ভারতবর্ষের এক প্রত্যন্ত, পিছিয়ে-পড়া, ছোট্ট সরল গ্রাম। সেই গ্রামটি ইদানীং এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে তাদের বাসিন্দাদের কথা, তাদের মজার বুলি, দেহাতি চালচলন সবটা সবার মুখে মুখে। সেই গ্রামে যে-ই যান সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধা পড়ে যান ঠিক যেমনটি আটকা পড়েছিল নতুন পঞ্চায়েত সেক্রেটারি অভিষেক ত্রিপাঠী। গ্রামের নাম ফুলেরা। নতুন সচিব আসা ইস্তক সেখানকার পঞ্চায়েতকে ঘিরে নানান কাণ্ড-কারখানা ঘটেই চলেছিল যা বেশ উপভোগ্য। আর দর্শক তা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন। কখন যেন তাঁরাও হয়ে উঠেছেন ফুলেরার বাসিন্দাদের পরম আত্মীয়। জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’ (Panchayat 3) নিয়ে দর্শক-আবেগ এমনটাই। প্রথম এবং দ্বিতীয় মরশুমে সাড়া জাগিয়ে সম্প্রতি অ্যামাজন প্রাইমে স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে জনপ্রিয় সিরিজ পঞ্চায়েত সিজন ৩-এর।
টিভিএফের প্রযোজনায় ওয়েব সিরিজ হোক বা টেলি-শো তার কনটেন্ট সবসময় অসাধারণ হয় সেই সঙ্গে পরিবেশন, অভিনয়, কাস্টিং— সবমিলিয়ে এক চমৎকার প্যাকেজ তাঁরা দশর্কদের উপহার দেয়। পঞ্চায়েত তেমন এক অসাধারণ কনটেন্ট-সমৃদ্ধ সিরিজ।
পঞ্চায়েত সিজন এক এবং দুই অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিল। দুটো সিজনই মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল দর্শকদের। ফিল্মফেয়ারে ওটিটি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া শুরু হয়েছিল যে বছর সেই বছরেই কমেডি সিরিজ ক্যাটাগরিতে একাধিক অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয় এই সিরিজটি। এরপর সিজন টু আসে সেটাও খুব পপুলার হয়। স্বাভাবিকভাবেই সিজন থ্রি-র দাবি করেই সিরিজটি। সেই অপেক্ষার অবসান করেই হাজির ‘পঞ্চায়েত’ সিজন ৩ (Panchayat 3)।
‘পঞ্চায়েত’ সিজন ৩ নিয়ে বলতে গেলে আগের দুটো মরশুমের কথা বলতেই হবে। এই গল্পটা শুরু হয়েছিল উত্তপ্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম ফুলেরা থেকে। গল্পের নায়ক সেই গ্রামের পঞ্চায়েত সচিব বা সেক্রেটারি অভিষেক ত্রিপাঠী। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও চাকরির ইঁদুরদৌড়ে যে পিছিয়ে পড়ে রেজাল্টের কারণে। ফলে যে চাকরিটা হাতে ছিল সেটা একেবারেই তাঁর স্বপ্নের চাকরি নয়। কিন্তু কথায় বলে না নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল এখানেও খানিকটা তেমনই হয়। একদম কর্মহীন হয়ে থাকার চেয়ে অপছন্দের চাকরিটাই বেছে নেন অভিষেক। তবে বাধ সাধে তাঁর কর্মস্থল। নতুন কাজ সম্পর্কে যা ধারণা করে অভিষেক এসেছিল ফুলেরা গ্রামে তার ঠিক উল্টো চেহারাই দেখতে পায় সে। আর তাই একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফুলেরা গ্রামে থেকেই এমবিএ-এর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু বিধি বাম, শিকে ছেঁড়ে না তাঁর ভাগ্যে। অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও সফল হয় না অভিষেক ত্রিপাঠী। এইভাবে প্রথম সিজন থেকে দ্বিতীয় সিজনের দিকে এগোয় সিরিজটি।
