যোগ ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত এক ঐতিহ্যবাহী শারীরবৃত্তীয় এবং মানসিক সাধনপ্রণালী। যোগ শুধুমাত্র হিন্দু ধর্ম নয়, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মেরও ধ্যানপ্রণালী। হিন্দু দর্শনে যোগের পাঁচটি শাখা রাজযোগ, কর্মযোগ জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এবং হঠযোগ। হঠযোগীরা মনে করেন কোনও শক্তিকে আয়ত্ত করতে হলে শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যোগ বলতে হঠযোগের ব্যায়াম বা আসনগুলি বোঝেন। স্বামী বিবেকানন্দর সাফল্যের পর উনিশ শতকের শেষভাগ এবং বিশ শতকের প্রারম্ভে ভারতের যোগাচার্যরা পশ্চিমি দেশে যোগবিদ্যার প্রচার করেন। ১৯৮০-র দশকে যোগ পাশ্চাত্যেও শরীরচর্চার অঙ্গ হিসেবে জনপ্রিয় হয়।
আরও পড়ুন-জ্বালানি তেল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি শ্রীলঙ্কায়
সংস্কৃত শব্দ ‘যুজ’ থেকে আসা যোগের সরল ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে বিশ্বসত্তার মিলন। যোগ অভ্যাস করার জন্য যে ভঙ্গিমায় শরীরকে রাখলে শরীর স্থির থাকে কিন্তু কোনও কষ্ট হয় না তাকে যোগাসন বা আসন বলে। সংক্ষেপে স্থির এবং সুখজনকভাবে অবস্থান করার নামই হল আসন। যোগ বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, এটা জন্ম থেকে আমাদের জীবনের সঙ্গেই রয়েছে। যাঁরা যোগাসন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাঁরা জানেন শিশুরা সারাদিন কিছু না কিছু যোগভঙ্গিমাতেই থাকে।
আরও পড়ুন-মুম্বইয়ে বাড়ি ভেঙে মৃত ১৯
যোগ ব্যায়ামের মধ্যে অন্যতম একটি কঠিন যোগ অনুশীলন হল সূর্যপ্রণাম বা সূর্যনমস্কার। সূর্য নমস্কার বা সূর্যের উপাসনা হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। সূর্যদেব বিভিন্ন রোগের জীবাণু থেকে বস্তুসমূহকে বিশুদ্ধ করে। সূর্য নমস্কার হল আসন ও ব্যায়ামের সমন্বয়ে সৃষ্ট ক্রম শৃঙ্খলাপূর্ণ যোগাসন পদ্ধতি। সূর্যকে আত্মা এবং সকল জীবনের উৎস হিসেবে এর নামকরণ করা হয়েছে। এটি এমন একটি পূর্ণাঙ্গ যোগ ব্যায়াম যা একাই একশো। শুধু নিয়মিত সূর্য নমস্কারের অভ্যাসে আপনি পেতে পারেন সুঠাম সুন্দর নির্মেদ সুস্থ শরীর। ১২ শক্তিশালী নিয়মবদ্ধ আসনের সমষ্টি অর্থাৎ বারোটা ধাপে একটা গোটা ব্যায়াম। দুটি ভাগে করা হয় এই যোগ ব্যায়াম। দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণ করার জন্য একই নিয়মেই প্রথমটি ডান পা দিয়ে শুরু, দ্বিতীয়টি বাঁ পা দিয়ে শুরু হয়।
আরও পড়ুন-ইউক্রেনের শপিংমলে রুশ হামলা, মৃত ১৯
সূর্য নমস্কারের উপকারিতা
