মহুয়া সমাদ্দার: বাবা একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ। সবার শরীর সমান না। বাষট্টি বছর বয়সে অনেককেই হয়তো ঘুমের ওষুধ খেতে হয় ঘুমের জন্য। কিন্তু সবার দরকার পড়ে না। তাছাড়া তোমার শরীর এই বয়সের মানুষদের থেকে অনেক বেশি ফিট। শুগার, প্রেশার কিচ্ছু নেই। আনিলকাকু, রনিতকাকুদের তো শুগার, প্রেশার, কোলেস্টেরল, আরও কত কি!
আরও পড়ুন-প্রয়াত নির্মলা
—কিন্তু একটা মানুষ কত দিন না ঘুমিয়ে থাকতে পারে বলত মা?
—না ঘুমিয়ে? না ঘুমিয়ে থাকতে যাবে কোন দুঃখে বাবা? আর তাছাড়া তুমি রীতিমতো নাক ডেকে ঘুমাও!
—ও তোর মনের ভুল। আজ মাসখানেক ধরে আমার একেবারেই ঘুম হচ্ছে না। তুই আমাকে কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল মুনিয়া। একটু ঘুমের বড্ড দরকার আমার।
—উফ! তোমাকে নিয়ে আর পারি না। আমি তো রাত দুটো-আড়াইটা পর্যন্ত অফিসের কাজই করি। রোজ রাতেই আমি দু-তিনবার করে তোমাকে দেখে আসি। আর প্রত্যেক বারেই গিয়ে দেখি তুমি ঘুমোচ্ছো।
—সে হয়ত দু-চার মিনিটের জন্য কোনও সময় ঘুম আসে আর সেই সময়েই তুই যাস আমার ঘরে। তাই ভাবিস সারা রাত-ই আমি বুঝি ঘুমিয়ে কাটাই!
—আচ্ছা ঠিক আছে। রিঙ্কির কাছ থেকে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিচ্ছি। ঘুমের ওষুধ ছাড়া যখন ঘুমোতে পারছই না তখন কী আর করা যাবে!
আরও পড়ুন-চলচ্চিত্রে বিদ্যাসাগর
মুনিয়া অর্থাৎ অহনা মিত্র বেশ বুঝতে পারল এটা রণজিতবাবুর ঘুম হচ্ছে না মনে করাটা জাস্ট একটা মনের ভুল। যথেষ্ট পরিমাণে ঘুমানোর পরেও তিনি মনে করছেন তাঁর ঘুম হচ্ছে না। বাবা নিজের ঘরের দিকে চলে যেতেই রিঙ্কির নাম্বারে ডায়াল করল অহনা। সে বর্তমানে একটা প্রাইভেট কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সেই কোন ছোট্ট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাপ-মেয়েতেই জীবন কাটাচ্ছে তারা। বাবা এমনিতে বেশ শক্ত ধাতের মানুষ। নইলে একা হাতে তাকে বড় করতে পারতেন না। কিন্তু বছর দুয়েক মানুষটা বড্ড একা হয়ে গেছে। চাকরি যতদিন ছিল, সারাদিন সময় কাটাবার একটা দারুণ সুযোগ তবু ছিল। কিন্তু এখন একাকীত্ব ঘিরে ধরছে যেন বাবাকে। রাতে ফিরে ক্লান্ত শরীরে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করার পরেও অহনা বুঝতে পারে বাবা আসলে ভীষণ একা। এই কারণেই ‘ঘুম হচ্ছে না, ঘুম হচ্ছে না’ বলে মাথা খারাপ করছেন উনি। তার সঙ্গে অবশ্য আরও একটা কারণ রয়েছে যার গুরুত্বও কিছুমাত্র কম নয়। বাবার বেশিরভাগ বন্ধুরা শারীরিক নানা সমস্যার কারণে ঘুমের ওষুধ খেতে বাধ্য হচ্ছেন বলে বাবারও ধারণা হয়েছে যে ঘুমের ওষুধ ছাড়া এই বয়সে ঘুম হওয়া কোনও মতেই সম্ভব নয়। সেই কারণেই অগত্যা রিঙ্কিকে ফোন করা। রিঙ্কি অহনার ছোটবেলার বন্ধু। আইসিএসসির পরে দুজন দুদিকে চলে গেলেও বন্ধুত্বটা রয়েই গেছে আজও। রিঙ্কি একজন এমবিবিএস ডাক্তার। মেডিসিন ডক্টর হলেও অহনাদের যে কোনও সমস্যায় রিঙ্কিই দেখে প্রথমে। কোনও বিষয় ওর এক্তিয়ারের বাইরে থাকলে তখন অন্য কোনও স্পেশ্যালিস্টের কাছে পাঠিয়ে দেয়। এই তো গত বছরেই বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে বসেছিল অহনা। সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা। তখনও প্রথমে রিঙ্কির কাছেই গেছিল সে। তারপর এক্স-রে করে ফ্র্যাকচার হয়েছে বুঝতে পেরে একজন অর্থপেডিক্সের কাছে পাঠিয়ে দেয় রিঙ্কি। তাই এবারেও বাবার ঘুমের ওষুধের জন্য ও-ই ভরসা।
আরও পড়ুন-শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে পদক্ষেপ, বৈঠক ডাকলেন ব্রাত্য
—হ্যালো রিঙ্কি, খুব পেশেন্ট দেখছিস নাকি?
