নবদ্বীপের বারোজন বন্ধুর হাত ধরে দুর্গা যেদিন পরিবারের গণ্ডি ছেড়ে পাড়ায় এল সেদিন থেকেই তার সর্বজনীন হয়ে বিশ্বজনীনের দিকে চলা শুরু হয়েছিল। সময়টা ইতিহাসবিদদের কথায় সপ্তদশ শতকের শুরুর দশক। জোব চার্নক তখনও গত জন্মের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেননি। বাংলা-সহ উত্তর-পশ্চিম ভারত মুসলিম শাসক অধীনে। ছোট রাজা এবং বড় জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো হত সাবেকি ধারায়, ঠাকুর দালানে বা পুজোবাড়িতে।
আরও পড়ুন-বাংলার ঐতিহ্যবাহী শোলা শিল্প
নিমন্ত্রিত থাকত গাঁয়ের মানুষ, আসত আত্মীয়স্বজন। বাড়ির মেয়ে-বউদের বানানো নাড়ু-নিমকির সম্ভারে, ছোটদের তুলে আনা ফুলে, ঠাকুমার গাঁথা মালায় একচালার প্রতিমার টানা টানা চোখ উজ্জ্বল হয়ে থাকত। নবদ্বীপে শুরু হওয়া বারোয়ারি দুর্গাপুজো সময়ের স্রোতে ছড়িয়ে পড়ে জেলা থেকে রাজধানীতে। অবশ্য ততদিনে পেরিয়ে গিয়েছে তিনটে শতক। বারোয়ারি দুর্গাপুজো সর্বত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পারিবারিক পুজো কমতে থাকে কারণ সময়ের সঙ্গে রাজা জমিদারদের বৈভবে ঘাটতি আসে সঙ্গে পুজোর জৌলুসের বিভবপার্থক্য কমে আসে। সাবেকিয়ানার খোলস ছেড়ে দুর্গাপুজো হয়ে ওঠে গণ-অনুষ্ঠান। আর শুরু হওয়ার পর একটি শতক নানা বৈচিত্রের মধ্যে দিয়ে পেরিয়ে দুর্গাপুজো এখন বাজার অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা এক বাহারি পণ্য যার প্যাকেজিং, অ্যাডভার্টাইজিং, মার্কেটিং সবটাই দক্ষ হাতে নিয়ন্ত্রিত। প্ল্যানিং, অর্গানাইজিং, লিডিং, স্টাফিং অ্যান্ড কন্ট্রোলিং-এর বাহারি ছন্দে ধর্মের পাশপাশি ইকোনোমিক্সের সঙ্গে দুর্গা মিক্স হয়ে গিয়েছে কবেই। একটা সময় পুজোর সাজ নিয়ন্ত্রিত হত তাঁতির সুতোয়, নাপতেনির আলতা চুপড়িতে কিংবা সেজো কাকিমার তাক লাগানো সাতগুছি খোঁপায়। কাঁটা যেটুকু থাকত, থেকেই যেত ঘোমটার আড়ালে।
আরও পড়ুন-পুজোয় মাতুন প্যাকেজ ট্যুরে
দুর্গাপুজো এখন একটা প্রতিযোগিতা। ভাল থাকার প্রতিযোগিতা। ভাল আছি দেখানোর প্রতিযোগিতা। পুজোর চারদিন নিজেকে অনন্যা করে তুলতে মেয়েদের এখন আপ্রাণ চেষ্টা। পুজোর সাজ নিয়ন্ত্রণ করে বিউটি পার্লার কিংবা অত্যাধুনিক স্যালোঁ। পুজোর প্যাকেজই কতরকম সঙ্গে আছে চুল কাটলে ভুরু ফ্রি টাইপের অফার। নামী পার্লারে আগে থেকে স্লট বুকিং ইত্যাদি। একটি চারদিনের পুজোকে কেন্দ্র করে এমন সেজে ওঠার, সাজিয়ে তোলার প্রবণতা কোনও কিছুর সঙ্গেই তুলনীয় নয়। সাজগোজের ক্ষেত্রে বড় কমোডিটি মার্কেট আবর্তিত হয় দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। এটা একাধারে স্পট এবং ফিউচার মার্কেটের সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হতে পারে। তবে থিওরি যা-ই বলুক বাস্তব এটাই, ঝিলমিলে লুকে হিলহিলে চেহারার আধুনিক মেয়েদের বাহারি শাড়িতে ম্যানিকিওর করা হাতে পুষ্পাঞ্জলি ভালই লাগে।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
পুজো আসছে— বাতাসে শিউলি-গন্ধ কিংবা কাশের চামর দোলার আগেই বিজ্ঞাপন আসে পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা। ছোট-বড়-মেজ— সব পত্রিকারই বিশেষ শারদ সংখ্যা। বিজ্ঞাপন বেশি তাই দাম বেশি তাই কাটতি বেশি অতএব— এতে বিজ্ঞাপন বেশি এক অনবদ্য চক্র। কত যে প্রকাশনী, কত যে পুজো সংখ্যা, কত লেখক আর কত পাঠক তার হিসেব রাখা কঠিন। একটা আশার আলো ভাষার উপর পড়ে— এই শারদ সংখ্যা উপলক্ষে যে বহু সংখ্যক বাংলা লেখক ও পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে সেটা ভাষার ক্ষেত্রে মার্কেট এক্সটেনশন স্ট্র্যাটেজির এক আদর্শ উদাহরণ হতেই পারে।
