নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান;
দেখিয়া ভারতে মহাজাতির উত্থান
জগজন মানিবে বিস্ময়,
জগজন মানিবে বিস্ময়!
আরও পড়ুন-চেন্নাই কনসার্টে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, আমি তো ‘বলির পাঁঠা’, বললেন ক্ষুব্ধ রহমান
অতুলপ্রসাদ সেনের এই গানটিতে INDIA নয়, ভারতের বিস্ময়কর উত্থানের কথা, বিস্মিত করার মতো অবস্থানের কথা, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের বার্তাবাহক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা স্পষ্টভাবে উল্লিখিত।
এই INDIA নয়, ভারত নিয়ে মোদি সরকারের যত মাথাব্যথা। এই সনাতন ভারতকে রক্ষা করতেই নাকি মোদিপক্ষের ঘুম হচ্ছে না।
আহা! এটা বড়ই আহ্লাদের কথা হতে পারত, হতেই পারত।
কিন্তু হল না।
আরও পড়ুন-মাটিতে মিশে গিয়েছে বহু জনপদ, মরক্কো জুড়ে কান্না আর হাহাকার
কারণ ২০১৮-র ইউনেস্কোর রিপোর্ট বলছে ভারতের ৪২টি ভাষা বিলুপ্তির পথে। এই ভাষায় যারা কথা বলে সেই ভারতীয়র (Indian নয়) সংখ্যা ১০ হাজারেরও কম। ইউনেস্কোর বিধি অনুযায়ী, যে-ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা কেবল ১০ হাজার বা তারও কম, সেগুলো বিলুপ্তপ্রায় ভাষা। বিপন্নতার খাদের কিনারায় এরকম যে ৪২টি ভাষা রয়েছে, সেগুলোর সব ক’টাই ভারতের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা উপজাতি জনজাতির ভাষা।
আরও পড়ুন-অমানবিক ইসিএল, জমি নিয়েও প্রতিশ্রুতিমতো চাকরি দেয়নি, দাবি আদায়ে অনশনে জমিদাতারা
ভাষা তো কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ভাষা হল ভাব প্রকাশের বাহন। ভাষা হল ধ্যানধারণা ও আবেগ ফুটিয়ে তোলার অবলম্বন। ভাষা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও পরম্পরার প্রতীকী উপস্থাপন। ভাষার অবলুপ্তি মানে কোনও একটি নির্দিষ্ট কৌমের স্বকীয় জ্ঞান, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর বাহিত হচ্ছিল বহুযুগ ধরে, তার গতিপথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। সেই কৌমজ্ঞানের গতিশীলতার অবলুপ্তি। একটা ভাষা যদি হারিয়ে যায়, তবে সেই ভাষায় যারা কথা বলত, সেই ভাষা যারা আঁকড়ে ধরে তাদের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণা ফুটিয়ে তুলত, তাদের প্রকাশক্ষমতা ব্যাহত কিংবা অবলুপ্ত হয়। পরিণতিতে, তাদের সাংস্কৃতিক পরম্পরা বিপন্নতার মুখে পড়ে। আর কোনও দেশে এমনটা ঘটলে সেই দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ক্ষুণ্ণ হয়ে অভিন্নতা আরোপিত হয়। বহু বর্ণের চিত্র একরঙা হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন-শিক্ষাঙ্গনে গৈরিকীকরণ চলবে না, গর্জে উঠল ছাত্রপরিষদ
এই কারণেই জৈববৈচিত্র্যের অবলুপ্তি নিয়ে সবাই ভাবিত তেমনই ভাষা বৈচিত্র্যের পরিসর ছোট হয়ে যাওয়ার বিষয়টাও সম গুরুত্বপূর্ণ। একই তাৎপর্যে রীতিমতো ভাবনার বিষয়। মনে রাখতে হবে, ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়ের একাংশ যদি তাঁদের মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলেন, তবে তাঁরা স্বাধীনভাবে তাঁদের চিন্তা-ভাবনার কথা, চাওয়া-পাওয়ার কথা প্রকাশ করতে অসমর্থ হবেন। তাঁদের মুক্তচিন্তার ধারা ব্যাহত হবে। সর্বোপরি তাঁদের জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতের শাশ্বত রূপ ও সনাতন ধর্ম নিয়ে যারা নিত্য ভাবিত, তারা কিন্তু এই ভাষার বিলুপ্তি কিংবা বিপন্নতার বিষয়ে আদৌ চিন্তিত নয়। বরং, বহুবর্ণে রঞ্জিত চিত্রকে একরঙা করে তুলতে অনেক বেশি আগ্রহী। ভারতীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ মানে কেবল হিন্দি আর হিন্দুত্বের রক্ষণাবেক্ষণ নয়, এই কথাটা স্পষ্টভাবে জানা, বোঝা এবং উপলব্ধি করা দরকার।
