প্রতিবেদন : কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ। কালী শব্দের অর্থ কৃষ্ণ বা কালো বর্ণ। হিন্দু মহাকাব্যে যে ভদ্রকালীর কথা বলা হয়েছে তিনি দেবী আদিশক্তি পার্বতীর রূপ। প্রকৃত অর্থে কাল (সময়)কে যিনি কলন (রচনা) করেন তিনিই কালী। আবার তিনিই দশমহাবিদ্যার অন্যতম প্রথম দেবী। শাক্তমতে কালী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদি কারণ। তাঁর বহু নাম বহু রূপ। তিনিই মহিষাসুরমর্দিনী আবার তিনিই সতী, সাধ্বী, তিনিই দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী তিনিই মহাকালী, ভৈরবী। তাঁরই শক্তিপীঠে তিনি বিভিন্ন রূপে পূজিতা। তাই কালীপুজোর পুণ্যতিথিতে দেবীগৃহে যাত্রাই হোক মুখ্য।
পুরাণগাথায় কথিত আছে, সত্যযুগে প্রজাপতি দক্ষ একটি মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। সেই যজ্ঞে নিমন্ত্রিত ছিলেন দেব, মুনি ,ঋষি, যক্ষ, কিন্নর— সকলে। শুধু আমন্ত্রিত ছিলেন না কন্যা সতী এবং তাঁর স্বামী দক্ষের জামাতা শিব। শিবের হাজার মানা সত্ত্বেও বিনা আমন্ত্রণে যখন সতী এলেন পিতৃগৃহে, চরম অপমান সইতে হল তাঁকে। ভরা যজ্ঞসভায় পতিনিন্দা হল তাঁর। সেই নিন্দা সহ্য করতে না পেরে সতী যজ্ঞকুণ্ডে আত্মবিসর্জন দিলেন। এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ মহাদেব সতীর শবদেহ কাঁধে নিয়ে শুরু করলেন তাণ্ডবনৃত্য। মহাপ্রলয় আসন্ন দেখে ভীত দেবতারা শরণাপন্ন হন নারায়ণের। বিশ্বপালনহর্তা বিষ্ণু তখন মহাদেবকে থামানোর উপায় না দেখে সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দিলেন। শিব স্থির হলেন এবং বসলেন অনন্ত ধ্যানে। সতীর দেহের সেই খণ্ডাংশ ছিটকে গিয়ে পৃথিবীর এক-একটি স্থানে পতিত হল। ধরায় পতিত হয়েই সেই দেহাংশগুলো প্রস্তর খণ্ডের আকার নিল। সেই সব স্থান যেখানে সতীর দেহের অংশ পড়েছিল সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ রূপে পরিচিতি পেল এই ধরায়। একান্নটি সতীপীঠের কথা আমরা জানি। ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে এইসব শক্তিপীঠের দর্শন এক অদ্ভুত, অনন্য অভিজ্ঞতা। বারবার দেবী টেনেছেন তাঁর ভক্তদের। এই একান্নটি সতীপীঠের মধ্যে তেরোটি রয়েছে এ রাজ্যেই।
মহাতীর্থ কালীঘাট
কালীপুজোর দিন আর কোথাও যেতে না পারলেও কালীঘাট দর্শন অবশ্যই করুন। কালীঘাট একান্নপীঠের অন্যতম হিন্দুতীর্থ বা বলা যেতে পারে মহাতীর্থ। পৌরাণিক মতে এখানে দেবী সতীর ডান পায়ের চারটি মতান্তরে একটি আঙুল পতিত হয়। এখানে পীঠদেবী হলেন মা দক্ষিণাকালী এবং পীঠরক্ষক মহাদেব যিনি নকুলেশ্বর শিব হিসেবে পূজিত। কালীঘাট বহু প্রাচীন একটি কালীক্ষেত্র। