‘নৃত্যের মাধ্যমে নারীজীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি’

হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের ধুলো ও ধোঁয়ার যান্ত্রিকতাময় জীবনে এক নতুন ধরনের বেঁচে থাকার আশা ও আলোর সন্ধান করেছেন ছন্দা জানা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি যেমন নানারকম প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নৃত্য শিখেছেন, তেমনই নৃত্যের শিক্ষিকা হয়ে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে স্বনির্ভর করার মাধ্যমে নৃত্যশিল্পের শক্তি ও সার্থকতা বজায় রেখেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিক্ষালয় শুধু মফস্বল নয়, মহানগরকে পর্যন্ত স্পর্শ করতে পেরেছে। ২০২১ সালে পেয়েছেন ‘নারীশক্তি’ সম্মান। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন শুভঙ্কর দাস

Must read

প্রতিবেদন : নৃত্যের প্রতি ভাললাগা কবে থেকে শুরু?
ছন্দা : অতি শৈশবকাল থেকেই নৃত্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতাম। বস্তুত জগৎ-সংসারের প্রতিটি দৃশ্যই আমার কাছে কোনও না কোনও মুদ্রা বলে মনে হয়। মহাশূন্যের গ্রহ-নক্ষত্রের সঞ্চারণ থেকে মাটিতে পিঁপড়ের সারিবদ্ধ গতিতে সেই নৃত্যের তাল লেগে আছে। দেবাদিদেব মহাদেবকে নটরাজ বলা হয়, ছোটবেলায় ক্যালেন্ডারে নটরাজের নৃত্যরত মূর্তির ছবি দেখে আমার মধ্যে আশ্চর্য আলোড়ন তৈরি হয়। সেই থেকে শুরু।
আপনার বাবা-মার কথা বলুন।

ছন্দা : খড়গপুরে আমার জন্ম। বাবা প্রথমনাথ সামন্ত ছিলেন বেলুড় মঠের সংগীতশিল্পী। মা অঞ্জলি সামন্ত। তিনি ছিলেন নাট্যসংগীত শিল্পী। মূলত তাঁদের অনুপ্রেরণায় নৃত্যের অলৌকিক জগতে প্রবেশ।
নৃত্যশিক্ষা কোন সময়ে শুরু?
ছন্দা : মাত্র দু’বছর বয়সেই রবীন্দ্রঘরানায় নৃত্যশিক্ষা শুরু। খড়গপুর রেলওয়ে স্কুলের শিক্ষিকা আরতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে প্রথম তালিম। এরপর সুষমা সাউয়ের কাছে নাচ শেখা। পরে পণ্ডিত চিত্রশঙ্করের কাছে দশবছর ‘ক্রিয়েটিভ ডান্স’ শিখেছি। একইসঙ্গে শ্রীমতী রেখা মৈত্রের কাছে ক্লাসিক্যাল নৃত্যের তালিম নিতে থাকি ৬ বছর ধরে। সেইসঙ্গে চলতে থাকে মঞ্চে নৃত্যের উপস্থাপনা। জেলা ও রাজ্যস্তরের নানাধরনের প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে নানাবিধ পুরস্কার ও সম্মান লাভ করি। এরপর কিছুটা ছেদ পড়ে।
কেন?
ছন্দা : এইসময় যখন গোপ কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করি, তখন আমার বিয়ে হয়ে যায়। হলদিয়া শিল্পাঞ্চলের রক্ষণশীল জমিদার বংশের পুত্র উৎপল জানার সঙ্গে। ফলে খড়গপুর থেকে হলদিয়ায় এসে শুরু হয়ে যায় নতুন জীবন। নৃত্যের পথে আসে নানা বাধা ও প্রতিকূলতা।
সংসারে আবদ্ধ হওয়ার ফলে নৃত্যচর্চার ক্ষেত্রে কী কী বাধা বা অসুবিধা তৈরি হয়?
ছন্দা : আসলে আমার নৃত্যজীবনের ক্ষেত্রে দু’দিক থেকে বাধা আসে। একটি সাংসারিক, অপরটি সামাজিক। রক্ষণশীল জমিদার বাড়ির পুত্রবধূর পক্ষে নৃত্যকে কেরিয়ার করা সকলের কাছে বিস্ময় ছিল, সেই সঙ্গে আর একটি কথা মনে রাখা দরকার, পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া, যখন শিল্প শহরের পরিচয় নিয়ে সবে জাগছে, তখনও ছিল প্রত্যন্ত জনপদ। সেখানে বাড়ির বউ নৃত্য করবে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল।
তাহলে সেই বাধা ও প্রতিকূলতা কীভাবে দূর হল?
ছন্দা : এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ মুক্তমনা স্বামীর কাছে। তাঁর উৎসাহ, অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী আনন্দশঙ্করের কাছে দীর্ঘ দশবছর তালিম নিই। সেই সঙ্গে হলদিয়াতে একটি ক্লাবের স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার বারান্দায় ছোট ছোট মেয়েদের নাচ শেখাতে শুরু করি। আমি নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের ডেকে আনতাম। সেইসময় গুরুদক্ষিণা হিসাবে পেয়েছি শাকসবজি বা ধামাভরা চাল।
এইভাবেই শুরু করে আজকে আপনার প্রতিষ্ঠান ‘নটরাজ ডান্স অ্যান্ড কারচারাল অ্যাকাডেমি’ গড়ে ওঠে? যার ছাত্রছাত্রী সংখ্যা সাতশো?
ছন্দা : হ্যাঁ, এটাই সত্য এবং তা সম্ভব হয়েছে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদার অশেষ কৃপায়। আজ দীর্ঘ ৩৫ বছর নৃত্য শেখানোর মাধ্যমেই অসংখ্য ছাত্রছাত্রী নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে ও সফল হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম বছর থেকে শুরু করে এম মিউজিক পর্যন্ত নৃত্য শেখানো হয়। প্রতিবছর মহাধুমধামে বসন্ত উৎসব পালন করা হয়। সেই সঙ্গে সারাবছর নানা সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকি।
আপনি তো চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন?
ছন্দা : হ্যাঁ, বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে নৃত্যের কাজ করেছি এবং সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার, আমার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী চলচ্চিত্রে কাজ করছে। এইভাবে নৃত্যের মাধ্যমে আমি অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে স্বনির্ভর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আপনি উল্লেখ করলেন ঠাকুর ও মায়ের কথা। তাঁরা কীভাবে আপনাকে পথ দেখান?
ছন্দা : আমি বিশ্বাস করি, আমি যা করেছি সবই ঠাকুর ও মায়ের অশেষ করুণায়। ঠাকুর খুব সুন্দর কথা বলতেন— নাচ গান যা-ই হোক, যে-কোনও একটি শিল্পমাধ্যমে অন্তর দিয়ে কাজ করলে ঈশ্বরের কাছাকাছি যাওয়া যায়। এই কথাটিই আমার শক্তি ও পাথেয়।

Latest article