রোজ সূর্য নমস্কারের ফলে পেট, পাকস্থলী, হৃদযন্ত্র, বুক, অন্ত্র, গলা, পা সর্বাঙ্গে সু প্রভাব ফেলে। নিয়মিত, আধঘণ্টা সূর্য নমস্কারের অভ্যাস যে কোনও রোগব্যাধি থেকে দূরে রাখে।
এক রাউন্ড সূর্য নমস্কারে কোনও ব্যক্তির ১৩.৯০ ক্যালরি শক্তিক্ষয় হয় ফলে বাড়তি মেদ ঝরে যায়, ওজন কমতে থাকে দ্রুত। এই ব্যায়াম মেরুদণ্ড সুদৃঢ় ও নমনীয় হয়। সুন্দর দেহাবয়বের জন্য এই ব্যায়াম শ্রেষ্ঠ।
ফুসফুসকে সুস্থ এবং সবল রাখে সূর্য নমস্কার। যাঁরা ফুসফুসের রোগ বা সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা নিয়মিত এই ব্যায়াম করলে দেহের ভিতরে অক্সিজেন চলাচল ঠিকমতো হয়। স্নায়ুমণ্ডলীর সবলতাও বাড়ে।
শ্বাসযন্ত্রকে কর্মক্ষম এবং নিরাপদে রাখতে সাহায্য করে। যকৃতের সমস্যা, হাঁপানি, হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুসের ক্রিয়াবৈষম্য মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের দুর্বলতাজনিত, রোগ প্রতিরোধ করে।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। সর্দিকাশি প্রতিরোধ করে। বুকধড়ফড়ানি থাকলে কমাতে সাহায্য করে।
মাংশপেশির জোর বাড়ায় সূর্য নমস্কার। নিয়মিত এই ব্যায়ামে পেশি সবল হয়। পেশিগুলোকে টোনড আপ করে ফলে গড়ন সুঠাম হয়ে যায়।
মহিলাদের পিরিয়ডিক্যাল সমস্যাকে দূর করে। ওই সময় তলপেটে, কোমরে ব্যথা বা মুড সুইং মাথাব্যথা ইত্যাদি সমস্যাগুলো থেকে মুক্ত রেখে মাসিক চক্রকে স্বাভাবিক, সুস্থ এবং নিয়ন্ত্রিত রাখে। শরীরের রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটায়।
আরও পড়ুন-বন্যার জল খাচ্ছেন অসমের দুর্গতরা, হিমন্ত ব্যস্ত দল ভাঙাতে
মানসিক চাপ কমাতে এর জুড়ি নেই। স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশনজনিত যে কোনও সমস্যা অনেক কমে যায়। পজিটিভিটি বাড়ে।
ত্বক, চুল ভাল রাখে। চুলের আগা-ভাঙা রোধ হয়। বয়ঃবৃদ্ধির ছাপ সহজে শরীরে এবং ত্বকে আসতে দেয় না। চোখের কালি বা নিষ্প্রভ ত্বক উজ্জ্বল হতে থাকে এর প্রভাবে।
সূর্য নমস্কারের ১২টি আসন
প্রণাম আসন : এটি প্রথম ধাপ। পূর্বদিকে মুখ হলে ভাল না হলে সুবিধামতো একটা ম্যাটের উপর সোজা হয়ে দাঁড়ান। হাতজোড় করে বুকের মাঝখানে ঠাকুর প্রণামের ভঙ্গিমায় রাখুন।
হস্ত উত্থানাসন : এটি দ্বিতীয় ধাপ। এবার ওই হাতজোড় অবস্থায় হাত উপরে তুলে পিছনদিকে নিয়ে যান এবং যতটা সম্ভব পিছনদিকে শরীর বেঁকিয়ে হাতটা পিছনে প্রসারিত করুন।
হস্তাপদাসন : এটি তৃতীয় ধাপ। এই আসনে পিছনে প্রসারিত হাতটি ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে সামনের দিকে এনে ঝুঁকে মাটিতে নামিয়ে দু’পায়ের দুইপাশে রাখুন। অভ্যাস না থাকলে হাঁটু ভাঙতে হবে। অনুশীলন করলে হাঁটু না ভেঙেও এটা করা সম্ভব।
