পাঁচ বছর আগে, কোভিডকালে মুক্তি পেয়েছিল ‘পাতাললোক’। অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল সিরিজটি। এতদিন পর মুক্তি পেল ক্রাইম থ্রিলারের দ্বিতীয় সিজন। প্রাইম ভিডিও-য়। সিরিজটি দেখতে বসার আগে স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জেগেছিল, আখ্যান-কাঠামো আগের মতো রেখে চরিত্রের বদল ঘটিয়ে একের পর এক হয়ে চলা তদন্তের মাঝে ‘পাতাললোক : সিজন ২’ (Paatal Lok – Season 2) কি আদৌ দর্শককে নতুন কিছু দিতে পারবে? এই সিজনে কাহিনি দিল্লির সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছে দেশের উত্তর-পূর্বে। প্রেক্ষাপট নাগাল্যান্ড। যদিও সংঘটিত অপরাধের প্রাথমিক সূত্র আটকে রয়েছে দিল্লিতে। ৮ পর্বের সিক্যুয়েলে একদিকে নাগাল্যান্ডের কুয়াশাচ্ছন্ন, রহস্যময় ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং অন্যদিকে দিল্লির কোলাহলপূর্ণ দৃশ্যপট দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সুদীপ শর্মার তৈরি এবং অবিনাশ অরুণ ধওয়ারে পরিচালিত এই সিরিজে আগের সিজনের মতোই দেখানো হয়েছে বৃহত্তর জটিলতা, আবেগের ভার। কী আছে গল্পে? প্রথম সিজনের মতো দ্বিতীয় সিজনেও গল্পের বড় অংশ হাতিরাম এবং তাঁর এক রহস্য থেকে আর এক রহস্যে জড়িয়ে পড়ার অদ্ভুত সংযোগকে ঘিরে ডানা মেলেছে। পরিবার এবং জীবিকার দ্বন্দ্বে জর্জরিত হাতিরামের থানায় হঠাৎ এসে হাজির হন এক মহিলা। বছর পাঁচেকের একটি ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। কিছু দিন ধরে তাঁর স্বামী রঘুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। থানার অন্য পুলিশেরা মহিলাকে পাত্তা না দিলেও, হাতিরাম ন্যায়নিষ্ঠ, বালক গুড্ডুর বাবাকে তিনি উদ্ধার করে আনবেনই। অন্য দিকে দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য নাগাল্যান্ড বিজনেস সামিটের আগের দিন ঘটে যায় এক ভয়ঙ্কর হত্যা। গুড্ডুর বাবাকে খুঁজতে বেরিয়ে হাতিরাম সন্ধান পান এমন কিছু বিষয়ের, যা প্রভাব ফেলতে পারে দিল্লি এবং নাগাল্যান্ডের সম্পর্কে। একগুঁয়ে পুলিশ ইনস্পেক্টরটির সহকারী বা বন্ধু সাব-ইনস্পেক্টর আনসারি ফিরে আসেন আইপিএস হয়ে এসিপি অবতারে। গল্প এগোয় মাদকচক্র, অর্থনীতি, রাজনৈতিক টানাপড়েন, ঔদ্ধত্য এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। এই গল্প শুধু রহস্যের উন্মোচন করে না, অনুসন্ধান করে উত্তর-পূর্ব ভারতের অতীত এবং বর্তমান, দলীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ এবং নেতৃত্বের ঠিক-ভুল-জাতীয় বহমান সমস্যাগুলির শিকড়ের।
ক্রাইম থ্রিলার জঁরের সুবিধা এবং অসুবিধা দুটিই হল মূলত গল্পের চলন। কাহিনির গাঁথুনি যদি বেগবান এবং ফাঁকহীন হয়, তবে সেটিই দর্শককে টেনে নিয়ে যায় এক রহস্য থেকে আর এক রহস্যের কিনারায়। অবিনাশ দক্ষ পরিচালক, ক্রাইম থ্রিলার জঁর তাঁর দক্ষতার ক্ষেত্র।
