তীরে কী প্রচণ্ড কলরব
‘জলে ভেসে যায় কার শব
কোথা ছিল বাড়ি?’
রাতের কল্লোল শুধু বলে যায় —
‘আমি স্বেচ্ছাচারী।’
আরও পড়ুন-সব ছোটদের জন্য
যে নদীর বুকে জারি আর ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে আনন্দে দাঁড় বায় মাঝি,
নব পরিণীতা কোনও এক গাঁয়ের বধূর সলজ্জ চোখ বারবার পড়ে নিতে চায় নতুন বরের মন, সেই নদীরই বুকে মরা বিকেলের ম্লান আলোয় ভেসে যায় কার শব? কোথা ছিল বাড়ি? নদী চুপচাপ সব দেখে। সব শোনে। কথা বলে না।
‘ইছামতী জানে সব
তুমি এর মর্মছেঁড়া তার
কীভাবে বাজাতে পারতে
সব জানে।’
আরও পড়ুন-ঝুলন গোস্বামীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবেগঘন ট্যুইট মুখ্যমন্ত্রীর
কখনও কল্লোল, কখনও কুলুকুলু, কখনও মরা কোটাল কখনও বা ভরা কোটাল নদীর হয়ে কথা বলে। নদীতীরে মরে পড়ে থাকা কিশোরীর বরফশীতল হাতের মুঠোয় চিটে থাকা ছেঁড়া চিরকুটের লেপটে যাওয়া কালিতে আতশকাচ ফেলে বহু মেহনতে উদ্ধার হয় প্রায় মুছে যাওয়া লেখা : ‘আমি কী বলেছি নদী জানে।’
ও নদী, তোমাকে কী বলেছে ওই মৃত কিশোরী? শেষবেলায় কী বলে গেছে সে? নদী নিরুত্তর। কথা বলে না। কেন বলে না! আর নদীতীর? সেখানে কি শুধুই কলরব? তীরেই যত ছলাৎ ছলাৎ, গভীরে যাও শব্দ নেই, অগাধ জল অবাধ জল, গভীরে যাও শব্দ নেই। গভীরে মণিমুক্তোভরা নাইকো মৃত্যু নাইকো জরা, গভীরে জন্ম-মৃত্যু নাচে, অনাদিকালের যত্নে বাঁচে।
কবি বলছেন,
নদী নদী নদী
সোজা যেতিস যদি
সঙ্গে যেতুম তোর।
আরও পড়ুন-চাঁদা নয়, অনুদানেই হয় পুজো
কিন্তু নদীর নিয়তি যে সোজাপথ নয়। নাকি, সোজা পথের ধাঁধায় নদীও ধেঁধেছে অনেক? কে জানে! একথা ঠিকই যে ‘দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি’, তবে হ্যাঁ, সোজা নয়, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’।
সোজা পথে চললে এত গল্পের জন্ম হয় নাকি? রচিত হয় নাকি এত ইতিহাস? সোজা পথে চললে নদীর বুকে ও দুই কিনারায় ভালবাসার হাজার উপাখ্যান তৈরি হয় নাকি? কত ভালবাসার রংবদল, কত প্রেমের অকাল মরণ, কত আঘাত-সংঘাত, কত সভ্যতার জন্ম ও মৃত্যুর পটভূমি হয়ে জেগে থাকে নদী। শুধু তো ছোট নদী নয়, মাঝারি, বড় সব নদীই বিস্তীর্ণ দু’পারে লক্ষ কোটি সাক্ষী রেখে আপন বেগে পাগলপারা। নদীর মন-মেজাজ বোঝা কিন্তু বড়ই কঠিন। যারা নদীর গা-ঘেঁষে চিরটা কাল কাটিয়ে দেয় তারা একটু একটু বোঝে বটে নদীর মন, কিন্তু তারাই তো কথায় কথায় বলে ‘নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারো মাস’। কীসের ভাবনা? কেন ভাবনা? তাহলে তো একটু কষ্ট করে যেতে হয় নদীর ধারে বসবাস করা জলধর কৈবর্তের কাছে। শুনতে হয় তাঁর জবানবন্দি।
আরও পড়ুন-চাঁদা নয়, অনুদানেই হয় পুজো
‘‘ভঙ্গুর মাটির বুকে আমাদের ফঙ্গবেনে ঘর। ভাবনা হবেনি! মাঝরাতে পাড় ভাঙার হাড়হিম শব্দ শুনে বুক কাঁপে। ঘুমুলেই সব্বোনাশ! নড়বড়ে ঘরসমেত অতলে তলায়ে যেতি হবে বউ-বাচ্চা নিয়ে। ভরা কোটালে নৌকোডুবির ভয়। জাল ফেলায়ে মাছ আর কাঁকড়া পাওয়া গেলে তবেই দু’মুঠো ভাত, না হলি উপবাস।
বাঘ আর সাপের সঙ্গে লড়াই করে যদিও বা কোনও ভাবে বাঁচি, ফি-বছর ইয়াস আর আমফানের ছোবল থেকে কে বাঁচায় মোদের? দু-কূল ছাপানো প্লাবনে গ্রামের পর গ্রাম ভাসার আগেই ভেসে যেতি হয় আমাদের। ভাবনা হবেনি?’’