আরও পড়ুন-বিশ্বভারতীতে বসল পড়ুয়াদের নিজস্ব আনন্দবাজার
পুজোর উপাচার একশো আট পদ্ম। প্রতি পুজোয় সন্ধিক্ষণে একশো আট পদ্মের সঙ্গে উচ্চারিত ওং হ্রীং শ্রীং চামুণ্ডায়ৈ নমঃ মন্ত্রে গমগম করবে পুজো মণ্ডপ। ফুল বেলপাতা, পদ্ম— গ্রাম থেকে মহিলারা, ফুলচাষিরা নিয়ে শহরে আসবে বিক্রি করতে। পুজোর ক’দিন ফল বিকোবে স্বাভাবিকের থেকে বেশি দামে। মুনাফা বাড়াতে সবার লক্ষ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে বাড়তি দু-পয়সা লাভই জীবনে আনবে এককণা বিলাসিতা— বাড়বে ক্রয়ক্ষমতা, জীবনদর্শন আবর্তিত হবে চক্রাকারে।
আরও পড়ুন-হিটম্যানের তাণ্ডবে উড়ে গেল পাকিস্তান
তোমার আলোর বেণু বাজার আগেই ভুবন মাতে বিকিকিনি-তে। টেলরের পুজোর অর্ডার নেওয়া বন্ধ একমাস আগে থেকেই। শাড়ির দোকানে লাইন। সঙ্গে এক্সেসরিজের এক্সেস চাহিদা। আরে সে-যুগ আছে নাকি, মেয়ে-বউদের একটাই লালপেড়ে তাঁতের শাড়ি কিংবা সারা বাড়ির বাচ্চাদের জন্য একই ছিটের একটা জামা! অষ্টমীর অঞ্জলিতে নতুন পরতে হয় যে! অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে এক বিশাল পরিবর্তন এসেছে জীবনশৈলীতে। একথা অনস্বীকার্য যে মানুষের হাতে এখন অর্থের জোগান অনেক বেশি। গত দশ বছরে ভারতের পার ক্যাপিটা ইনকাম প্রায় ৩৫% বেড়েছে। সামান্য একটা ভাবনা দিয়ে এই স্তরের মূল্যায়ন করা যেতে পারে— আগে পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই রোজগারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এখন মহিলারাও একসঙ্গে পা মিলিয়ে চলছেন। পরিশ্রমের ফল তো পাওয়া যাবেই আয় বাড়ছে, বাড়ছে ক্রয়ক্ষমতা। এই ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মার্কেট বড় হচ্ছে, রাজস্ব বেশি আদায় হচ্ছে। এভাবে একটা উৎসবকে উপলক্ষ করে যেভাবে মার্কেট এক্সপ্যানশন হচ্ছে তা ক্রমশ দেশের ইকোনমিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।
আরও পড়ুন-আজ চেতলায় ভার্চুয়াল চক্ষুদান করবেন মুখ্যমন্ত্রী
দেশের অন্যতম বৃহত্তম বিজনেস সেক্টর এক গ্রুপের পোশাকের রিটেল চেন কাউন্টার রিলায়েন্স ট্রেন্ডস দুর্গাপুজো উপলক্ষে বিশেষ অফার দিচ্ছে। আর এক লিডিং কোম্পানি ডিটারজেন্ট-এর প্যাকিং চেঞ্জ করছে পুজো উপলক্ষে। প্রচুর-এর মধ্যে সামান্য দুটো উদাহরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে দুর্গা এখন জাতীয় অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। স্টক মার্কেট কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দামের উপর দুর্গাপুজোর প্রভাব আছে শুনলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সারা পৃথিবীতে অনেক দেশেই যথেষ্ট উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে দুর্গাপুজো হয়। কখনও মনে হয় এটাই দুর্গার দশদিশায় ব্যাপ্তি। পুজোর প্যান্ডেল একেকটা দেখে ভাবতে অবাক লাগে কোন স্তরের শিল্পী হলে এমন কাজ সম্ভব! আগে সাদামাঠা একচালা প্রতিমা আর কাপড়ের কুঁচি প্যান্ডেলে মানুষ অভ্যস্ত ছিল।
আরও পড়ুন-৭০টি হোমিওপ্যাথি, ৪০টি আয়ুর্বেদিক, ১০টি ইউনানি, রাজ্যে খুলছে আরও ১২০টি নতুন আয়ুষ চিকিৎসাকেন্দ্র