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে কালীঘাট বা কালীক্ষেত্র থেকে কলকাতা নামটির উদ্ভব হয়েছে । আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে গ্রিক দার্শনিক টলেমির ভারত বর্ণনাতে যে কালীগ্রামের উল্লেখ রয়েছে, মনে করা হয় সেটিই হল আজকের কালীঘাট। এ ছাড়াও এই কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে রয়েছে নানা কাহিনি। বর্তমানের মন্দিরটি ১৮০৯ সালে সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পূর্ণ তৈরি হয়। গবেষকদের মতে, ষোড়শ শতকে রাজা মানসিংহ মন্দিরটি তৈরি করেন। তখন এই মন্দির ছিল আকারে ছোট। এখানে মায়ের মূর্তি কষ্টিপাথরের তৈরি। মায়ের মাথায় সোনার মুকুট এবং জিভও সোনার। দেবী চারটি সোনার হাত এবং সোনার মুণ্ডমালা শোভিতা। মায়ের বহু স্বর্ণালঙ্কার— সবই ধনাঢ্য ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দান করা। মন্দিরের অদূরে কেওড়াতলা মহাশ্মশান। এখানকার শ্মশানকালী পুজো বিখ্যাত। মন্দিরের পাশেই বয়ে চলা আদিগঙ্গা। দীপান্বিতা কালীপুজো অর্থাৎ আজকের দিনে দেবীদর্শনের অনুভূতি অন্যরকম। বহু ভক্ত সমাগম হয় আজ। সব পাপ রোগভোগ ক্ষয় করে মা তাঁর ভক্তকে দেন অকুণ্ঠ আশীর্বাদ।
নলাটেশ্বরী
লালমাটির দেশ বীরভূমকে বলা হয় মা কালীর চারণভূমি। এখানেই রয়েছে পাঁচটি প্রসিদ্ধ সতীপীঠ। যার মধ্যে অন্যতম নলহাটেশ্বরী বা নলাটেশ্বরী। বীরভূমের রামপুরহাট মহকুমার সতেরো কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ডের সীমানায় শহর নলহাটি। এখানেই রয়েছেন মা নলাটেশ্বরী। তাঁর নামেই এই জায়গার নাম নলহাটি। সংস্কৃত ‘নলক’ শব্দের অর্থ হল নলের মতো লম্বা অস্থি বা হাড় যার অর্থ কনুইয়ের নিম্নভাগ। শিবচরিত মতে, এটি উপপীঠ। এখানে সতীর কণ্ঠনালি পতিত হয়। এখানে দেবী হলেন শেফালিকা, স্থানীয়রা নলাটেশ্বরী বলেন। ভৈরব হলেন যোগীশ। পুরাণে বর্ণিত কাহিনি অনুসারে কামদেব উদ্ধার করেন সতীর কণ্ঠনালি। ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের নিচে সেই কণ্ঠনালির ওপর বেদি করে প্রতিষ্ঠিত হন দেবী নলাটেশ্বরী। এই সতীপীঠের সঙ্গে রামায়ণের কাহিনিরও যোগ আছে। টিলাতে রয়েছে সীতার চুল আঁচড়ানোর দাগ। মা কালী, ভৈরব শিব এবং ভগবান বিষ্ণুর একসঙ্গে পুজো হয় এখানে। দেবী নলাটেশ্বরী এখানে ত্রিনয়নী কালী রূপে পূজিতা। এই মন্দিরের স্থাপত্য বহু প্রাচীন। দেবী হলেন আমিষাশী। বছরের সব দিনই এখানে মাকে অন্নভোগ দেওয়া। কালীপুজোয় মাকে বিশেষভাবে পুজো করা হয়। আজকের দিনে মায়ের ভোগ হয় রাতে। করোনাকালে সব বিধি মেনেই হচ্ছে ভক্ত সমাগম এবং নিত্যপুজো। সম্প্রতি দর্শনার্থীদের জন্য যাত্রীনিবাসও তৈরি করা হয়েছে। সিদ্ধপীঠ তারাপীঠ দর্শনে এসে নলাটেশ্বরী ঘুরে যেতে পারেন একদিনেই।
আরও পড়ুন : হামলার রিপোর্ট তলব মানবাধিকার কমিশনের
কঙ্কালীতলা সতীপীঠ
শান্তিনিকেতন বেড়াতে গেছেন অথচ কঙ্কালীতলা যাননি এমন মানুষ বোধহয় নেই। আর এখনও এই সতীপীঠ দর্শন না করে থাকলে ঘুরে আসতে পারেন শান্তিনিকেতন। বীরভূম জেলার বোলপুর থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে কোপাই নদীর তীরে সতীপীঠ কঙ্কালীতলা বেশ প্রসিদ্ধ। পীঠতন্ত্র অনুসারে এখানে দেবীর অস্থি বা কঙ্কাল পতিত হয় তাই এর নাম কঙ্কালীতলা। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য অনুযায়ী এখানে দেবীর কটিদেশ বা কোমরের অংশ পতিত হয়েছিল। প্রাচীনকালে এই জায়গাটির নাম ছিল কাঞ্চী। এই কঙ্কালীতলা নিয়ে শাস্ত্রজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। গুপ্ততন্ত্র সাধনার জন্য প্রসিদ্ধ এই কঙ্কালীতলা।
এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন দেবগর্ভা, অন্যমতে দেবীর নাম রত্নগর্ভী। ভৈরব হলেন রুরু। এখানে দেবীর কোনও মূর্তি নেই, ছবিতেই পুজো করা হয়। মন্দিরের ডানপাশে রয়েছে একটি কুণ্ড। কথিত আছে, এটাই সতীকুণ্ড। এই কুণ্ডের জলের মধ্যেই রয়েছে দেবীর কঙ্কাল প্রস্তরীভূত রূপে। কুড়ি বছরে একবার ওই প্রস্তর খণ্ডগুলি তুলে পুজো করা হয়। গ্রীষ্মে এই অঞ্চলের অনেক জলাশয় শুকিয়ে গেলেও কুণ্ডের জল শুকোয় না। জনশ্রুতি অনুসারে, যখন বিষ্ণুর চক্রে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পৃথিবীতে পড়ছিল, সর্বশেষ খণ্ড অর্থাৎ দেবীর কঙ্কালটি এখানে সজোরে পতিত হয় ফলে এই কুণ্ডটি তৈরি হয় এবং এটি পতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাদেবেরও চৈতন্য ফিরে আসে তাই এর অপর নাম চৈতন্যপীঠও। কালীপুজোর এই অমাবস্যায় রীতি মেনে পুজো, যাগযজ্ঞ— সব হয় এখানে। শান্তিনিকেতন বেড়াতে এসে দিনের দিন ঘুরে যাওয়া যায় কঙ্কালীতলা
বর্গভীমা
একান্ন সতীপীঠের অন্যতম হল মেদিনীপুর জেলার তমলুকের বর্গভীমা। ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের প্রধান এবং জাগ্রত শক্তিপীঠ এই মন্দির। কথিত আছে, বঙ্গদেশের হিন্দুরা যখন কালাপাহাড়ের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত, ভীত এবং সন্ত্রস্ত ঠিক তখন ভয়ঙ্কর কালাপাহাড়ের নাশকতাও থেমে গিয়েছিল এই বর্গভীমার মন্দিরে এসে। এখানে পতিত হয় দেবী সতীর বাম গোড়ালি। দেবী এখানে নানারূপে পূজিতা। বলা হয় বর্গভীমার মন্দিরটি নাকি নির্মাণ করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। তবে তমলুকের মানুষের বিশ্বাস, ময়ূরবংশীয় রাজাই তৈরি করেন এই মন্দির। দেবী বর্গভীমাকে নিয়ে জনশ্রুতির শেষ নেই। তন্ত্রচূড়ামণি মতে দেবী হলেন কপালিনী, শিবচরিত মতে দেবী হলেন ভীমরূপা, পীঠমালাতন্ত্র অনুসারে দেবী কপালিনী ভীমরূপা। দেবী বর্গভীমা চতুর্ভুজা, নিচে শায়িত মহাদেব। কালো পাথরের তৈরি দেবী এখানে বিরাজ করছেন উগ্রতারা রূপে। প্রত্যেক সতীপীঠে দেবীর সঙ্গে ভৈরব থাকেন। এখানে ভৈরব হলেন সর্বানন্দ বা কপালি। দেবীর ভোগপ্রসাদ নিরামিষ হয় না। প্রতিদিন দেবীর অন্নভোগের সঙ্গে শোলমাছ দেওয়া হয়। এটাই ভোগের বিশেষত্ব। এই নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত। কালীপুজোর এইদিনে মাকে রাজবেশে সাজিয়ে মহাসমারোহে পুজো করা হয়। বহু ভক্তের সমাগম হয়। বছরের অন্যান্য দিন মাকে ভোরবেলা স্নান করিয়ে স্বর্ণালঙ্কারে সাজিয়ে পুজো করা হয়। মা ভীমার মহিমায় জাগরিত গোটা তমলুক। যে কোনও পুজোর আগে মা বর্গভীমার পুজো দিতে হয় তমলুকবাসীকে। এটাই রীতি এবং এই নিয়ম নিষ্ঠাভরে মানেন সবাই। করোনাকালে মন্দির দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ থাকলেও সম্প্রতি করোনা বিধি মেনে আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। এখানে সেইভাবে রাতযাপনের ব্যবস্থা নেই কিন্তু সকালবেলা হাওড়া থেকে তমলুক এসে বর্গভীমার মন্দিরে পুজো দিয়ে দিনের দিন ফিরে যেতে পারেন।