জন্মদিন উপলক্ষে রামমোহন রায়কে একবার ফিরে দেখা, ফিরে পড়ার আয়োজন তো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার কি বাঙালি আদৌ বহন করে? যে বিপুল কর্মক্ষমতার নজির জীবদ্দশায় রেখে গেলেন রামমোহন, সমাজের প্রায় সবরকম গতিশীল স্তরে অসামান্য অবদান রাখতে রাখতে গেলেন, তার কতটুকু ঢেউ পরবর্তী প্রজন্মকে ধাক্কা দিতে পেরেছে? একদিকে রাশি রাশি ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করে চলেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে, ধর্মতত্ত্বের জটিল আলোচনায় প্রবিষ্ট হচ্ছেন, পত্রপত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নিচ্ছেন একের পর এক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্রিটিশ-রাজের কাছে অভিযোগ পেশ করতে যাচ্ছেন দিল্লির বাদশা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের দূত হিসেবে, আবার মেয়েদের অধিকার নিয়ে সরব হচ্ছেন যখন, তখন ভারতীয় শাস্ত্রই তাঁর অস্ত্র, যা নিয়ে তিনি বাগ্যুদ্ধে নামলেন গোঁড়া পণ্ডিতদের সঙ্গেই। সতীদাহ প্রথা বন্ধ করাই শুধু নয়, তৎকালীন একাধিক কুপ্রথা, কু-আচার, কুবিচার কিংবা কুসংস্কার নিয়ে একাই লড়ে গেছেন রামমোহন। তাঁর প্রতিস্পর্ধী তো দূর, তাঁর সমকক্ষও মেলে না আজ।
আরও পড়ুন-সবুজ মাঠের তিন কন্যা
কিন্তু, তাঁকে নিয়ে সর্বাধিক আলোড়ন হয় অবশ্যই সতীদাহ প্রথার নিবর্তক হিসেবে। আজ অবশ্য হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডার ধ্বজা ধরে কিছু মূর্খ এবং অর্বাচীন নব্য বুদ্ধিজীবীর দল তাঁকে ‘ব্রিটিশ চামচা’ বলছে, কিন্তু ইতিহাস বলে, বাংলায় ইংরেজ শাসনের প্রথম পঞ্চাশ বছর অন্তত ঔপনিবেশিক শাসকরা সতীদাহ বিষয়ে মোটেই মাথা ঘামাতে রাজি ছিলেন না। বস্তুত, অসভ্য কালো মানুষগুলোর উৎকট ধর্মাচরণের ততোধিক অসভ্য একটি আচার বা রিচুয়াল ছাড়া তাঁদের কাছে ‘সতীদাহ’ আর কিছুই নয়। আর ধর্ম তো মানুষের চিরকালের আফিম। তাই বৈদেশিক আগ্রাসনকারী হলেও, আদতে যে এই ঔপনিবেশিক প্রভুরা যথেষ্ট হিতৈষী, তা প্রমাণ করতে চাওয়ার তাগিদে এই ‘সতীদাহ’র মতো ধর্মীয় বিষয়গুলোতে হস্তক্ষেপ করতে তারা মোটেই রাজি ছিল না। তাদের ভয় ছিল, কোনওভাবে যদি ধর্মীয় আগ্রাসন ভারতীয়দের বিরূপ করে না দেয়। এই ভয় আর দু’কূল রক্ষা করার দায়েই তারা একদিকে সিধে পাঠাত কালীঘাটের কালীবাড়িতে, আর পর্তুগিজ মিশনারিদের ধর্মপ্রচারের কাছে নানাবিধ বাধা সৃষ্টি করত, এমনকী কলকাতায় তাঁদের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবেশাধিকারও ছিল না!