ক্লাবের বাজেট অনুযায়ী আলোকসজ্জা। এখন বড় বড় কোম্পানির স্পনসরসিপে সরকারি অর্থ সহযোগিতায় মহানগরীর নামী ক্লাবগুলির বাজেট কয়েক কোটি ছাড়িয়ে যায়। আলোয় কাজে-সাজে চোখ ফেরানো দায়। দর্শকের এই মুগ্ধতা শিল্পীর সেরা পুরস্কার। একটা পুজো হাজার হাজার শিল্পীর পেটের ভাত জোগাচ্ছে— তার শখ মেটাচ্ছে— দিচ্ছে আর্থিক নিরাপত্তার আশ্বাস। আগে প্রতিমা ছিল মাটির— সাজ ছিল সাবেক। পরে এল একটু অন্যরকম আর্টের ঠাকুর। সবক্ষেত্রেই শিল্পীকে কুরনিশ। এখন ট্রেন্ড ইন হল থিমের ঠাকুর। একটা ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় সেখানের প্রতিমা থেকে শুরু করে পুরো পটভূমি এবং আবহ। প্যান্ডেল হচ্ছে বিখ্যাত কোনও সৌধ কিংবা প্রাকৃতিক কোনও পরিবেশের অনুকরণে। নতুন রকমের ভাবনা-চিন্তা আনার জন্য এবং সেই ভাবনাচিন্তাকে বাস্তবে রূপদান করার যে টিমওয়ার্ক এটাও একরকমের উদ্ভাবনী শক্তির প্রকাশ। এক্ষেত্রে প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট টিমকে কাজে লাগানো হচ্ছে পুরো পরিকল্পনা রূপায়ণে। নানাবিধ ক্ষেত্রে যে বিপুল খরচ সে-সবই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অর্থনৈতিক অবস্থা ও বাজারকে আরও সমৃদ্ধ করবে, চাঙ্গা করবে আবর্তনের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন-শস্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ছ’টি বিশেষজ্ঞ দল গঠন রাজ্যের
পুজোয় চাই নতুন জুতোর স্লোগানের পর এখন পুজোয় চাই নতুন বোতল। আগে অল্পবিস্তর ছিল এখন স্রোত। অফ বা অন শপে লাইন দেখলে বালাজি মন্দিরের কথা মনে পড়বে। যত উৎসব তত বোতল আর আবগারি বিভাগ তত খুশি— রাজকোষ ভরলে প্রজাদেরও লাভ বইকি। পুজোর প্রস্তুতির পর আসে ঠাকুর দেখার পালা। একেবারে গ্রামগুলো না হিসেবে আনলে, মফসসলের ঠাকুর প্যান্ডেলেও এখন দেদার ভিড়— মাঝরাতেও লাইন। মহানগরীতে একেকটা পুজোয় এত লাইন পড়ে যে তৃতীয়ায় লাইন দিলে ত্রয়োদশীতে ঠাকুর দেখা শেষ হয়! সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাবার স্টল। ফুচকা-এগরোল-মোগলাই এখন সিপিয়া অতীত— মোমো এখন চিত্তে তাতা থইথই করে নেচে চলে। সঙ্গে আরও বড় নাচিয়ে বিরিয়ানি। বাঙালির বিরিয়ানি-প্রীতি এখন সব প্রেমকে টেক্কা দিয়েছে। এমনিও বিকোয় আর পুজোয় দেদার বিকোয়। কাল ছিল বিড়ির দোকান আজ দেখি বিরিয়ানি!
আরও পড়ুন-দূরপাল্লার ট্রেনে অনলাইনে খাবার অর্ডার, যাত্রীদের সতর্ক করল রেল
এর পর আছে পুজোর রান্না। মা-খুড়ির ঘাম আর তেল-তেল মুখে সারাদিন হুকুম খাটবার যুগ শেষ। দুই কি আড়াই জনের মাইক্রো ফ্যামিলি। পুজোয় রান্না করতে হলে আনন্দ, ঘোরা-বেড়ানো হবে কী করে! তাই হোম ডেলিভারি, রেস্টুরেন্ট— চারদিনে চাররকম থালি। মার্কেট রেডি, ধরতে পারলেই হল। পুজোকে ভিত্তি করে কত বাজার। পুজোয় আর একটি জিনিসের প্রচুর ডিমান্ড— মিষ্টান্ন দ্রব্যাদি। পুজোয় লাগবে, লোক আপ্যায়নে লাগবে, খেতে লাগবে, খাওয়াতে লাগবে। বড় শিল্পের ডিমান্ড বাড়লে অনুসারী শিল্পের ডিমান্ড বাড়বেই।
ধর্ম ছাড়া সমাজ হয় না আর উপাস্য ছাড়া ধর্ম হয় না। ধর্ম যা ধরে থাকে কিংবা ধরে রাখে। আদ্যাশক্তি মহামায়া বাঙালির ঘরের মেয়ে দুর্গা ধরে রেখেছে এক বৃহত্তর বাজারকে, নিয়ন্ত্রণ করছে অর্থনীতিকে। পুজোভিত্তিক মার্কেট যেন এক ক্রমবর্ধমান ব্যাসার্ধের বৃত্ত যার কেন্দ্রে আছেন দুর্গা স্বয়ং।