আধুনিক যুগে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে বিজ্ঞান-গবেষণা— অনেকটাই তথ্য (ডেটা) নির্ভর। তেমনি সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে আবহাওয়া, সমুদ্র, পরিবেশ ইত্যাদি বিজ্ঞানের গবেষণাগার হচ্ছে জল-স্থল সমেত সমগ্র বায়ুমণ্ডল। যার বিভিন্ন উপাদান, স্থানকালের সাপেক্ষে পরিমাপ করা, কোনও ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে দূর-অনুভূতি (রিমোট সেন্সিং) উপগ্রহ। যে কারণে রিমোট সেন্সিং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিয়েছে। পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দূর থেকে করা হয় না। পরিবেশ, আবহাওয়া ও সমুদ্রবিজ্ঞানেও অনেক তথ্য যন্ত্রের কাছে এসেই (ইন সিটু) নেওয়া হয়। কিন্তু এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে মানুষ বা যন্ত্রের পক্ষে পৌঁছনোই মুশকিল। সেসব জায়গায় বিজ্ঞানের তত্ত্ব, কক্ষপথের তারতম্য ও দূর-অনুভূতি উপগ্রহ ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
আরও পড়ুন-বাঙালিকে জুড়তে বড় উদ্যোগ চিকিৎসকের
দূর-অনুভূতি বা রিমোট সেন্সিং
আমরা চোখ দিয়ে দেখি (আলোক তরঙ্গ) ও কান দিয়ে শব্দ (তরঙ্গ) শুনি আর ক্যামেরা দিয়ে ফটো তুলি। এগুলি সবই তরঙ্গনির্ভর অনুভূতি। পরিবেশ, বনসৃজন, জলরাশি, আবহাওয়া ইত্যাদির ক্ষেত্রে সাধারণ ক্যামেরাও একটি দূর-অনুভূতি যন্ত্র (ভিসিবল)। আকাশে মেঘের ছবিও (পিকচার) একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা আলোক (অপটিক্যাল) তরঙ্গের উপর নির্ভরশীল। শুধু দিনের আলোতেই ছবি তোলা যায়। বেশিরভাগ দূর-অনুভূতি যন্ত্রগুলো তাপের (থার্মাল) নিঃসরণ তরঙ্গের ওপর নির্ভরশীল। কোনও পদার্থের তাপমাত্রা সবসময় চরম শূন্যের ওপর হয়। তাই বিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী তাপ নিঃসরণ সবসময় হতে থাকে এবং বিশেষ ক্যামেরা দিয়ে থার্মাল পিকচার দিনরাত পাওয়া যায়। এদের ইনফ্রারেড ক্যামেরা, রেডিওমিটার বা স্পেকট্রোমিটার বলে। নানা ধরনের ইনফ্রারেড ক্যামেরা আছে, যেমন নিয়ার ইনফ্রারেড, মিড ওয়েভ ইনফ্রারেড, শর্ট ওয়েভ ইনফ্রারেড, থার্মাল ইনফ্রারেড এবং মাইক্রোওয়েভ। এদের মধ্যেও আবার বিভিন্ন ভাগ আছে। এই সমস্ত বিশেষ বিশেষ তরঙ্গের ক্যামেরা দিয়ে, দূর থেকে উপগ্রহের মাধ্যমে মেঘ, কুয়াশা, মাটি, জল, গাছপালা, সমুদ্রের তাপমাত্রা, দাবানল ইত্যাদি নির্ধারণ ও পর্যবেক্ষণ করা হয়। বায়ুমণ্ডলের উলম্ব দিকে বিভিন্ন স্তরের তাপমাত্রা মাপার জন্য থার্মাল ইনফ্রারেডকে অন্তত ২০ ভাগে ভাগ করা হয়। বিভিন্ন উচ্চতায় মেঘের তাপমাত্রা এর সাহায্যে নির্ণয় করা হয়। উপগ্রহে প্রয়োজন অনুযায়ী থার্মাল ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন-মেঘালয়ে ভূমিকম্প, কম্পন অনুভূত হয়েছে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে
রিমোট সেন্সিং উপগ্রহ
বস্তুত জনহিতকর বা হানিকর নয় এমন জনপ্রিয় কাজে, কক্ষপথের উচ্চতার নিরিখে মোটামুটি ৩ ধরনের উপগ্রহের ব্যবহার করা হয়। এগুলি হল জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) স্যাটেলাইট ও সান সিনক্রোনাস স্যাটেলাইট। ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা অনুযায়ী উপগ্রহের কক্ষপথের (প্রায় বৃত্তাকার) ব্যবহার করা হয়।
আরও পড়ুন-‘বিজেপিকে আবার চ্যালেঞ্জ করছি’ সাংবাদিকদের মুখোমুখি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
জিওস্টেশনারি উপগ্রহ
