে সহায়তা করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় হনুমানের জন্মস্থানের কথা। তিনটি জায়গা আছে যারা বজরঙ্গবলীর জন্মস্থান বলে দাবি করে। সেই দুটি স্থানে দূরত্ব অনেকটাই। ফলশ্রুতি এই যে, তিনটি স্থানই ধর্মীয় বিশ্বাসে তীর্থস্থানের মর্যাদা অর্জন করেছে এবং পর্যটন মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। তিনটি জায়গাই সন্তুষ্ট। ধর্ম বিশ্বাসের সুবাদে এরকম মান্যতাপ্রাপ্তির কারণে ভৌগোলিকভাবে বৈচিত্রময় স্থানগুলিও পরস্পরের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেছে। ঐক্যবদ্ধ ভারত নির্মাণে শরিক হয়েছে। এভাবেই ভারতে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের আগমনের পূর্বে বৈচিত্রময় হলেও ভারত এক ছাতার নিচেই ছিল। সেমেটিক ধর্মমতগুলির কড়াকড়ি, বিধিতে আবদ্ধ আবহ দেশে বিরাজমান হিন্দু বিশ্বাসের ওপর বিরাট আঘাত, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অভিশাপ বলে মনে হয়েছিল। এজন্যই হিন্দুরা অবিকৃতরূপে সেমেটিক ধর্মবিশ্বাসে সাদরে বরণ করে নিতে পারেনি।
আরও পড়ুন-বিশ্বের ধনীদের তালিকায় চতুর্থ স্থানে মার্ক জুকারবার্গ
আর একটা বিষয় হল রামের গ্রহণযোগ্যতা। রামচন্দ্র নিঃসন্দেহে সমগ্র দেশের সকল হিন্দুর কাছে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু গাঙ্গেয় উপত্যকা এবং তৎসংলগ্ন অববাহিকায় তিনি দেশের অপরাপর অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও বরণীয়। নবরাত্রি এবং রামনবমীর কথাই ধরা যাক। শরৎকাল ও বসন্তকালে নির্দিষ্ট ওই ন’টি দিন সকলের কাছেই পবিত্র। কিন্তু হিন্দি বলয়ে ও তৎসংলগ্ন এই ধর্মপ্রাণতার ভরকেন্দ্রে শ্রীরামের অবস্থান। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কিন্তু তা নয়। ওই সব অঞ্চলে বিবিধ দেবদেবী এই ধর্মপালনের ভরকেন্দ্রে অবস্থান করেন। বাংলা এবং পূর্ব ভারতে এ-সময় রামের নামে উপবাস পালনের প্রথা নেই, দুর্গাপুজোয় মাছ-মাংস গ্রহণেও বাধা নেই। অন্ধ্র ও মহীশূরে রাম কিংবা দুর্গা পূজিত হন না, পালিত হয় পাণ্ডবদের বিজয় উৎসব। তামিলরা রামের পুজো করেন না, তাঁরা পুজো করেন তিনজন দেবীর— লক্ষ্মী, পার্বতী ও সরস্বতীর। পাঞ্জাবেও দেবীপূজনের প্রথা বর্তমান। গোয়া ও মহারাষ্ট্রের মানুষজন পুজো করে ঘটের, যে ঘট বা কল ঊর্বরতার প্রতীক। আবার গুজরাতে এসময় পালিত হয় গরবা ও ডান্ডিয়া রাসের উৎসব।
আরও পড়ুন-রেড রোডের ধরনা মঞ্চে যুবদের অঙ্গীকার
অযোধ্যাতে রামনবমী বসন্তকালে বিরাট আকারে পালিত হয়। বিহারের সীতামারহীতেও তাই। তেলেঙ্গানার ভদ্রাচালম তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমেও তাই। কিন্তু যদি বলি রামকেন্দ্রিক উৎসবের একটা সর্বভারতীয় চরিত্র আছে, তবে তা অতিরঞ্জন হয়ে যাবে। বাংলায় অনেক রামভক্ত রামনবমীর সময় হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে রামের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে মোটর সাইকেলে চেপে শোভাযাত্রা বের করেন। কিন্তু লোকে তাতে ভয় পেয়ে অন্য পক্ষকে ভোট দেয়। এটা বুঝতে হবে যে রাম যেখানে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের জায়গায় জায়গায় অবিসংবাদী দেবতা, সেখানে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক স্থানিক দেবতা আরাধ্য। হিন্দু ধর্মের শক্তি বৈচিত্রের মধ্যেই নিহিত, এই বৈচিত্রই ভারতের ভিত্তি।
হিন্দু ধর্ম সন্দেহাতীতভাবে এখন কঠোরতর অবস্থা গ্রহণ করছে। ধর্মবিরোধিতার মতো অশ্রুতপূর্ব ধ্যানধারণাও এখন সিংহদ্বার দিয়ে না হোক খিড়কির দরজা দিয়ে হিন্দু ধর্মের উঠোনে চলে এসেছে। হয়তো ভারতের কেন্দ্রস্থলে বিরাট সংখ্যক জনতা এই কাঠিন্য ধর্মের অনুগামী হয়ে উঠেছেন। তবু হিন্দু ধর্মের ব্যাপকতার মধ্যে বহুকাল ধরে বিরাজিত অসমসত্বতা দূরীকরণের প্রয়াস শুধু অবিবেচকসুলভ কাজ নয়, মারাত্মক ও বিপজ্জনকও বটে। স্বল্পকালীন রাজনৈতিক সুবিধার জন্য একটা সভ্যতার শতাব্দীপ্রাচীন সার্বজনিক চারিত্র ধ্বংস করাটা সঙ্গত হচ্ছে কি না, এটাই এখন অর্বুদ টাকার প্রশ্ন।