এতই যখন ভাবনা তখন নদীর ধার ছেড়ে অন্যত্র কোথাও বাস করলেই তো হয়। হয় না?
‘‘তা কী করে সম্ভব? যাব কোথায়? খাব কী? তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা এই বয়সে নদীর কোল ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া যায়? জানি তো শুধু খেয়া পারাপার আর জাল ফেলে মাছ ধরা। এই বিদ্যেটুকু নিয়ে নদী ছেড়ে গেলে পেট চলবে কী করে? তাছাড়া নদীর টান বড় টান, নাড়ির টান। প্রায় গোটা জীবনটা কাটায়ে দিয়ে এখন টের পাই কখন জোয়ার কখন ভাঁটা। জলের নড়াচড়া, জলের রংবদল আর গন্ধ দিয়ে আমরা অল্পস্বল্প বুঝি নদীর মন-মর্জি। সকালে, দুপুরে, গোধূলিবেলায় আর রাতের আঁধারিতে নদীর রূপ বদলায় গো। কান পাতলে শোনা যায় তার হাসি-কান্না।
আরও পড়ুন-বিভাজনের রাজনীতি করছে বিজেপি
তার স্বপ্ন-সাধের কথা, তার ঘরকন্নার সুর।
আমারও তো জীবনের এই শেষ বেলাতেও একটা স্বপ্ন মরে নাই এখনও। আমার আধভাঙা নৌকোটায় কোনও একদিন যদি গাঁয়ের বধূর ছদ্মবেশে উঠে বসেন স্বয়ং অন্নপূর্ণা মা, যদি তাঁর রাঙা চরণ দু’খানি রাখেন জীর্ণশীর্ণ পাটাতনে তাহলে উনি অন্তর্হিত হওয়ার পরে আমার নৌকোখানি সোনার নৌকোয় পরিণত হতি পারেও হয়তো বা! সেই ছোটবেলায় ঠাকুরদাদার মুখে শোনা ভারতচন্দ্রের সেই পদগুলান তো আমাদের জীবন নিয়েই লেখা। দেবীর কাছে পারানির কড়ি হিসেবে সোনার সেঁউতি পেয়েছিল দরিদ্র পাটনী। সেই যে গো, কী যেন, কী যেন, হ্যাঁ,
‘যার নামে পার করে
ভব পারাবার।
ভাল ভাগ্যা পাটনী
তাহারে করে পার।।’
আরও পড়ুন-গাজিয়াবাদ থেকে গ্রেফতার আমির
আমার জীবন তো শেষের পথে। কিন্তু আমি কি চাইব নি যে আমার সন্তান- সন্ততিরা থাকুক দুধেভাতে? চাইব নি?
কিন্তু নদী নিজে বাঁচবে তো? মরা খাতে পরী নাচানোর হাহাকার শুনে বড় ভয় করে যে! সারা দুনিয়ার দিকে দিকে নদীগুলান শুকায়ে যেতিছে শুনতি পাই। গ্রামগঞ্জ, শহর-নগরের যত জঞ্জাল, কল-কারখানার যত বিষাক্ত আবর্জনা সবই কি নদীতেই ফেলতি হয়? আর কুনো জায়গা নাই? লেকাপড়া জানা বাবুরা কতায় কতায় বলেন পরিবেশ পরিবেশ। দূষণ দূষণ। দুনিয়া জুড়ে সভ্যতা নাকি টিকে আছে নদীগুলানের কল্যাণে। তাহলি নদীর স্বাস্থ্য দিনে দিনে ভেঙে পড়তিছে কেন? নদী মরলে যদি সভ্যতা মরে তাইলে নদী বাঁচানোর কুনো উদ্যোগ নাই কেন? নদীকে স্বচ্ছ আর দূষণমুক্ত করবে কে? কীভাবে? নদীর উপর এই নির্মম পীড়ন আর অনাচারের প্রতিকার কুনখানে? শুধু বক্তিতা আর আলোচনায় সব সমাধান হয়?
