আজ মহাসপ্তমী। ‘নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ।’ এই মন্ত্র উচ্চারণ করে কলাবউ পুজোর মহাতিথি। এভাবে দুর্গা-অর্চনা কেন? উত্তর খুঁজছেন দেবাশিস পাঠক
বোধয়েৎ বিল্বশাখায় ষষ্ঠাং দেবীফলেষু চ। সপ্তম্যাং বিল্বশাখাং সমাহৃত্য প্রতিপূজয়েৎ।। কালিকাপুরাণের ৬০ অধ্যায়ের ৭ ও ৮ নং শ্লোক। এতে স্পষ্ট বলা হচ্ছে, ষষ্ঠীতে বেলগাছের ডাল আর বেলফল দিয়ে করা হবে দেবীর বোধন। আর সপ্তমীতে ওই বেলগাছের ডাল নিয়ে নবপত্রিকার পূজন। বিল্ববৃক্ষমূলে দেবীর বোধন সেরে নবপত্রিকাকে বসানো হয় মণ্ডপে। দেবীমূর্তির পাশে। আরও স্পষ্ট করে বললে, মা দুর্গার ডান পাশে থাকেন গণেশ। আর গণেশ মূর্তির ডান পাশে বসানো হয় নবপত্রিকা। বৃক্ষপূজা থেকে প্রতিমাপূজায় বিবর্তনের ইঙ্গিত।
আরও পড়ুন-দুর্গাপুজোয় ঢাকে কাঠির চেয়ে দিলীপের পিছনেই কাঠি করতে ব্যস্ত শুভেন্দু-সুকান্ত
গণেশের পাশে, আমরা বলি, কলাবউ। আসলে কিন্তু তা ন’টা গাছের পাতাসমেত ডালের সমাবেশ। সপত্র কদলীকাণ্ডে শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বাঁধা হয় আরও আটটি গাছের ডাল। সেই সঙ্গে একজোড়া বেল ফলও। তারপর কলাগাছটাকে লালপেড়ে সাদাশাড়ি জড়িয়ে তাতে সিঁদুর লেপে বধূমূর্তি নির্মাণ।
এই কলাবউ বা নবপত্রিকার প্রতিটি উদ্ভিদ ভেষজগুণে সমৃদ্ধ বা পুষ্টিবর্ধক। এবং এই নবপত্রিকার প্রতিটি উদ্ভিদে অধিষ্ঠান করেন নবদুর্গার এক-একটি রূপ। অস্যার্থ, নবপত্রিকার প্রত্যেকটি গাছ এক-একজন দুর্গামূর্তির প্রতীক। রম্ভা বা কলা ব্রহ্মাণীর। কচু কালিকার। হলুদ উমার। জয়ন্তী কার্তিকীর। বেল শিবার। দাড়িম্ব বা ডালিম রক্তদন্তিকার। অশোক শোকরহিতার। মানকচু চামুণ্ডার। আর ধান লক্ষ্মীর।
এই নয়টি উদ্ভিদের সমাহার একত্রে দেবী শাকম্ভরীর প্রতীক। শাকম্ভরী দেবী দুর্গারই আর একটা রূপ। শ্রীশ্রী চণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ে বলা আছে তাঁর কথা। শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যাম্যহং ভুবি। নাগোজি ভট্ট তাঁর টীকায় এই শাকম্ভরী মূর্তির আবির্ভাবকালও নিরূপণ করেছেন। চত্ত্বাবিংশত্তম যুগে দেবী শাকম্ভরী রূপে আবির্ভূতা।
ব্রহ্মার বরে দুর্গমাসুর দুর্জয় হয়ে ওঠে। মুনি ঋষিদের যাগযজ্ঞ সব বন্ধ। ফলে যজ্ঞের আগুন-ধোঁয়া না থাকায় আকাশে মেঘসঞ্চারও বন্ধ। একশো বছর ধরে অনাবৃষ্টি কবলিত বিশ্ব। মাঠ ফুটিফাটা। ফসল শুকিয়ে খড়। ফলত, দুর্ভিক্ষ ভয়ঙ্কর। সেই অনাবৃষ্টি আর অনাহারের হাত থেকে বাঁচতে দেবতা মানুষ গন্ধর্ব শরণ নিল আদ্যাশক্তির। সমুদ্ধর মহেশানি সংকটাৎ পরমোত্থিতাৎ। জীবনেন বিনাস্মাকং কত্থং স্যাৎ স্থিতিরম্বিকে।।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের মানুষকে পুজো উপহার পাঠালেন সাংসদ অভিষেক
তাঁদের ডাকে সাড়া দিয়ে আবির্ভূতা হলেন দেবী শতাক্ষী। শত অক্ষি দিয়ে বেরিয়ে এল অশ্রুধারা, সন্তানদের দুঃখে বিগলিতা হওয়ার কারণে। সেই অশ্রুবারিতে ভিজল মাটি। দেবী তখন হাতের গাছপালার ফলমূল ছড়িয়ে দিলেন ভেজা মাটিতে। দেবীর হাতে ছিল দশরকমের মূল, পটল পাতা, বাঁশের ফোঁড়, বেতের আগা, পদ্মের নাল, কাণ্ডের ভেতরের শাঁস, মাতৃলুঙ্গাদি গাছের ছাল, নানারকমের খাবারযোগ্য ফুল, লাউ-কুমড়ো জাতীয় শাক আর ব্যাঙের ছাতা বা মাশরুম। সেগুলো থেকে উৎপন্ন হল শাকসবজি। সেসব খেয়ে বাঁচল দেবতা মানুষ, এমনকী গরু-ছাগলের মতো তৃণভোজী প্রাণীরাও। শাক দিয়ে সকলের ভরণ করেছিলেন দেবী। তাই তাঁকে শাকম্ভরী নামে চিনল মানুষ। এই শাকম্ভরী দেবী যখন দুর্গমাসুরকে বধ করলেন, তখন তিনিই পূজিতা হলেন দেবী দুর্গা রূপে। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল দেবীর বন্দনা মন্ত্র।