আরও পড়ুন-মাধ্যমিকে জেলার দাপট, মেয়েরাই আবারও শীর্ষস্থানে
কিন্তু শ্রীরামপুরের দিনেমার শাসকরা আবার সতীদাহের তুমুল বিরোধী ছিলেন। ১৮০২ সাল নাগাদ ব্রিটিশদের হাত থেকে শ্রীরামপুর ফেরত পাওয়ামাত্রই তাঁরা এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজে নেমে পড়লেন। মাত্র ছয় মাসে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ৩০০ সতীদাহের ঘটনা জানতে পারলেন তাঁরা।
এ তথ্য তো রামমোহনের হাতে ছিলই, উপরন্তু ১৮১৫ সালের শেষদিকে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাস করার সময়ে তিনি যখন ‘আত্মীয়সভা’ স্থাপন করলেন, তখন সেখানে যেসব ধর্ম ও সমাজকেন্দ্রিক সমস্যার কথা উঠে আসত আত্মীয়সভার সদস্যদের আলোচনায়, তার বড় অংশ জুড়ে থাকত অবশ্যই ‘সতীদাহ’। কলকাতার পরিসংখ্যানও উঠে এসেছিল রামমোহনের কাছে। ১৮১৫ সালে শুধু কলকাতাতেই সহমৃতার সংখ্যা ছিল ২৫৩, ১৮১৬ সালে ২৮৯ এবং ১৮১৭ সালে ৪৪২। এই গোঁড়া হিন্দুদের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস যখন ব্রিটিশ শাসকদেরও নেই, তখনও এই নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করতে পিছু হটলেন না রামমোহন।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
কিন্তু রামমোহনের নারীপ্রগতিসূচক কর্মকাণ্ডের মূল বিশেষত্ব অন্যত্র। তিনি আঘাতের বিরুদ্ধে আঘাতে বিশ্বাসী নন। গায়ের জোরে, এমনকী শুধু আইনের জোরে, জবরদস্তি নিয়ম চাপিয়ে কোনও কিছুকে বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। এর আগেও, ধর্ম বিষয়ক তাঁর প্রতিটি প্রস্তাব তিনি যুক্তি দিয়ে প্রতিপাদ্যের আকারে উপস্থাপন করেছেন। উনিশ শতকের যুগসন্ধির আলো-আঁধারি পর্বে সদ্য গড়ে-উঠতে-থাকা বাঙালি মনীষার পক্ষে রামমোহনকে অনুধাবন করা অত্যন্ত কঠিন, একথা তিনি ঠিকই জানতেন। তবু কে তাঁকে কতটুকু বুঝল, তার তোয়াক্কা না করেই শুধুমাত্র সত্যের খাতিরে তাঁর যুক্তিক্রম সাজিয়ে পেশ করার অসম্ভব পরিশ্রম থেকে কোনওদিন এতটুকু সরে আসেননি তিনি।
সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হল। ক্ষমতা জাহির করে, কিংবা জোর খাটিয়ে এই প্রথা বন্ধ করা গেলেও ধর্মভীরু মানুষের মন থেকে যে একে উপড়ে ফেলা যাবে না, সে-বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন-মাঝপথে ফিরে আজ নিজামে অভিষেক, ক্ষমতা থাকলে গ্রেফতার করুক
তাই ধর্ম দিয়েই ধর্মের কাঁটা তোলার পথে হাঁটার দিকটি বেছে নিতে দেরি হল না তাঁর। তিনি বুঝেছিলেন, এই প্রথার মিথ্যা অসারতা এবং এই কুপ্রথার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অসদুদ্দেশ্যগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারলে তবেই তথাকথিত ‘স্বেচ্ছায় সহগমনকারিণী’র সংখ্যায় রাশ টানা যাবে। নইলে শুধু আইন কখনওই মেয়েদের মনের ভেতরে গেড়ে বসে থাকা লক্ষ বছরের এই জমাট অন্ধকার সরাতে পারবে না। তাই শাস্ত্রই হয়ে উঠল তাঁর শস্ত্র।
আরও পড়ুন-অভিষেককে আটকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাবেন নবজোয়ারে, জানালেন দলনেত্রী
সতীদাহ বিষয়ে তাঁর প্রথম পুস্তিকার নাম ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’। চিরন্তন ভারতীয় দর্শনের উপস্থাপন শৈলীকে অনুসরণ করে রামমোহন এখানে উত্তর-প্রত্যুত্তরের সজ্জায় নেতি-নেতি করে অবশেষে প্রমাণ করলেন তাঁর মতের অকাট্য সারবত্তা।
এজন্য গোঁড়া হিন্দুদের ব্যঙ্গ বা বিদ্রুপ তাঁকে তো কিছু কম সহ্য করতে হয়নি! কিন্তু তিনি স্বাভাবিক উদার চিত্তে তা উপেক্ষা করতেন। এমনও হয়েছে যে, তিনি যে গাড়িতে উপাসনার শেষে বাড়ি ফিরছেন, সেই গাড়িটিকেই ঢিল আর পাথর নিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে। শিবনাথ শাস্ত্রী এ-প্রসঙ্গে লিখছেন, রামমোহন “হাসিয়া গাড়ির দ্বার টানিয়া দিতেন এবং বলিতেন, ‘কোচম্যান হেঁকে যাও।”