—হ্যাঁ। বল।
—তাহলে থাক। পরে ফোন করছি।
—এই মুহূর্তে কেউ নেই ভেতরে। বল কী বলবি।
—এই সানডেতে তোর দমদমের চেম্বারে থাকছিস তো?
—হ্যাঁ। কিন্তু কেন রে? সব ঠিক আছে তো?
—আছে আবার নেইও।
—মানে? তোর সব কথা আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ঠিক করে বল প্লিজ।
—মানে বাবার হঠাৎ মনে হয়েছে রাতে তার ভাল ঘুম হচ্ছে না, দাওয়াই চাই।
—“মনে হচ্ছে” মানে?
—‘‘মনে হচ্ছে” মানে ইন দ্য সেন্স বাবা আসলে ঘুমাচ্ছে ভালই। কিন্তু বাবার অন্যান্য বন্ধুরা ঘুমের ওষুধের সাহায্য নিচ্ছে বলে অথবা কোনও বন্ধু হয়ত মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে এই বয়সে ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমানো অসম্ভব।
—বেশ বুঝলাম। কোনও চাপ নেই বস। কাকুকে নিয়ে আয়। প্রথমে একটু কাউন্সেলিং করে দেখব। যদি কাজ হয়ে যায় ওয়েল অ্যান্ড গুড। আদারওয়াইজ…
আরও পড়ুন-বেনিয়ম নেই, ইডিকে জানালেন কৃষ্ণ কল্যাণী
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রাখল অহনা। যাক, পুরো ব্যাপারটা রিঙ্কি বুঝে গেছে ভেবে বেশ নিশ্চিন্ত লাগছে তার।
—কাকু দেখো ঘুমটা হচ্ছে একটা অতি-সাধারণ বিষয়। ঠিক যেভাবে আমাদের খিদে পায়, টয়লেট পায়, সেভাবেই পর্যাপ্ত পরিশ্রম করলে ঘুমও অটোমেটিকালি পায়। এটা কোনও চিন্তা করার মতো জিনিসই নয়। তুমি তো ভালই পরিশ্রম কর। সকাল বিকেল হাঁটা, জগিং আর সঙ্গে সংসারের কত্ত কাজ কর! হিসেবমতো তোমার এমনিতেই ঘুম হওয়া উচিত।
—না রে রিঙ্কি। উচিত-অনুচিতের কথা জানি না। কিন্তু ঘুমটা আমার কিছুদিন ধরে সত্যিই হচ্ছে না ঠিকঠাক।
—ঘুমের ওষুধ আসলে ড্রাগের নেশার মতো। নেশা ধরিয়ে দেয় পেশেন্টদের। অন্য কোনও পেশেন্ট হলে হয়ত এত কথা বলতামই না। কিন্তু তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বাবা। তাই…
—কিন্তু রিঙ্কিমা, তুই-ই বল রাতে ঠিকমতো ঘুম না হলে ভাল লাগে শরীর! কেমন ম্যাজম্যাজ করে না! আর শরীর ভাল না থাকলে কি মনও ভাল থাকে বল!
