ছোট ছোট মিথ্যে বড়সড় ক্ষতি

এ তো বড় রঙ্গ জাদু, এ তো বড় রঙ্গ। চার মিথ্যে দেখতে চাইলে নাও গেরুয়া পার্টির সঙ্গ। মিথ্যে ভেলকি, ভূতের হাঁচি, মিথ্যে কাচের পান্না। তারও বেশি মিথ্যে ওদের মেকি ধর্মের কান্না। লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

প্রতিটি সংক্রান্তিতে, প্রতিটি সৌর অয়নে গঙ্গাস্নানকে অতি পুণ্যকর্ম বলে বিবেচনা করতেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ। বঙ্গে এরকম দুটি তীর্থস্থানে পুণ্যার্থীদের ভিড় বহুকাল ধরে দেখা যেত। একটি গঙ্গাসাগর (দক্ষিণ ২৪ পরগনা), অপরটি ত্রিবেণী (হুগলিতে)। এই দুটি স্থানে বিশেষ বিশেষ সংক্রান্তিতে পুণ্যস্নান সারতে জমায়েত হত হিন্দু তীর্থযাত্রীদের।

আরও পড়ুন-শারীরিক প্রতিবন্ধকতা উড়িয়ে মানুষের মাঝে জাকির

এই কথাগুলো উঠে এসেছিল অ্যালান মরিনিস-এর গবেষণাপত্রে। গবেষণাপত্রটির প্রকাশক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস। অ্যালান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোডস স্কলার। জন্মসূত্রে কানাডিয়ান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল হিন্দু পরম্পরায় তীর্থযাত্রার স্থান, বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে, ‘Pilgrimage in the Hindu Tradition : A Case Study of West Bengal’.
উল্লিখিত গবেষণাপত্রে অ্যালান মরিনিস লিখেছিলেন, “auspicious for a bath in the Ganges”.
অন্তর্জালের মাধ্যমে বাজারে ওই গবেষণাপত্রের এই অংশটি যে রূপে ছড়াল, সেটি এরকম : “a Kumbha-Mela was held here in past.”
অর্থাৎ, মূল গবেষণাপত্রে লেখা ছিল, সংক্রান্তিতে লোকে পুণ্যস্নান করত। আর বিকৃত হয়ে যে গবেষণা পরিবেশিত হল, সেটিতে বলা হল, সংক্রান্তিতে অতীতে এখানে কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হত।

আরও পড়ুন-বাম মুখপত্রে কেন্দ্রের বিজ্ঞাপন, নিন্দার ঝড়, ঝুলি থেকে বেরোল বেড়াল

মূল বাক্য আর চলতি এই বাক্য, দুটোতেই ছেদযতি চিহ্ন সহকারে বর্ণ সংখ্যা ২৯টি। আর জাল গবেষণাপত্রের ছেদযতি চিহ্ন সহকারে বর্ণসংখ্যার যাতে আসল গবেষণাপত্রের ছেদযতি সমেত বর্ণের সংখ্যার সঙ্গে কোনও পার্থক্য না-থাকে, সেজন্য ‘past’ শব্দটির আগে ব্যাকরণসম্মতভাবে যে ‘the’ বসানোর কথা, সেটি বসানো হয়নি।
সুকৌশলে কিছু শব্দ বদলে দেওয়া হল। ওই ‘the’ টুকু ছাড়া, ওই ব্যাকরণগত ভুলটুকু ছাড়া, দুটো তথ্যের ফারাক নিয়ে একজন সাধারণ ব্যক্তি বেশি কিছু ভেবে উঠতেই পারবেন না।
অথচ এই বদলটাই একটা বিরাট বিভ্রান্তি তৈরি করে ফেলল।

