মনখারাপ সবার। শীতের সকাল সেদিন কুয়াশা পরিবৃত ছিলই। সঙ্গী করল রহস্যকে। প্রবাসী লেখক সুজন দাশগুপ্তের আকস্মিক মৃত্যু-খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রাথমিক ভাবে তৈরি হয়েছিল রহস্য জাল। তার চেয়েও ঘন হয়েছিল মনখারাপ। যাদবপুরের কৃতী মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সুজন দাশগুপ্ত (Sujan Dasgupta) উচ্চশিক্ষার জন্যই মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেন সেই ষাটের দশকে। পরবর্তীতে গবেষণা ও ডক্টরেট উপাধি লাভের পর সেখানেই পাকাপাকি থেকে যাওয়া এবং দেশকে গর্বিত করে সফল বিজ্ঞানী রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। আজ যা সবার হাতের মুঠোয় সেই সময় তার প্রায় অস্তিত্বই ছিল না। কম্পিউটার, মোবাইল এসব ছিল কতিপয় বিজ্ঞানীদের চর্চার বিষয়বস্তু। সেই সময় থেকেই সুজনবাবু ‘লজিক পাজল’ নিয়ে বুঁদ থাকতেন। নিরলস পরিশ্রমের সার্থকতা আজ আমাদের মুঠোফোনে! তো, তাতে কী? সফল প্রযুক্তিবিদ বলে কি সাহিত্যচর্চার প্যাশন থাকতে নেই? ডক্টর সুজন দাশগুপ্ত (Sujan Dasgupta) প্রাথমিকভাবে নিজের প্রিয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই তাই লিখতে শুরু করেন। বেশিরভাগ লেখাই হত বিজ্ঞানভিত্তিক।
এভাবেই চলেছিল অনেকটা সময়। নব্বইয়ের দশকে, প্রয়াত সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধে, ডিটেকটিভ গল্পে হাত দেওয়া আর তার প্রয়োজনেই সৃষ্টি একেন্দ্রনারায়ণের। সেই সময় কখনও থেমেছে, কখনও ফের চালু হয়েছে একেন্দ্রনারায়ণ সেন ওরফে একেনবাবুর গোয়েন্দাগিরি, মার্কিন গোয়েন্দা ‘ইন্সপেক্টার কলম্বো’র আদলে যাকে সৃষ্টি করেছিলেন সুজনবাবু। যেহেতু মার্কিন-মুলুকে জন্ম তাই নব্য-গোয়েন্দাটির কাজকর্ম বেশিরভাগই ওদেশে। এহেন একেনবাবুকে সাহিত্য থেকে সিনেমার পর্দায় নিয়ে আসার প্রথম ভাবনা যার তিনি পরিচালক অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আচমকাই একটি বই হাতে পান তিনি আর বুঝতে পারেন একে পর্দায় দেখলে বাঙালি খুশি হবেই। পরবর্তী যা কিছু, তা ইতিহাস। প্রথমে সিরিজ, পরে বড়পর্দায় আত্মপ্রকাশ সদ্য গতবছর। আর পর্দার একেনবাবু, প্রভূত জনপ্রিয়তা পাওয়া অনির্বাণ চক্রবর্তী, লেখকের মৃত্যুর খবরে মর্মাহত। নির্দ্বিধায় যিনি বলেন, আমায় এখন অনির্বাণের থেকে ‘একেন’ নামে মানুষ বেশি চেনে।
প্রথম সিরিজ থেকেই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছনো একেনবাবুকে নিয়ে পরপর সিরিজ হয়েছে। ভালবাসায় ঘাটতি পড়ছে না দেখে সাহসে ভর করে প্রযোজকরা একেনকে বড়পর্দার দর্শকের কাছে হাজির যখন করেছিলেন, কথা হয়েছিল তখন অনির্বাণের সঙ্গে। নিজের অভিনয়, একেনবাবুর চরিত্রায়ণ, ওটিটি ও সিনেমা দুই মাধ্যমের তফাত, এসবের পাশাপাশি যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছিল, তা ছিলেন সুজনবাবু (Sujan Dasgupta)। পণ্ডিত ও প্রাজ্ঞ মানুষটি ঠাস বুনোটে জটিল সব রহস্যের জাল বিছোলেও স্বভাবে ছিলেন জলের মতো সহজ ও সরল। পর্দায় একেনবাবু যে এতটা জনপ্রিয়তা পাবে তা ভাবতেও পারেননি। আর তাই পুরো কৃতিত্বই দিতেন যাঁরা এমনটা ভেবেছিলেন, তাঁদের। আর দিতেন অনির্বাণকে।