অশ্ব সঞ্চালনাসন : এটি চতুর্থ ধাপ। এবার শ্বাস নিতে নিতে প্রথমে ডান পা পিছনে প্রসারিত করুন, হাঁটু মেঝেতে ঠেকে থাকবে। বাঁ পা সামনে হাঁটু থেকে মুড়ে সামনের দিক করে থাকবে। দুটো হাত যেমন দু’পাশে পাতা তেমনই থাকবে। নিশ্চিত করুন হাতের দুটো তালুর মাঝখানে যেন দুটো পা থাকে।
আরও পড়ুন-তিস্তার গ্রেফতারিতে প্রতিহিংসা, বলছে সব মহল
দণ্ডাসন : এটি পঞ্চম ধাপ। এবার ওই ভঙ্গিমাতে থেকেই শ্বাস নিন এবং সামনের বাঁ পা পিছনে সোজা নিয়ে যান। হাতে ভর দিয়ে শরীর সোজা থাকবে পিছনে পায়ে পাতা শুধু মাটিতে ঠেকে থাকবে।
অষ্টাঙ্গ নমস্কার : এটি ষষ্ঠ ধাপ। ওই অবস্থানে শরীরকে রেখে হাঁটু মেঝেতে ঠেকিয়ে রেখে শ্বাস ছাড়ুন। দেহের বুক থেকে গলা এবং চিবুক অবধি মাটিতে ঠেকান। কোমর থেকে নিতম্ব অবধি উপরে উঠে থাকবে। হাতের তালু, চিবুক, বুক , হাঁটু এবং পায়ের নিচের অংশ শুধু এই আটটি অংশ মাটি স্পর্শ করবে।
ভুজঙ্গাসন : এটি সপ্তম ধাপ। বুক থেকে দেহের উপরিভাগ উপরের দিকে তুলুন। কনুই ভাঁজ করে হাত দেহের দু’পাশে থাকবে। তলপেট থেকে দেহ মাটি স্পর্শ করবে। শ্বাস ছাড়ার সময় নাভি নিচের দিকে ঠেলুন। তবে অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে তলপেটও উপরের দিকে ওঠানো যায়। জোর করে কিছু করবেন না। যতটা সম্ভব ততটাই করুন।
আরও পড়ুন-জুবেরের গ্রেফতারির নিন্দা ও মুক্তির দাবি গিল্ডের
পর্বতাসন : এটি অষ্টম ধাপ। শ্বাস ছাড়ার সময় হাতের তালুতে ভর করে ত্রিভুজের মতো করে নিতম্ব এবং টেলবোন উপরে তুলুন। ইংরেজির উল্টো V অক্ষরের মতো হবে ভঙ্গিমা। পা ছড়িয়ে পিছনদিকে নিয়ে স্ট্রেচ করুন। গোড়ালিতে টান পড়বে।
অশ্ব সঞ্চালনাসন : এটি নবম ধাপ। এবার শ্বাস নিয়ে বাম পা পিছনদিকে প্রসারিত করতে হবে। হাঁটু মাটি স্পর্শ করে থাকবে। ডান পা সামনের দিকে হাঁটু থেকে মুড়ে থাকবে। দুটো হাতের তালুর মাঝখানে ডান পা থাকবে। ঘাড় উঁচুর দিকে এবং দৃষ্টি উপরের দিকে থাকবে।
হস্ত পদাসন : এটি দশম ধাপ। এই ভাবেই বাম পা সামনের দিকে নিয়ে আসুন। দুটো পা মাঝে এবং দুটো হাতের তালু মাটিতে থাকবে। প্রয়োজনে হাঁটু ভাঁজ করতে হবে। শ্বাস স্বাভাবিক রাখুন।
হস্ত উত্থানাসন : শ্বাস নিতে নিতে মেরুদণ্ডকে উপরে তুলুন। দু’হাত উপরের দিকে তুলে সামান্য পিছনদিকে প্রসারিত করুন। শরীরও পিছনদিকে বেঁকিয়ে রাখুন। দু’হাতের ঊর্ধ্বাংশ কান স্পর্শ করে থাকবে।
তাদাসন : শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে সোজা হয়ে দু’হাত, দু’পাশে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ান। হাতের তালু খোলা অবস্থায় থাকবে। এই ভঙ্গিমায় বিশ্রাম নিন।