বহুরূপীর রিহার্সালে
শম্ভু মিত্রকে ডাকতেন জেঠু বলে। স্নেহ করতেন তৃপ্তি মিত্রও। আট বছর বয়স থেকেই ‘বহুরূপী’র রিহার্সালে। একদিন শম্ভু মিত্রর কাছে আবদার জুড়লেন, ‘সবাই অভিনয় করছে, আমিও করব।’ ছোট্ট ছেলেটির কথা শুনে হাসলেন মিত্রমশাই। দলের এক অভিনেতাকে বললেন, ‘ওহে, তুমি স্টেজে ওঠার সময় ওকেও সঙ্গে নিও।’
আরও পড়ুন-ফের বাংলা বিরোধী আচরণ, সাধারণতন্ত্রে বাতিল কন্যাশ্রী ট্যাবলো
সেই প্রথম মঞ্চে পা ছোট্ট রামপ্রসাদ, রমাপ্রসাদ বণিকের। ‘পুতুল খেলা’ নাটকে। সময় গড়িয়েছে। ধীরে ধীরে বেড়েছে বয়স। ‘বহুরূপী’র বহু প্রযোজনায় দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। কখনও পার্শ্বচরিত্রে, কখনও মূল চরিত্রে। দিয়েছেন নির্দেশনাও। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তরুণ রমাপ্রসাদ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এদের মতো ছেলেদের দেখলে মনে হয় আরও কিছু বছর বাঁচি, যা জানি সব শিখিয়ে দিয়ে যাই৷’ একটা সময় প্রিয় দল থেকে বেরিয়ে আসেন রমাপ্রসাদ। প্রতিষ্ঠা করেন ‘চেনা মুখ’। তারও পরে তৈরি করেন ‘থিয়েটার প্যাশন’।
ছেড়েছিলেন ব্যাঙ্কের চাকরি
তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন নাট্য ব্যক্তিত্ব মুকেশ চক্রবর্তী। ‘যাদবপুর রম্যাণী’র প্রাণপুরুষ। জানালেন, ১৯৯০ সাল থেকে ২০১০, টানা কুড়ি বছর জড়িয়ে ছিলাম রমাপ্রসাদ বণিকের সঙ্গে। নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। যখন ‘চেনা মুখ’-এ কাজ করছেন তখন আমার সঙ্গে পরিচয়। পরে তৈরি করেন ‘থিয়েটার প্যাশন’। ওই সময়ও আমি রমাদার সঙ্গে ছিলাম। অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন। যাঁরা তাঁর ওয়ার্কশপ করেছেন, তাঁরা ভালমতো জানেন।
আরও পড়ুন-তফসিলিদের জন্য আইআইটির বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবির রাজ্যের
বড় মনের মানুষ। থাকতেন মাটির কাছাকাছি। অভিনয় জগতের পরিচিত মুখ। অথচ নিজেই ব্যাগ হাতে যেতেন বাজারে। ব্যাঙ্কের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন স্রেফ নাটকের জন্য৷ রমাপ্রসাদ ছিলেন সেই প্রজন্মের মানুষ, যাঁরা বৃহত্তর স্বার্থকে সবসময় ব্যাক্তিগত স্বার্থের উপরে রাখতেন৷ আর সেজন্য ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করতেও পিছপা হতেন না৷ হয়তো সেই কারণেই নিজের শারীরিক অসুস্থতাকেও খুব একটা গুরুত্ব দেননি। এক মনে কাজ করে গেছেন৷ উপহার দিয়েছেন পর পর অসাধারণ সব প্রযোজনা। বিদেশি নাটক থেকে নাটক রচনা করেছেন, সাহিত্য থেকেও রচনা করেছেন নাটক, পাশাপাশি রচনা করেছেন মৌলিক নাটকও। সেইসঙ্গে করেছেন পরিচালনাও।
ছোটদের বন্ধু
দীর্ঘ সময় নেহেরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে কাজ করেছেন। ছোটদের নিয়ে। সেখানেও দিয়েছেন চমক। ‘মহাবিদ্যা প্রাইমারি’, ‘একলা পাগল’, ‘লুক্সেমবার্গের লক্ষ্মী’, ‘যদিও সন্ধ্যা’ নাটকগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামের শিখা মুখোপাধ্যায় জানালেন, ২০০০ সালে আমাদের এখানে নাটকের কর্মশালা পরিচালনা করেন রমাপ্রসাদ। তার দুই-তিন বছর পর শুরু করেন নাট্য প্রযোজনা। ‘মহাবিদ্যা প্রাইমারি’র পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একটার পর একটা নাটক মঞ্চস্থ করেছেন।