জগৎ ভ্রম বিবর্ত্তৈক কারণে পরমেশ্বরি। নমঃ শাকম্ভরী শিবে নমস্তে শতলোচনে।। সর্বোপনিষদু দঘুষ্টে দুর্গমাসুর নাশিনি। নমো মায়েশ্বরী শিবে পঞ্চকোশান্তর স্থিতে।।
হে পরমেশ্বরী! আপনিই জগৎ ভ্রমরূপ বিবর্তের একমাত্র কারণ। হে দেবীর শিবে-শাকম্ভরী, হে শতনয়না! আপনাকে বার বার প্রণাম্। হে শিবে! নিখিল উপনিষদাদি আপনারই মহিমা ঘোষণা কেরছে। আপনি দুর্গমাসুরকে বধ করেছেন। আপনি মায়ার অধিশ্বরী। অন্নময় প্রাণ, মন, বিজ্ঞান এবং অন্নময় পঞ্চকোষের মধ্যে আপনি নিত্য অধিষ্ঠান করেন। আপনাকে প্রণাম।
আরও পড়ুন-শিল্পীর প্রয়াণে শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
দেবী শাকম্ভরী নৃতত্ত্ববিদদের দৃষ্টিতে personification of vegetation spirit। শস্য উৎপাদিকা ধরিত্রীর মূর্তি। এই মূর্তির খোঁজ মেলে হরপ্পায় আবিষ্কৃত মূর্তিতেও। সেখানে এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক নারীমূর্তি। তাঁর উদর থেকে বেরিয়ে এসেছে চারাগাছ। এই মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায় গুপ্তযুগেও। সেখানে মূর্তি পোড়ামাটির। নারীমূর্তির গলা আর বুক থেকে উৎপন্ন হয়েছে পদ্মফুল।
এই ধরিত্রীমূর্তির প্রতীক নবপত্রিকার স্নান দিয়ে শুরু হয় সপ্তমী পুজো। কলকাতার বুকে যখন দাপিয়ে বেড়াতেন শোভাবাজারের রামকৃষ্ণ দেব, হাটখোলার রামতনু দত্ত, পোস্তার রাজা সুখময় রায় কিংবা চোরবাগানের মিত্তিরবাবুদের মতো বাবুরা, তখন তাঁদের বাড়ির দুর্গাপূজায় নবপত্রিকার স্নানযাত্রার জন্য ছাতা আসত ইংল্যান্ড কিংবা তাইওয়ান থেকে। সেই ছাতা সাজানো হত সোনা বা রুপোর তার দিয়ে। সেজন্য বেনারস থেকে আনা হত কারিগরদের।
আরও পড়ুন-শিল্পীর প্রয়াণে শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
সেসব আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে উনিশ শতকের প্রথম দিককার বাংলার কথা।
আর আজ, একুশ শতকের বাংলায়, ২০২১-এ, নবপত্রিকায় বিম্বিত দেবী শাকম্ভরীর পূজার মমতাময়ী উপচার হিসেবে নিবেদিত, অন্নদাতা কৃষকদের জন্য স্বস্তিদায়ী ছাতার মতো একাধিক প্রকল্প।
যেমন কৃষকবন্ধু প্রকল্প। ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি। জঙ্গলমহল, পুরুলিয়া আর বাঁকুড়ায় অনাবৃষ্টির জমিতে সেচের জল জোগাতে বাংলা কৃষি সেচ যোজনা। ব্যয়বরাদ্দ প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। সাত কোটি মানুষের মুখে অন্ন জোগানোর জন্য খাদ্যসাথী প্রকল্প। সব মিলিয়ে বাবু কালচারের জাঁক এখন ধনাঢ্য ব্যক্তির ঠাকুর দালানের সংকীর্ণ সীমা পেরিয়ে মমতাস্পর্শ হয়ে বাংলার কুটিরে কুটিরে, দুয়ারে দুয়ারে, ঘরে ঘরে।
এই বঙ্গে তাই ছত্রছায়ায় নবপত্রিকা স্নানের নিত্য আয়োজন। রোজই সেই মহামন্ত্রের উচ্চারণ—
‘পত্রিকে নবদুর্গে ত্বং মহাদেব-মনোরমে।।’