আরও পড়ুন-কাঁচের ঘরে বসে ঢিল ছুঁড়বেন না, আপ্তসহায়কের বাজেয়াপ্ত টাকার হিসাব দিন দিলীপ
—তা তো একশোবার। ঠিক আছে কাকু। তুমি যখন বলছ তোমার ঘুম হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে তোমাকে ওষুধ তো দিতেই হবে।
—হ্যাঁ মা দে। ওষুধ ছাড়া কিছুতেই ঘুম হবে না আমার।
—এই ওষুধটা তুমি রাখো কাকু। রোজ রাতে খাবার পরে খেয়ে শুয়ে পড়বে। দারুণ ঘুম হবে কাকু। এর আগে যাদের যাদের এই ওষুধটা দিয়েছি সবাই বলেছে ফার্স্ট ক্লাস ঘুম হয় এতে। কাল সকালে জানাতে ভুলো না কাকু রাত্তিরে কেমন ঘুম হল।
—নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।
—গুড মর্নিং বাবা। কাল রাতে ঘুম হল ঠিকঠাক?
—সত্যি। অনেকদিন বাদে দারুণ ঘুমোলাম। আর শরীরটাও খুব ঝরঝরে লাগছে। রিঙ্কিকে বলিস এত ভাল ওষুধ দেওয়ার জন্য যা খেতে চাইবে বানিয়ে খাওয়াব।
—আচ্ছা সে বলব’খন।
আরও পড়ুন-কাঁচের ঘরে বসে ঢিল ছুঁড়বেন না, আপ্তসহায়কের বাজেয়াপ্ত টাকার হিসাব দিন দিলীপ
—তা হ্যাঁ রে অহনা, এগ চাউমিন বানিয়েছি। খাবি তো এখন?
—উফ! এই বয়সেও তুমি রান্নাঘরে ঢোকো কেন কিছুতেই বুঝি না বাবা! মিনুমাসিকে বললেই তো বানিয়ে দেয় না কি!
—ধুর, আমার মুনিয়াকে আমি নিজের হাতে না করে খাইয়ে অফিস পাঠালে তার শরীর ঠিক থাকবে তুই-ই বল!
—তোমাকে নিয়ে আর পারি না বাবা।
—এই অহনা, তুই এই সাতসকালে আমার ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিস কেন রে? তাও আবার অফিস যাওয়ার আগে?
—না মানে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর থেকেই খুব অ্যাসিডিটি হচ্ছিল। তাই ভাবলাম…
—তাই কি ভাবলি? এই সকালে ঘুমের বড়ি খেয়ে নিবি! এবার যদি ঘুমিয়ে পড়িস অফিসে গিয়ে কী হবে ভেবে দেখেছিস সেটা একবারও!
—দেখি যদি কাজের প্রেশার কম থাকে তাহলে অফিসে গিয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিলেই পুরো ঝরঝরে হয়ে যাব বাবা।
—একটা বড় হাই তুলতে তুলতে অহনা বলল।
—আজ খেয়েছিস। কিন্তু আর কখনও আমার ওষুধে হাত দিবি না— এই আমি বলে দিলাম।
—আচ্ছা বাবা আচ্ছা। এবারে তুমি শান্ত হও প্লিজ।
আরও পড়ুন-নবান্নে নিরাপত্তা: বসছে স্মার্ট গেট, ঢুকতে বিশেষ কার্ড
—শান্ত হব মানে? এটা আমার বয়সের ওষুধ। তোর বয়সের জন্য এটা অ্যাপ্রপ্রিয়েট নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনও সমস্যা ঘটতেও পারে।
—এই মুনিয়া, আমার ঘুমের বড়ি আর তিন-চারটে আছে। কাল অফিস থেকে ফেরার পথে রিঙ্কির কাছ থেকে আর এক শিশি বড়ি নিয়ে আসিস কেমন? বড় ভাল ওষুধ দেয় মেয়েটা। সত্যিই অনিলদের ডাক্তারগুলো একেবারে যাচ্ছেতাই। ওষুধ খেয়েও নাকি ওদের ঘুম হতে চায় না! ফলে সারাদিন ঝিমুনি থাকে। আর আমি রিঙ্কির ওষুধ খেয়ে কত্ত ভাল আছি বল! সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কত বড় ডাক্তার হয়ে গেছে! ভাল রাখুক ঈশ্বর ওকে।
—আচ্ছা বাবা। নিয়ে আসব কাল এখন শুয়ে পড়ো কেমন!