ছোটদের দিয়ে বড়দের কথা বলিয়েছেন। নানা বিষয়ে রচনা করেছেন নাটক। কখনও মাতৃভাষা নিয়ে, কখনও যৌথ পরিবার নিয়ে। তাঁর প্রায় প্রতিটি নাটক পেয়েছিল দর্শকদের ভালবাসা। ছোটদের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল রমাপ্রসাদের। একটি দিনের কথা স্মরণ করলেন শিখা, রিহার্সালে একটি বাচ্চা ঠিকঠাক ভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছিল না। অভিনয়ে ছন্দপতন ঘটছিল। অথচ সে ভাল অভিনেতা। আমি বিষয়টা লক্ষ্য করি এবং রমাদাকে জানাই। রমাদা বলেন, আজ ওকে কিছু বলবেন না। ওর মন ভাল নেই। আসলে উনি ছোটদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। কথা বলতে বলতে জেনে নিতেন মনের কথা। ছোটরা বুঝত, এই মানুষটিকে নিজেদের কথা বলা যায়। রমাদা নাটক লেখার সময় এক-একজন অভিনেতার কথা ভেবে এক-একটি চরিত্র সৃষ্টি করতেন। ফলে অভিনেতার নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে সুবিধা হত। দর্শক-আসনে বসে আমরা সেটা ভালমতো বুঝতে পারতাম। ছোটদের বলতেন, তোরা যে কথাগুলো মঞ্চে বলিস, সেই কথাগুলো জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করবি।
আরও পড়ুন-মাধ্যমিকের পরীক্ষাকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা লাগানোর নির্দেশ পর্ষদের
নিজেও ছিলেন ছেলেমানুষের মতো। শিখা জানালেন, কোনও এক ২৮ ডিসেম্বর রিহার্সালে এসে রমাদা বলেন, আজ আমার জন্মদিন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে একটি কেক নিয়ে এলাম। কাটা হল। প্রতিবছর দিনটা পালন করতাম। হইহই করে। খুব আনন্দ পেতেন। ২০১০ সালের ২৮ ডিসেম্বর নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে এল রমাদার নিথর দেহ। তার আগের দিন, ২৭ ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। চোখের জলে সবাই তাঁকে বিদায় জানিয়েছি। এত বছর হয়ে গেল তিনি নেই। আজও আমরা তাঁকে ভুলতে পারিনি।
তুখোড় অভিনেতা
নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়ামে রমাপ্রসাদের স্নেহচ্ছায়ায় নাট্যশিক্ষা করেছেন দেবলীনা চক্রবর্তী। কথায় কথায় জানালেন, রমাপ্রসাদ বণিক সবদিক থেকেই ছিলেন আমার শিক্ষক। আমার গুরু। তিনি আমার মতো অনেককেই নতুন ভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। বোধের জায়গায় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন অদলবদল। খুলে দিয়েছিলেন দেখার চোখ। অভিনয়ের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোয় নজর দিতেন। পাশাপাশি বলতেন ভাল বই পড়ার কথা, ভাল সিনেমা, নাটক দেখার কথা। গান কীভাবে শুনতে হয়, ওঁর কাছেই শিখেছি।
থিয়েটারের পাশাপাশি সিনেমা-টেলিভিশনে নানা ধরনের চরিত্রে তুখোড় অভিনয় সব স্তরের দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছিল রমাপ্রসাদকে৷ শুধুমাত্র নিজের থিয়েটার গ্রুপ নয়, পুরো থিয়েটার সম্প্রদায় তাঁর উপর নির্ভর করত। অন্য দল তাঁকে তাঁদের জন্য নাটক লিখতে বা নির্দেশনার প্রস্তাব দিলে, তিনি দ্বিধা করতেন না।
আরও পড়ুন-লোকসভা ভোটের আগে জেডিইউ-এর রাশ নিজের হাতে রাখলেন নীতীশ
অকালে চলে গেছেন রমাপ্রসাদ। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে অনেকটাই নিঃস্ব হয়েছে বাংলার থিয়েটার। আজকের বহু খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রীর গুরু তিনি। তাঁদের মধ্যে দিয়েই বেঁচে আছেন। থাকবেন। আগামী দিনেও। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ব্যক্তির মৃত্যু হয়, কিন্তু ঘরানার মৃত্যু হয় না।