নদীরে ভালবাসতি হয়। প্রাণ দিয়া ভালবাসতি হয়।
আরও পড়ুন-গাড়িতেই খুন করা হয়েছিল দুই কিশোরকে
কুবের, মালা, কপিলা ভালবাসত পদ্মানদীরে। ভালবাসত হোসেন মিয়াঁ। তিস্তা নদীরে ভালবেসেছিল কপর্দকহীন বাঘারু। আজ আর কেই বা ভালবাসে নদীরে? সোনা ফলানো তো দূরের কথা, পোড়া মন এখনও কৃষিকাজই শিখল না! সেই আদিকাল হতে নদীই তো বাঁচায়ে রাখল মানবজাতিরে। উর্বরা পলিমাটি কে জোগাল সভ্যতারে? অথচ মানুষ এমনই বেইমান যে, নদীর পর নদীর বুকে চড়া পড়ে, স্রোত শ্লথ হয়ে আসে, খাত সংকীর্ণ হয় দিনে দিনে, মরণের দিন গোনে, তবু তার ভ্রুক্ষেপ নাই!
আরে, নদী শুকালে তোরাও যে সবাই শুকায়ে মরবি সেই জ্ঞানও নাই? এত লোভ, এত লোভ তোদের? যে নদী সভ্যতারে অন্ন জোগায়, মায়ের স্নেহে লালন-পালন করে যুগ যুগ ধরে সে নদী নিজে কী পায়? হায়, সে পান করে সভ্যতার বিষ! যেমন গাছ সভ্যতারে প্রাণবায়ু দান করে বদলে পায় নিঃশ্বাসের বিষ তেমনই নীলকণ্ঠ নদী।
আরও পড়ুন-বিজ্ঞপ্তি জারি করল শিক্ষা সংসদ
তবে হ্যাঁ, এই দুঃসহ দুশ্চিন্তার মাঝে ভরসার আশ্বাসও পাই বটে কখনও কখনও। ভরসার কথা শোনায় আমার নাতি অবিনাশ। গ্রাম হতে পাঁচ মাইল দূরের এক ইস্কুলে পড়ে সে। এগারো কেলাসে। অনেক বইপত্তর পড়ে নাতি আমার। রোজ রাত্তিরে বিজলি বাতির আলোয় দুলে দুলে সে আমারে সারা দুনিয়ার নদীদের কথা শুনায়। জলের কলকল আওয়াজের মাঝে নাতির গলায় নদীপাঠ বেশ লাগে আমার। অনেক কিছু জানতি পারি। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীদুটির মাঝ বরাবর নাকি জন্মেছিল দুনিয়ার আদি সভ্যতা, কী যেন নাম, হ্যাঁ , মেসোপটামিয়া, তাই না? তারপর ধরো ওই সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু নদ, তার পাঁচখান উপনদী, বিপাশা, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, আরও কী কী যেন। নাতি আমারে শুনায় চিনের দুঃখ হোয়াং হোর কথা। আর শুনায় নীলনদ, নীলনদের যাত্রাপথ, তার হাসিকান্নার কথা। নাতি বলে, এখন নাকি সব দেশেই নদী দিবস পালন করা হয়। নদীগুলারে বাঁচায়ে রাখার জন্যি নাকি খুব চেষ্টা করতিছে সব দেশের সরকার। কী জানি বাবা, আমার তো তেমন পেত্যয় হয় না। মনে কত যে প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। নাতিরে বলি, হ্যাঁ রে অবু, আমারে বুঝায়ে দে তো একটা ধাঁধা। যে মানুষজাতি পিরিতে বিভোর হয়ে প্রাণখুলে গায় ‘গঙ্গা, গঙ্গার তরঙ্গে প্রাণপদ্ম ভাসাইলাম রে’, সেই মানুষজাতিই পরমুহূর্তে কী করে সেই গঙ্গারেই ‘ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন’ বলে দোষারোপ করে, ধিক্কার জানায়! এ কেমনতর বিচার? আচ্ছা বল তো দেখি, গঙ্গারে দোষারোপ করার অধিকার মানুষের আছে কি? গঙ্গারে ধিক্কার জানাবার অধিকার?