রণজিৎবাবু মেয়ের সঙ্গে কথা বলেই নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমের বড়ি খেয়ে টয়লেট করে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই মনে পড়ল— কাল অহনা কখন বেরবে জানা দরকার। নইলে সকালে রান্না করতে দেরি হয়ে যেতে পারে। অফিসে কোনও আর্জেন্ট মিটিং থাকলে সেসব দিনে খুব সকাল সকাল বেরিয়ে যায় অহনা। মা-মরা মেয়েকে কোনও দিনও মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। তাইতো ঘরে রান্নার লোক থাকা সত্ত্বেও সকালে অন্তত নিজের হাতে মেয়েকে খাইয়ে অফিস পাঠান। ওর মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এরকমই করত! রণজিৎবাবুর মাঝে মাঝেই মনে হয় ‘মাতৃত্ব’ আসলে একটা অনুভূতির নাম। সেটা ছেলে-মেয়ে যে কেউই হতে পারে। এই অনুভূতিকে ঠিকমতো লালন করতে পারলে ছেলেরাও মা হয়ে উঠতে পারে খুব সহজেই। যেমন তিনি হয়ে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন-নবান্নে নিরাপত্তা: বসছে স্মার্ট গেট, ঢুকতে বিশেষ কার্ড
অহনার ঘরের সামনে এসে শুনলেন মেয়ে কার সঙ্গে জানি ফোনে কথা বলছে। খাটের পশ্চিমদিকে মুখ করে বসে আছে বলে দেখতে পায়নি রণজিৎবাবুকে। কার সঙ্গে কথা বলছে! রিঙ্কিই নাকি! তাই হবে বোধ হয়। এক্ষুনি ওষুধ শেষ হওয়ার কথা বলে গেছেন, আর অমনি ফোন করে দিয়েছে বন্ধুকে। আসলে খুব ভালবাসে বাবাকে। বাবা ছাড়া আর আছেটাই বা কে! আহারে! এই বয়সেই কত চিন্তা, কত দায়িত্ব নিতে হয় মেয়েটাকে! ওর মা বেঁচে থাকলে হয়তো সবসময় এত টেনশানে কাটাতে হত না ওকে। থাক একটু কথা বলুক রিঙ্কির সঙ্গে। এখন আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে করছে না মেয়েটাকে। চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়ালেন রণজিৎবাবু। কী বলছে অহনা এসব!
—রিঙ্কি, যা করেছিস না তুই! তুই-ই পারিস এমন অসাধ্যসাধন করতে।
আরও পড়ুন-ব্রোঞ্জ গুরুরাজার, প্রথম পদক সংকেতের
—কী করেছিস! তুই জানিস, তোর দেওয়া হজমের বড়ি খেয়ে বাবা কী সুন্দর ঘুমোচ্ছে! ভাগ্যিস আইডিয়াটা তোর মাথা থেকে বেরিয়েছিল! নইলে ‘ঘুম হচ্ছে না, ঘুম হচ্ছে না’ করে করে মানুষটার মাথাটাই পুরো খারাপ হয়ে যেত!
—কী বললি? সত্যিই ঘুমাচ্ছে কিনা! আরে হ্যাঁ রে বাবা। সত্যি সত্যিই খুব ঘুমাচ্ছে বাবা এখন। আগে দু-একবার তাও এপাশ-ওপাশ করতে দেখতাম। এখন একেবারে পিন-ড্রপ সাইলেন্সে ঘুমোচ্ছে।
—সত্যিই তাই। ওষুধটাতে দারুণ হজম হয়। আরে সেদিনের কথা তোকে তো বলাই হয়নি। পুরো কেস খেয়ে গেছিলাম আর কি! বোতল থেকে একটা হজমের বড়ি যেই না খেতে যাব অমনি বাবা কট রেড হ্যান্ডেড। সে কত ধানাইপানাই করে তারপরে ছাড়া পাই।
—ও হ্যাঁ। আরেক বোতল ওষুধ রেডি রাখিস। কাল অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসব কেমন! ও কে। বাই। গুড নাইট।