আরও পড়ুন-মন্ত্রিসভায় রদবদল: পর্যটনে ইন্দ্রনীল, দায়িত্ব বাড়ল জ্যোতিপ্রিয়-প্রদীপের
পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে এখন ৩৪ কোটি মানুষের মাতৃভাষা ইরেজি। পৃথিবী ব্যাপী ব্রিটিশ উপনিবেশের দীর্ঘকাল ব্যাপী সম্প্রসারণের সৌজন্যেই এটা সম্ভবপর হয়েছে। ফলে, বিশ্বে কমবেশি ১২০ কোটি মানুষের দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি। পাশাপাশি, ৫৮.৬ কোটি মানুষের দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি। হিন্দি ও হিন্দুত্বের প্রচার সৌজন্যে এই সংখ্যাটা ইংরেজির সঙ্গে হয়তো টক্কর দিতে সমর্থ হবে। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও পরিষ্কার, হিন্দির টক্কর দেওয়ার সামর্থ্য যত বাড়বে, তত অবলুপ্তপ্রায় উপজাতীয় ভাষাগুলো আরও বেশি করে মূক হবে।
ল্যাঙ্গোয়েজ সোসাইটি অব আমেরিকা জানাচ্ছে, কয়েক ডজন এমন ভাষা আছে, যেসব ভাষায় কথা বলার মতো বা যেসব ভাষা বোঝার মতো মানুষের সংখ্যা বড়জোর এক। এই ভাষাভাষী মানুষদের ভাব বিনিময়ের জন্য দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তিকে পাওয়ার সুযোগ নেই। একলা ঘরে আটকে পড়া এই বন্দিত্ব শেষ বিচারে নাগরিক সামর্থ্যের অবলুপ্তি, নাগরিক দাবিদাওয়া উপলব্ধ করার পক্ষে বিড়ম্বনা।
এমন বিড়ম্বনা বৃদ্ধি পেলে গণতন্ত্রের বহুস্বরধর্মিতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু মোদিপক্ষ যেভাবে ভারতকে দেখেন কিংবা পেতে চান, সেটার সহায়ক হয়।
আরও পড়ুন-৪০ তলা উঁচু নির্মীয়মান বহুতলে লিফ্ট ভেঙে দুর্ঘটনা, মৃত ৭
এজন্যই বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলির ভিডিয়োটেপ, অডিয়োটেপ এবং লিখিত নথি (যদি ভাষার নিজস্ব হরফ না থাকে, তবে রোমান হরফে)-র সংরক্ষণে কিংবা অনুবাদের মাধ্যমে ধরে রাখার কোনও সক্রিয় সচেতন প্রয়াস সাধারণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
বাইবেলের জেনেসিস ২ অংশে টাওয়ার অব ব্যাবেলের কাহিনি মনে আছে? সেই কাহিনি অনুসারে নোয়ার উত্তরসূরিরা মহাপ্লাবনের পর একটি সাধারণ ভাষায় কথা বলত। তারা উত্তরে গিয়ে সিনারে বসতি স্থাপন করে। নিজেদের সমবেত শক্তির গরিমা প্রকাশ করার জন্য তারা নগর পত্তন করে এবং উঁচু উঁচু মিনার নির্মাণ করে। হিব্রু বাইবেলের ঈশ্বর ইয়াওয়ে মানুষের এসব কীর্তি দেখে বিপন্ন বোধ করেন। টের পান, মানুষের জয়কেতন দেবতার চরম শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই তিনি নানা ভাষা, নানা মতের মাধ্যমে মানুষে মানুষে বিভাজন উপ্ত করেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইয়াওয়ের বিপ্রতীপে গমন করে ব্রিটিশরা ভুল করেছিল। দেশ জুড়ে মানুষকে ইংরেজি পড়িয়ে শিখিয়ে বলিয়ে তারা নানা ভাষা নানা মতের দেশকে সংহত শক্তি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।
মোদিজিরাও কি দেশ জুড়ে বৈচিত্র্য সংহারক ঐক্যের বার্তা দিয়ে নিজেদেরই বিপদ ডেকে আনছেন? সময় এ-প্রশ্নের উত্তর দেবে।