আরও পড়ুন-আর ২০০০ টাকার নোট ছাপবে না RBI, নোট জমা করতে হবে ব্যাঙ্কে
তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজও স্ত্রী-পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী ছিল এবং সেই সঙ্গে জাতিভেদের কঠোর সমালোচক ছিল। রামমোহনের কাছে ধর্মে জাতি ও লিঙ্গের ভেদ ছিল অগণতান্ত্রিক, অমানবিক এবং আধুনিকতার বিরোধী। অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বিশ শতকের সত্তরের দশকে অতি বামপন্থীরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন যে, তিনি নাকি জাতিভেদের বিপক্ষে কোনও আন্দোলনই গড়ে তোলেননি! তাঁরা ভুলে গেছেন, সন্ধ্যায় যে প্রদীপ জ্বলে উঠবে, তার সলতেখানি পাকিয়ে রাখতে হয় দিনের আলোতেই। রামমোহন নিজেও সারাজীবন তাঁর সলতে পাকানোর কাজটি করে গেছেন তাঁর ‘সমাজ’ মারফত। সেখানে নিয়মিত জাতিগত ও লিঙ্গগত বৈষম্য নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার পরিসর সজীব ছিল।
আরও পড়ুন-২০২৪-এর মাধ্যমিক পরীক্ষা কবে? জানাল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ
রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘On Rammohan’ গ্রন্থে (১৯৭২) রামমোহন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, তিনি বিধবাবিবাহের সমর্থক ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন শৈব বিবাহের পক্ষপাতী। কিন্তু উপরোক্ত মন্তব্যের মধ্যে তথ্যভ্রান্তির সম্ভাবনাই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। কারণ, বিধবাবিবাহের সপক্ষে কোনও পুস্তিকা বা প্রচারপত্র না লিখলেও, সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, ১৮১৫ সালে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয়সভা’য় বাল্যবিবাহ এবং বিধবাবিবাহ সম্পর্কে আলোচনা হত। ১৮১৯ সালের সভায় গৃহীত এই বিষয়ক প্রস্তাবের উদ্ধৃতি পাওয়া যায় বিনয় ঘোষের ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ’ গ্রন্থে (১৯৮৪)— “At the meeting in question… the necessity of an infant widow passing her life in a stage of celibacy, the practice of polygamy and of suffering widows to burn with the corpse of their husbands, were condemned.”
আরও পড়ুন-৩২হাজার চাকরি বাতিলে অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের
রামমোহনের স্মরণসভায় স্বয়ং নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “রামমোহন রায় সহগমন প্রথা উন্মূলিত করিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন না, যাহাতে বিধবাদের পুনঃসংস্কার হয় তদ্বিষয়েও তিনি যত্নবান হন।… হিন্দু সমাজের তদানীন্তন বদ্ধমূল কুসংস্কার নিবন্ধন তিনি বিধবার পুনঃসংস্কার প্রদানে কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই বটে, কিন্তু তিনি এই বিষয় লইয়া যে একটি আন্দোলন করিয়াছিলেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। তাঁহার কোনো প্রদৌহিত্র বলেন, রামমোহন রায়ের বৈষয়িক কাগজপত্রের ভিতর এই বিধবাবিবাহ বিষয়ক আন্দোলনের কোনো নিদর্শন পত্র তিনি দেখিয়াছেন।” (তত্ত্ববোধিনী, ৪২৮ সংখ্যা)
এমনকী সম্পত্তিতে নারীর অধিকার বিষয়েও সরব হন তিনি, যে সচেতনতার কথা সেযুগে প্রায় ভাবাই যায় না! ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সংবাদ’ পুস্তিকায় মেয়েদের ওপরে সামাজিক তথা পারিবারিক নিষ্পেষণের যে ছবিটি আঁকলেন তিনি, তা তাঁর এই আধুনিক মনটিকে ঠিক চিনিয়ে দিয়ে যায়— “যাহারা আপন আপন স্ত্রিকে লইয়া গার্হস্থ্য করেন, তাহারদের বাটীতে প্রায় স্ত্রীলোক কি কি দুর্গতি না পায়? বিবাহের সময় স্ত্রীকে অর্দ্ধ অঙ্গ করিয়া স্বীকার করেন, কিন্তু ব্যবহারের সময় পশু হইতে নীচ জানিয়া ব্যবহার করেন; …স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে, অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে কি বর্ষাতে স্থান মার্জ্জন, ভোজনাদি পাত্র মার্জ্জন, গৃহ লেপনাদি তাবৎ কর্ম্ম করিয়া থাকে এবং সূপকারের কর্ম্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাত্রিতে করে…।”