আরও পড়ুন- সাধারণতন্ত্র দিবসে চমক! ‘রোবোটিক মিউলস’ এবার কলকাতায়
দ্বিতীয় সিজনে (Paatal Lok – Season 2) দুটি নতুন চরিত্রের প্রবেশ ঘটেছে। এর মধ্যে একজন হলেন মেঘনা বরুয়া। অভিনেত্রী তিলোত্তমা সোম অভিনীত এই চরিত্রটি একক মায়ের। সেই সঙ্গে নাগাল্যান্ডের এসপি-র দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। আর অন্য চরিত্রটি হল রোজি লিজো। ইনি আসলে জোনাথন টমের মাদকাসক্ত সঙ্গিনী। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন মেরেনলা ইমসং।
সব কিছুর কেন্দ্রে রয়েছেন জয়দীপ অহলাওয়াত। হাতিরাম চরিত্রে তিনি এককথায় অতুলনীয়। এই চরিত্রটির ক্লান্তি, হতাশা এবং অধ্যবসায়কে সাবলীল ভাবে নিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। যা দর্শকদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। তিনি যেন আরও ক্ষুরধার, আরও বেশি করে বাস্তব হয়ে উঠেছেন। প্রতি মুহূর্তে তাঁর অভিনয় দক্ষতা যেন তাঁর আগের উদাহরণগুলিকেও ছাড়িয়ে গেছে। শরীরের প্রতিটি অংশকে ব্যবহার করেছেন নিখুঁত ভাবে।
অন্যদিকে ইমরান আনসারি হিসেবে ঈশ্বক সিংও দুর্ধর্ষ। নিজের চরিত্রটির একাধিক স্তর তিনি দারুণ ভাবে জীবন্ত করেছেন। পাশাপাশি অনবদ্য অভিনয় করেছেন পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। তিলোত্তমা সোমের চরিত্রে মেঘনা বরুয়া তো অসাধারণ বললেও কম বলা হয়। আবার মেলেনলা ইমসংয়ের রোজি লিজোও নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। বড় চরিত্রের পাশাপাশি ছোটখাটো চরিত্রগুলির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য গভীরতা দেখা গিয়েছে। যেমন ড্যানিয়েল চরিত্রে প্রশান্ত তামাঙ্গ, সিলাস চরিত্রে অ্যারিয়েন্সা লঙ্গচার, বিট্টু রহমান চরিত্রে প্রতীক পচৌরি, গ্রেস রেড্ডি চরিত্রে থেয়ি কেদিতসু, এসএইচও ভির্ক চরিত্রে অনুরাগ অরোরা, কনস্টেবল মঞ্জু ভার্মা চরিত্রে নিকিতা গ্রোভার, গুড্ডু পাসওয়ান চরিত্রে রকিবুল হোসেইন, রিউবেন টম চরিত্রে এলসি সেখোজ, আইজ্যাক চরিত্রে বেনডাং ওয়ালিং অথবা সতবীর ব্রার চরিত্রে পালি সান্ধু।
দৃশ্যপটের দিক থেকেও ‘পাতাললোক : সিজন ২’ (Paatal Lok – Season 2) যথেষ্ট সফল। এই সিজনের সিনেম্যাটোগ্রাফি প্রশংসনীয়। চিত্রনাট্য মেদহীন। কোনও বাড়তি দৃশ্যের অবতারণা নেই। সংলাপ, আবহসঙ্গীত এবং চিত্রগ্রহণও এগিয়েছে ব্যাকরণ মেনে। একটি বাণিজ্যিক ক্রাইম থ্রিলারের ঠিক যেমনটি হওয়া উচিত, তার সব উপাদান মাপসই ভাবে হাজির এই সিরিজে। শেষ পর্যন্ত টানটান রোমাঞ্চ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। তবে ‘পাতাললোক সিজন ২’-কে একেবারেই নিখুঁত বলা যায় না। প্রথম সিজন-এর দুর্ধর্ষ খলনায়ক ত্যাগীকে এই সিজনে দেখা যায়নি। ফলে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে। এটুকু অপ্রাপ্তি বা ত্রুটি সরিয়ে রাখলে ‘পাতাললোক : সিজন ২’ সসম্মানে উত্তীর্ণ, জোর দিয়ে বলাই যায়।