আরও পড়ুন-মেয়েদের অধিকার রক্ষায় সরব হয়েছিলেন রামমোহন

ফেব্রুয়ারি মাসে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উল্লিখিত ওই জাল গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে ‘মন কি বাত’-এ বললেন, ৭০০ বছর পর ফের ত্রিবেণীতে ‘ত্রিবেণী কুম্ভ
পরিচালনা সমিতি’র উদ্যোগে একটি মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পরম্পরার পুনর্জাগরণের এই সংবাদ বড়ই আনন্দদায়ী। ত্রিবেণী কুম্ভ পরিচালনা সমিতির এই উদ্যোগ আয়োজন ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, সেকথা জানাতেও ভুললেন না নরেন্দ্র মোদি।
এখানেই শেষ নয়।
যে কুম্ভমেলা ত্রিবেণীতে কোনওদিন হতই না, সেই কুম্ভমেলার নব সংস্করণে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হলেন অ্যালান মরিনিসও। ২০২৩-এর মার্চ মাসে সনাতন সংস্কৃতি সংসদ তাঁকে পাঠানো আমন্ত্রণ পত্রে স্পষ্টভাবে জানায়, ত্রিবেণী কুম্ভমেলার পুনরুদ্ধার সম্ভবায়িত হয়েছে অ্যালানেরই গবেষণার সৌজন্যে। বলা হয়েছিল, মুঘল বাদশাহ জাকরশাহ ৭০৪ আগে বছর বাংলা আক্রমণ করেন। সেই মুঘল আক্রমণের পরিণতিতে নাকি বন্ধ হয়ে যায় ত্রিবেণীর মাঘী কুম্ভমেলা আর গঙ্গা-আরতি।

আরও পড়ুন-মাধ্যমিকে জেলার দাপট, মেয়েরাই আবারও শীর্ষস্থানে

অ্যালান জানতে পারেন, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে বলছে, তাঁরা কোনও রাম-শ্যাম-যদু-মধুর গবেষণার ভিত্তিতে ত্রিবেণী কুম্ভমেলা ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন না, রীতিমতো অক্সফোর্ডের এক গবেষকের গবেষণার ভিত্তিতে তাঁরা ওই হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে প্রয়াসী। তাঁদের বক্তব্য, সাত শতাধিক বছর আগে যে কুম্ভমেলা বসত ত্রিবেণীতে সেটি পুনরুনষ্ঠিত হলে নগরের গৌরব পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে।
এসবের পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা কী সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি অ্যালানের। সাম্প্রতিক কালে তিনি সংবাদপত্রে সেকথা খোলাখুলি ভাবে লিখেওছেন।
অ্যালান মরিনিসের মতে, তাঁর গবেষণাপত্রের কয়েকটা কথা বদলে দিয়ে, ইন্টারনেটে তাঁর নামে জাল গবেষণাপত্র ছড়িয়ে দিয়ে এই ধর্মান্ধ গেরুয়াপক্ষ যেটা করতে চাইছে, সেটা হল, চতুর্দশ শতকে বঙ্গে মুসলমান বিজয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন যে গাজি জাফর খান, তাঁর সমাধিস্থলটা নিজেদের কবজায় আনা। ওই সমাধিস্থলে প্রচুর হিন্দু ধর্মের নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, এটাই দাবি করা হচ্ছে তাদের তরফে। তারা বলছে, মুসলমান জাফর খান সত্যনারায়ণের মন্দির ভেঙে ওই দরগাটা বানিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-মাধ্যমিকে জেলার দাপট, মেয়েরাই আবারও শীর্ষস্থানে

একেবারে, বাবরি মসজিদের কেস!
মসজিদ বা সংখ্যালঘু ধর্মস্থান ভাঙার, তাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার, একেবারে অনুকূল পরিস্থিতি।
ছোট্ট একটু বদল। তার পরিণতিতে এত কিছু হওয়ার অশনি সংকেত।
‘দ্য কেরলা স্টোরি’তে ৩ সংখ্যাটাকে ৩২ হাজারে পরিবর্তিত করে ধর্মান্তরিত মেয়েদের সংখ্যার পরিবেশন, আইসিসিস জঙ্গি সংগঠনে যোগদানকারী মেয়েদের কেন্দ্র করে পরিস্থিতিটাকে ঘুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।
ওই একই ছক।
ছোট্ট একটু বদল ঘটিয়ে বড় কিছু ঘটানোর ষড়যন্ত্র।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নির্ঘাৎ ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা প্রফেট ছিলেন। নইলে কেউ লিখতে পারেন এমন সত্যিটা!
‘‘রূপকথার সুন্দর মিথ্যাটুকু শিশুর মতো উলঙ্গ, সত্যের মতো সরল, সদ্য উৎসরিত উৎসের মতো স্বচ্ছ; আর এখনকার দিনের সচতুর মিথ্যা মুখোশ-পরা মিথ্যা।”

Latest article