আরও পড়ুন-আয় কমেছে, ফের কর্মী–ছাঁটাইয়ের পথে ট্যুইটার
বলছিলেন অনির্বাণ, ‘‘যেহেতু সুজনবাবুর কল্পিত একেন চেহারায় ছিল আমার সম্পূর্ণ বিপরীত তাই প্রযোজক ও পরিচালক যখন আমার ছবি পাঠিয়েছিলেন ওঁর কাছে তখন বেশ সংশয়েই ছিলাম। কিন্তু যখন চেহারার বদল ও আমাকে ভাবনার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, উনি খুব মন দিয়েই শুনেছিলেন। রাজিও হয়েছিলেন। নিজের মনে তৈরি থাকা এতদিনের চরিত্রটিকে এক্কেবারে বিপরীতভাবে দেখা ও মেনে নেওয়া কিন্তু সহজ নয়। ২০১৮ তে সিরিজের শ্যুটিং-এর সময় সুজনবাবু দেশে এসেছিলেন। সেই সামনাসামনি আলাপ হয়েছিল। পরবর্তীতে আমার কাজ দেখার পর এত খুশি হয়েছিলেন, আমার সঙ্গে নিয়মিত কথা শুরু সেই থেকে।” অনির্বাণ এর আগেও নানা চরিত্রে অভিনয় করলেও তাঁকে প্রথম জনপ্রিয়তা দিয়েছিল ‘একেনবাবু’ই। কারণ বাংলাবাজারে এরকম গোয়েন্দা আগে কেউ দ্যাখেনি। গোয়েন্দার প্রথাগত ফরমুলার বাইরে একেন’কে সৃষ্টি করেছিলেন সুজনবাবু। একজন নির্বিবাদী, ভোলেভালা, খাদ্যরসিক, দেখলে হাসিই আসে এমন কেউ যে তুখোড় গোয়েন্দা হতে পারে তা কেউ ভাববেই না প্রথমে। আর সেখানেই একেনবাবু ইউনিক। আর তাই, বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই প্রথম দেখাতেই ফ্যান হয়ে গিয়েছিলেন গোয়েন্দা একেন্দ্রনারায়ণের।
শুধু সিরিজই নয়, গত বছর বড় পর্দায় ‘দ্য একেন’কে দেখেও দর্শক খুশি। অনির্বাণ সফল দুই মাধ্যমেই। আর এ খবর পেয়েও দারুণ খুশি হয়েছিলেন সুজনবাবু। অনির্বাণ তখনই জানিয়েছিলেন, প্রযোজকের পরিকল্পনা। ভবিষ্যতেও ওটিটি ও সিনেমা দুই মাধ্যমেই দেখা যাবে একেনকে। সেই মতো ডিসেম্বরেই নতুন ছবির শ্যুটিং শুরু হয়েছে। পাহাড়ের পর এবার মরুভূমিতে। ছবির নাম ‘দ্য একেন: রুদ্ধশ্বাস রাজস্থান’। প্রথম ছবির মতো এ ছবির পরিচালকও জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। আর একেনের দুই সঙ্গীর চরিত্রে সুহত্র মুখোপাধ্যায় এবং সোমক ঘোষ।
এই ছবির শ্যুটিং, সঙ্গে বইমেলায় ‘একেনবাবু সমগ্র’-এর ষষ্ঠ খণ্ডের প্রকাশ এরকম একাধিক কারণে বেশ কিছুদিন হল কলকাতাতেই ছিলেন সুজনবাবু। ঘটনাচক্রে সেদিন বাড়িতে ছিলেন একা। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে প্রকাশ, সম্ভবত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। পুলিশ এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে সংজ্ঞাহীন দেহ। স্রষ্টা এভাবে আচমকাই একেনকে একা রেখে চলে গেলেন। ভুল বললাম, রহস্যকে রেখেও। একেনের বিস্তর মনখারাপ। কিন্তু দায়িত্বও বেড়ে গেল। সুজনবাবুর প্যাশনকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব।