‘অপরাজিত’র (Aparajito) তুমুল সাফল্যের জন্য অভিনন্দন প্রথমেই। ছবিটি আসলে ‘দ্য মেকিং অফ আ মাস্টারপিস’। অর্থাৎ চরিত্রগুলোর আদল ছিল সামনে। শুধু তাই নয়, বহু চর্চিত, বহুল পরিচিত। আপনার চরিত্রটি করতে কী কী প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
সায়নী : ‘অপরাজিত’তে (Aparajito) অভিনয়ের জন্য আমি প্রায় এক বছর বাদে ক্যামেরা ফেস করেছি। মাঝখানে একটা বড় বিরতি গিয়েছিল আমার রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে। তাই ‘অপরাজিত’য় (Aparajito) বিজয়া রায়ের চরিত্রটা করার জন্য অনেকটা সময় পেয়েছি ভাবনা-চিন্তার। আর অনীকদাও প্রচুর গাইড করেছেন। অনেক তথ্য দিয়েছেন। আসলে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়, ভিস্যুয়াল মেটিরিয়ালও প্রচুর আছে, বিজয়া রায়ের ক্ষেত্রে সেটা খুবই কম। অনীকদার মুখ থেকে আমি শুনেছি, অনীকদা আবার কারও থেকে শুনেছেন এভাবে হয়েছে, এছাড়া সন্দীপ রায় আমাদের অনেক গাইড করেছেন, হেল্প করেছেন বাবা-মায়ের মধ্যেকার সম্পর্কের কথা বলে। এসব থেকেই একটা কাঠামো তৈরি করেছিলাম আমরা। একই সঙ্গে সিন অনুযায়ীও ডিসিশন নিতাম।
অপরাজিত অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়েই গল্প। সেখানে বিজয়া ওরফে বিমলা রায়ের চরিত্রে অভিনয় তো শুধু সীমিত তথ্য-প্রমাণের জন্য নয়, অভিনেতা হিসেবেও ভীষণই চ্যালেঞ্জিং ছিল নিশ্চয়ই?
সায়নী : ভীষণ। যেহেতু জিতু সবার কাছে দারুণ একটা রিফ্রেশিং চেঞ্জ আর ওই প্রধান চরিত্র তাই আমি চেষ্টা করেছিলাম বেস্ট সাপোর্টিং চরিত্রটা হতে। কোনওভাবেই আমার অভিনয় যাতে ওর চরিত্রকে ছাপিয়ে না যায় ভীষণ কেয়ারফুল থাকতাম। কারণ বাস্তব জীবনেও তো তাই ই ছিল। সত্যজিৎ রায় ছিলেন দারুণ একজন পাওয়ারফুল চরিত্র, সেখানে বিজয়া রায় তাঁর সাপোর্ট হিসাবেই থেকেছেন আজীবন। আবার সেই সাপোর্টটা এতটা ইন্সট্রুমেন্টাল, এত রকমভাবে যে উনি ‘পথের পাঁচালী’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সেটাও ফুটিয়ে তোলার দরকার ছিল। ছবিটা দেখার পর অনেকে আমাকে বলেছেন, বিজয়া রায়ের চরিত্র সম্পর্কে এতটা ওদের ধারণা ছিল না। ফলে অনেক দায়িত্বশীল হতে হয়েছিল প্রতিটা শট দেওয়ার সময়।
অভিনেত্রী সায়নীর কাছে জানতে চাই একটি নতুন চরিত্র আর এমন চরিত্র যা কারও আধারে তৈরি দুটোর মধ্যে কোনটা বেশি চ্যালেঞ্জিং?
সায়নী : অ্যাজ অ্যান অ্যাক্টর আমি সবরকম চরিত্রই করতে চাই। প্রতিটা নতুন চরিত্রই আমার কাছে চ্যালেঞ্জিং। আমি গুরুত্ব দিই কনটেন্ট-এর ওপরে। কীভাবে চরিত্রটাকে বোনা হচ্ছে ও গল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে চিত্রনাট্য, পরিচালক, প্রোডাকশন হাউজও ইম্পর্ট্যান্ট। কীভাবে দেখানো হবে চরিত্রটাকে তা যেহেতু এদের হাতে থাকে। অভিনেত্রী হিসেবে আমার শুধু লোভ থাকে ভাল চরিত্র পাওয়ার জন্য।
জিতুর অভিনয় প্রত্যেকে একবাক্যে বলেছেন অসাধারণ। ওর ডেডিকেশন, যত্ন সবার প্রশংসা পেয়েছে। ওর সঙ্গে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কেমন?
সায়নী : আমার অভিনয়ের সিংহভাগটাই জিতুর সঙ্গে। কাজেই আমাদের বোঝাপড়াটা দারুণ হওয়ার দরকার ছিল। প্রতিটা সিনের আগে আমরা আলোচনা করতাম কোন সিনটা কেমনভাবে যাব। আমাদের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর উৎসবদা গাইড করতেন খুব। অনীকদা তো ছিলেনই। ঘরের মধ্যেকার সিন বা থিয়েটারের সিনগুলো তো ছিলই তা ছাড়াও প্রচুর লোকেশন ঘুরে ঘুরে আমরা শ্যুট করেছি। তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে অভিজ্ঞতাটা আরও অন্যরকম ছিল।
আরও পড়ুন: কৃষকঘাতী মোদি সরকার আর নেই দরকার
কেন?
সায়নী : সেই সময় বাই-ইলেকশনের ক্যাম্পেন চলছিল। প্রচারের চাপ ছিল সাংঘাতিক রকম। ওদিকে শ্যুটিং-এর শিডিউলও হঠাৎ হঠাৎ চেঞ্জ হচ্ছিল। কাশবনের সিন , ড্রিম সিকোয়েন্সের সিন শ্যুট করতে আমায় পরপর তিনদিন বোলপুর ট্রাভেল করতে হয়েছিল। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে প্রথম দিন লোকেশন ধুয়ে গেল। পরদিন ফের গেলাম। সে সময়টায় আমি স্থল-জল-আকাশ পথে সব রকমভাবে ক্যাম্পেন করতাম নানা জায়গায়। একদিন কোচবিহার তো পরের দিন নদীয়া, তারপর দিন সুন্দরবন, পরদিন ফের খড়দা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা ছিল, সে-সময় প্রচারের কাজে আমি ত্রিপুরা গিয়েছিলাম আর ওখানে আনওয়ান্টেড ঘটনায় আমায় গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল। প্রচার সেরে পরদিন সকালে কলকাতা ফেরার জন্য ব্যাগ গুছোচ্ছি, শ্যুটিং আছে সেদিন, সে-সময় শুনলাম আমায় অ্যারেস্ট করা হবে। আমার মনে আছে প্রথম ফোন আমি বাবা-মাকেও করিনি। করেছিলাম অনীকদাকে! কারণ একটা দিনের শ্যুট ভেস্তে যাওয়া মানে কতটা ক্ষতি তা যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন!
অভিনয়ের জন্য এটা তো মারাত্মক টেনশনেরও?
সায়নী : অবশ্যই। আমি তো অনীকদাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি আছি তো এরপরও ছবিটায়? অনীকদা শান্ত করে বলেছিলেন, সব মিটিয়ে আগে ফিরে এস। তারপর বাকি সব ভাবা যাবে। প্রোডাকশন হাউসকেও হ্যাটস অফ। একমাস পর ফের ওই সিন রিক্রিয়েট করে শ্যুট হয়েছিল।
কোথায় কোথায় শ্যুট হয়েছিল?
সায়নী : শ্যুট তো প্রচুর জায়গায় হয়েছিল। বোলপুরে যেমন কাশবনের দৃশ্যগুলো হয়েছিল, পুর্ব বর্ধমানের কিছু কিছু জায়গায়, এ-ছাড়া কলকাতার মধ্যে প্রচুর জায়গায়, যেমন, পুরনো বাড়ি, থিয়েটারের মঞ্চ ইত্যাদি।
এ ছবি কি সায়নী ঘোষকে অভিনেত্রী হিসেবে অনেকটা সমৃদ্ধ করল?
সায়নী : অবশ্যই। যাঁরা ছবিটা দেখেছেন, অনেকেই বলেছেন আমাকে চরিত্রটায় খুব সাবলীল দেখিয়েছে। আমার বারো বছরের অ্যাক্টিং কেরিয়ারে অবশ্যই এই চরিত্রটা বড় পাওনা। অনীকদাকে সবার আগে এ জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই যে উনি এই চরিত্রটার জন্য আমাকে ভেবেছিলেন। তবে আমি যাঁদের সঙ্গে এ-যাবৎ কাজ করেছি প্রত্যেককেই কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই কারণ তাঁরা সকলেই কোনও না কোনও ভাবে আমায় সমৃদ্ধ করেছেন।
সরকারি হলে এ-ছবির মুক্তি নিয়ে আপনি জোরালো সওয়াল করেছেন? সদর্থক কিছু রেসপন্স পেয়েছেন এখনও অবধি?
সায়নী : পাইনি। তবে আশা রাখি পেয়ে যাব। বাকি সব জায়গাতেই আমাদের ছবির হল ও শো-এর সংখ্যা এর মধ্যেই প্রচুর বেড়ে গেছে। আমি বিশ্বাস করি সরকারি হলগুলোও ‘অপরাজিত’কে (Aparajito) শো দেবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সত্যজিৎ রায়ের ওপর জাস্টিস করতে চাইলে বা ওঁর ছবি যাঁরা ভালবাসেন তাঁদের প্রতি জাস্টিস করতে চাইলে নন্দনেও এই ছবির শো পাওয়া উচিত। এটা যাঁরা কমিটিতে আছেন ওখানে তাঁদেরই দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত নিতে হবে।