আরও পড়ুন-জনসংযোগ দেখে রাতের ঘুম উড়েছে বিজেপির, সাফ জানালেন অভিষেক
রামমোহন যে এসব সমালোচনামূলক কথা শুধু তাঁর যুক্তিবাদী গদ্যে লিখে গেছেন, তা-ই নয়, নিজের জীবন দিয়ে এঁর বিরোধিতা করে গেছেন তিনি, তাঁর পারিবারিক জীবনেই ‘আপনি আচরি ধর্ম’ একথা বুঝিয়ে ছেড়েছেন। রামমোহন রায়ের প্রদৌহিত্রী হেমলতা দেবীর কথা থেকে ঘরোয়া ব্যাপারে রামমোহনের ব্যবহার ও আচার আচরণের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানেও মহিলাদের প্রতি একদিকে যেমন শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রমের ছবি পাই, অন্যদিকে নানা বিষয়ে মহিলাদের অধিকার স্থাপনের জন্য তাঁর প্রয়াসের কথা জানা যায়। বাড়িতে বিশ্রামের জন্য এলে তিনটে চেয়ার পাতা হত, তাঁর আর তাঁর দুই স্ত্রীর জন্য। যতক্ষণ না আগে মহিলারা বসছেন, দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি। এই ব্যাপারটা সেই সময় ছিল অভূতপূর্ব, অন্দর থেকে অনেকেই উঁকি দিত আর পরস্পর বলাবলি করত, ‘‘দেখ দেখ, কর্তা দেওয়ানজি দাঁড়িয়ে আছেন, বসবেন না, স্ত্রীরা না বসলে’’।
রামমোহনের নাতনি চন্দ্রজ্যোতির বিয়ে হয় শ্যামলাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতার বাড়িতে। এই বিয়েতে কন্যা সম্প্রদান করেন রামমোহনের পুত্রবধূ যজ্ঞেশ্বরী দেবী। রামমোহন নিজে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাইরে। উনিশ শতকে দাঁড়িয়ে এক নারীকে কন্যাসম্প্রদানের জন্য মনোনীত করার এই সিদ্ধান্তের মধ্যে শুধু নারীর রক্ষাকর্তা রামমোহনই নন, রয়ে গেছেন নারীর সমানাধিকারের পক্ষ নিয়ে দাঁড়ানো রামমোহন। এই চন্দ্রজ্যোতিই বলেছিলেন যে রামমোহন তুলে দিয়েছিলেন কুলগুরু প্রথা, ঘরের মেয়েদের শিখিয়ে দিলেন ব্রহ্মমন্ত্রে উপাসনা আর গায়ত্রী জপ। যে গায়ত্রী মন্ত্র মেয়েদের কানে শোনাও ছিল নিষিদ্ধ, তিনি চালু করেদিলেন ঘরের মধ্যে মেয়েদের দিয়ে, ধর্ম সংস্কারে মেয়েদের বড় অধিকার পাওয়ার পথ খুলল প্রথম।
আরও পড়ুন-২০২৪-এর মাধ্যমিক পরীক্ষা কবে? জানাল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ
কিন্তু রামমোহনের এই বিপুল কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন ইতিহাসনিষ্ঠ থেকে আমরা করতে পেরেছি আর কই? আমাদের স্বভাবই এই, যা কিছু আমাদের মাপে আঁটে না, তাকে হয় দেবতা, নয় পিশাচ বানিয়ে দাও। রামমোহনকে নিয়ে বাঙালির বিস্ময়েরও খানিক সেই দশা। তাঁর কর্মজীবন পর্যালোচনা করার দুরূহতাকে পাশ কাটাতে গিয়ে, বারবার হুজুগে বাঙালি পড়ে থেকেছে তাঁর মোগলাই মেজাজ, খানদানি পোশাক কিংবা রাজকীয় চালচলন নিয়ে। রামমোহন নাকি একবারে আস্ত পাঁঠা খেতে পারতেন, রোজকার মেনুতে থাকত পঞ্চাশটা আম, এককাঁদি নারকেল আর বারো সের দুধ। তাঁর পুত্র রমাপ্রসাদ আর পুত্রবন্ধু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি ছেলেবেলায় তাঁকে দোলনায় বসিয়ে দোল দিতেন তাঁরই অনুরোধে। তাঁর প্রচুর সরষের তেল মেখে স্নান করা, কিংবা পড়াশোনার সময় যাতে উঠতে না হয়, তাই গোলটেবিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পছন্দসই বই তুলে নেওয়ার হরেক গালগল্পের আড়ালে আসলে চাপা পড়ে গেছে এই বিপুল ব্যক্তিত্বের বিপুলতর কর্মযজ্ঞের খতিয়ান। কিন্তু ইতিহাস তো খতিয়ানের ধার না রেখেই ভবিষ্যতের দিকে ঝুঁকে পড়ে বারবার, তাই রামমোহনের মাপে তাঁকে যাচাই করার ক্ষমতা না থাকলেও, অনেক ঝড়ঝাপটার শেষে মেয়েরা আজ অর্ধেক আকাশ জুড়ে যে ডানা মেলে দিল, সে-আকাশ তাঁরই গড়ে দেওয়া। অস্বীকৃতি কিংবা বিস্মৃতিতে সে-সত্যকে মুছে ফেলা যায় না।