যখন অনেক বেশি দূরত্বের যোগাযোগ অথবা ভূপৃষ্ঠের অনেক বড় জায়গার ছবি নিতে হয় তখন বিষুবরেখার কাছাকাছি জিওস্টেশনারি উপগ্রহ ব্যবহার করা হয়, যার উচ্চতা প্রায় ৩৬০০০ কিমি। এটি আপাতভাবে বিষুবরেখার ওপর একই জায়গায় অবস্থান করে এবং একটি মাত্র উপগ্রহ এক-তৃতীয়ংশ পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বা মেঘের ছবি নিতে পারে। এর সাহায্যে ফোন, টিভি, ইন্টারনেট, আবহাওয়া, কৃষিক্ষেত্র-সহ পরিবেশ-সংক্রান্ত নানা কাজ ব্যাপকভাবে করা হয়। কিন্তু দুই মেরু অঞ্চলের কাজ বা তথ্য সংগ্রহ করা জিওস্টেশনারি উপগ্রহের পক্ষে অসুবিধাজনক। কারণ পৃথিবীর ঘূর্ণনগত কারণে মেরু অঞ্চলের কাছে জিওস্টেশনারি উপগ্রহের অবস্থান করানো প্রায় অসম্ভব।
আরও পড়ুন-প্রধানমন্ত্রী পালটানোর সময় এসেছে, দিল্লিতে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ উগরে দিলেন অভিষেকের
জিপিএস উপগ্রহ
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস উপগ্রহ, প্রায় ২২০০০ কিমি উচ্চতায় ২৪টি মেরুমুখী গতিসম্পন্ন উপগ্রহপুঞ্জ, মাছধরা জালের মতো বিস্তৃত হয়ে পৃথিবীকে আগলে রেখে প্রদক্ষিণ করে। আর পৃথিবীর ঘূর্ণনগতিকে কাজে লাগিয়ে এমন ভাবে প্রদক্ষিণ করে যে, পৃথিবীর ওপর যে কোনও জায়গায় যে কোনও সময়ে অন্তত ৪টি উপগ্রহের নজরে থাকে। অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় অবস্থানের জন্য জিপিএস, অঙ্কের ত্রিকোণমিতির সূত্র প্রয়োগ করে এই ৪টি উপগ্রহ কোনও বস্তুর অবস্থান নিখুঁতভাবে নির্ণয় করে। নানা ডিজিটাল মানচিত্র কোম্পানি ত্রিমাত্রিক অবস্থান-সহ কোন দিক দিয়ে কত দূর যেতে হবে তা নির্দেশ করে। যে কারণে বিমান, জাহাজ ও গাড়ি চলাচলে বা কোনও অচেনা জায়গায় যাতায়াত খুব সহজ হয়ে গেছে। উন্নত দেশে এর ব্যবহার এতই যে, কখনও জিপিএস বন্ধ হলে গাড়ির যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবে। দিনের আলো থাকলেও গাড়ির চালক রাস্তা খুঁজে পাবেন না! বর্তমানে এর সাহায্যে বিভিন্ন গাড়িচালক সংস্থা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সারা পৃথিবীতে ভাড়া করা গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করছে, আমাদের দেশেও এটা ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছ। জিপিএসের সাহায্যেও ফোন, ইন্টারনেট, টিভি, কৃষিকাজ, পরিবেশ ও আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি আরও ভালভাবে করা সম্ভব। মেরু অঞ্চলের জন্য এটি আদর্শ। কিন্তু ব্যয়বহুল।
আরও পড়ুন-লজ্জা! অভিষেককে রুখতে শাহের পুলিশের ‘গুন্ডামি’
সূর্য সমন্বয় উপগ্রহ
ইদানীং খুব অল্প উচ্চতায় (৩০০ থেকে ১৫০০ কিমি) সূর্য সমন্বয় মেরুমুখী উপগ্রহের ব্যবহার খুব বেড়ে গেছে। এই উপগ্রহ দিনের সময় কাজের জায়গায় আসে এবং সূর্যের আলোয় অল্প উচ্চতার জন্য খুব নিখুঁতভাবে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করতে পারে। সৌরবিদ্যুৎ সংগ্রহ করে রাতেও কাজ করতে পারে। এটিও পৃথিবীর ঘূর্ণনকে কাজে লাগিয়ে একাকী মেরুপ্রান্ত-সহ সমস্ত পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করতে পারে। তবে কোনও বিন্দুতে দ্বিতীয় বার আসতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৪ দিন। এই ধরনের উপগ্রহ-সংখ্যা বাড়িয়ে উপরে বর্ণিত যে কোনও কাজ শিল্পীর (স্টেট অফ দি আর্ট) মতো করতে পারে। এর সাহায্যে খরা, বন্যা, দাবানল, কৃষিকাজ, যুদ্ধক্ষেত্রে, পর্বত আরোহণে, পাহাড়ে ধস, হিমবাহ ইত্যাদি নানা কাজে ব্যবহার হচ্ছে। বিশ্বের এক ধনী ব্যক্তি মহাকাশে এই কক্ষে কয়েক হাজার উপগ্রহ পাঠিয়ে একটি অভাবনীয় অতি-দ্রুত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা সরাসরি গ্রাহকের কাছে সারা পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় পৌঁছে দিতে চলেছেন।