আরও পড়ুন- জামাইবরণ
পরবর্তীতে আমরা দেখি একটা সময় ধীরে ধীরে যে গ্রাম এবং গ্রামের বাসিন্দারা ছিল তাঁর চক্ষুশূল ছিল তাঁরাই হয়ে ওঠে মনের প্রাণের বন্ধু। গ্রাম প্রধানের সহজ-সরল মেয়ে রিঙ্কির সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। প্রথম সিজনের পঞ্চায়েত সচিব হিসেবে তার ব্যর্থতা এবং পরের সিজনে সেই ব্যর্থতা থেকে উঠে আসা সম্পর্কের সাফল্য, ইমোশনাল বন্ডিং পেরিয়ে এবার তৃতীয় সিজনে পঞ্চায়েত সেই হালকা চাল ফেলে গুরুগম্ভীর চালের দিকে এগিয়েছে। এবারের প্রেক্ষাপট রাজনীতি, ক্ষমতার লড়াই, সরকারি গলদ, ত্রুটিবিচ্যুতি ইত্যাদি।
সারা দেশে যখন নির্বাচনের উন্মাদনা তার মাঝেই ভারতবর্ষের হাজার হাজার গ্রামের সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রতিনিধিত্ব করে ফুলেরা ‘পঞ্চায়েত ৩’কে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। আগের মরশুমগুলোর নিপাট গ্রামীণ ভালমানুষী, সারল্যকে ছাপিয়ে এখন অনেকটাই পরিণত ফুলেরা গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দারাও এখন মনে প্রাণে অনেকটাই প্রাপ্তবয়স্ক। পঞ্চায়েত ইলেকশন, সরকারি প্রকল্প নিয়ে হাহাকার, অনুন্নয়ন, ক্ষমতার লড়াই, রাজনীতি, ষড়যন্ত্র, ঈর্ষা, প্রেম, সম্পর্ক সবকিছু নিয়ে বেশ জমজমাটি।
ফুলেরার একপ্রান্তে পাকা ঘরবাড়ির ভিড় আর অন্যপ্রান্তে উন্নয়নের নামে শুধুই ফাঁকা বুলি। তবে ইলেকট্রিক এলেও কিংবা সিসিটিভি লাগানো গেলেও গ্রামের রাস্তা এখনও যে কে সেই। আর সেটাই পরবর্তী পঞ্চায়েত ভোটের আগে লড়াইয়ের অ্যাজেন্ডা হিসেবে বিরোধীদের ষড়যন্ত্রের মূল উপাদান। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষগুলোর কথা তুলে ধরেছে এই সিরিজ। একটা গ্রাম পঞ্চায়েতে সেখানকার প্রধান, বিধায়ক, জেলাশাসকের কী ভূমিকা? কিংবা সরকারি সিস্টেমের গাফিলতি, গ্রামজীবনের সরলতার মাঝে রাশিকৃত জটিলতা, সমস্যা নিয়ে দীপককুমার মিশ্র পরিচালিত সিরিজ ‘পঞ্চায়েত ৩’ (Panchayat 3)। আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে নাম তোলার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে যে ষড়যন্ত্র চলে, সিরিজে সেই কাহিনিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জিতেন্দ্র কুমার, রঘুবীর যাদব, নীনা গুপ্তা, চন্দন রায়, ফয়জল মালিকদের মতো স্টার কাস্টই এই সিরিজের আসল ইউএসপি। এছাড়া এই সিজনে অনেকগুলো উল্লেখনীয় নতুন চরিত্র এনেছেন পরিচালক। যেমন আম্মা জি, বম বাহাদুর, জগমোহন, গণেশ প্রমুখ। প্রধান এবং প্রধানের স্ত্রীর চরিত্রে অনবদ্য রঘুবীর যাদব আর নীনা গুপ্তা। জিতেন্দ্রকুমারকে নিয়ে আলাদা করে বলে দিতে হয় না। বিধায়কের ভূমিকায় পঙ্কজ ঝা অনবদ্য। সিরিজের সঙ্গীত পরিচালক অনুরাগ সাইকিয়া। সিনেমাটোগ্রাফি এবং এডিটিংয়ে রয়েছেন অমিতাভ সিং এবং অমিত কুলকার্নি। কমেডি এবং সারল্যের মোড়কে গুরুগম্ভীর বিষয়কে কীভাবে তুলে ধরতে হয় সেটাই দেখাল ‘পঞ্চায়েত ৩’। দর্শকদের নতুন করে মোহাচ্ছন্ন করল, ভাসিয়ে নিয়ে গেল।