ভাস্কর ভট্টাচার্য: তিনি জাতির জন্য, জাতির প্রত্যেকটি লোকের জন্য একটি মন্ত্র রাখিয়া দিয়াছেন— উত্তিষ্ঠ ও জাগ্রত হওয়ার মন্ত্র। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে ব্রহ্মশক্তি।’ তিনি বলেছিলেন, দরিদ্রদের মধ্যে দিয়ে নারায়ণ আমাদের সেবা পেতে চান।’ তাঁর জীবনের প্রতিটা কথাই যেন আমাদের ঘুমন্ত বিবেক জাগ্রত করার আহ্বান। ওঠো, জাগো, তোমার বিবেককে জাগাও। তুমিও পারো, ঘুমন্ত সমাজের মধ্যে জমে থাকা ঘন তিমিরনাশিনী হয়ে উঠতে। আপামর মানুষের মধ্যে খুঁজেছেন এক মুক্ত, সাহসী দীপ্র তেজের ভারতকে। যে ভারতের যুবকদের হৃদয়ে শাণিত হবে দেশমাতৃকার প্রতি সুতীব্র দেশাত্ববোধ। গীত হবে নবজীবনের গান। বিশেষ করে তরুণ সমাজের নবদিগন্তের দিশারী। তিনি ছিলেন বৈদান্তাক সন্ন্যাসী । বলতে আর বাকি থাকে না কার কথা বলা হচ্ছে। তিনি স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda)।
নরেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda)। দুরন্ত বিলে থেকে বীরেশ্বর বিবেকানন্দ। অনন্ত কর্মযোগী আধ্যাত্মিক শক্তির মহামানব। তাঁর লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর মধ্যে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রকৃত মনুষ্য শক্তির উদ্বোধন। যার মধ্যে কোনও প্রকার কৃপণতা থাকবে না সমস্ত জীবের মধ্যে শিব চেতনার স্ফুরণ ঘটবে।
বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ প্রতিদিন মানুষকে নানা ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইছে অপমানিত করছে এখনও জাতপাতের বিভেদ রক্তপাত করে ব্রাত্য সমাজকে শোষণ করে চলেছে ক্ষমতার বড়াই করা উচ্চবর্ণের একদল মানুষ। এখনও কান পাতলে শোনা যাবে উচ্চবর্ণের কাছে নিম্নবর্ণের একশ্রেণির মানুষ আজও কত অসহায়। এই অসহায় দীর্ণ মানুষকেই, মানবজাতিকেই তিনি সমাজের উঁচুতে উপরের দিকে তুলে টেনে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি বিবেকানন্দ।
বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) যেন যুব সম্প্রদায়ের কাছে উদ্দীপ্ত চেতনার প্রতীক। ঝোড়ো প্রায় তরুণ ও যুব সম্প্রদায়কে তাদের কর্মের পথেই, মুক্তির পথে অনুপ্রাণিত করেছিল, প্রবৃত্ত করেছিল দুঃসাহসিক ব্রত গ্রহণে। বারবার তিনি যুবসমাজকে দেশের কল্যাণে এগিয়ে আসতে বলেছিলেন আহ্বান করেছিলেন তরুণ প্রজন্মকে। আমরা দেখেছি আমাদের জাতীয় আন্দোলনের প্রেরণা এই আত্মবোধের মধ্যে দিয়েই যুব সম্প্রদায়ের কাছে তিনি তুলে ধরেছিলন। তাঁর চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু বীর বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্ম বলিদান করেছিল দেশের মুক্তির অভিপ্রায়ে।
সমকালীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাব জাতীয় আন্দোলনের পাশাপাশি যেদিন পরাধীন ভারতের এক অখ্যাত গৈরিক সন্ন্যাসীর চিকাগো বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে খ্রিস্টান জগতের কাছে ভারতের ধর্মের , ভারতের সংস্কৃতির মর্মকথা সুনিপুণ ও তীব্র ভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন সেদিন তার গৌরবজনক সাফল্যে তরুণ ভারত আত্মনিবেদনের এক নব চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তাঁর মহান বার্তা ছিল যুব সমাজের কাছে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, কোনও জাতির যুব সমাজের চিন্তা ও বুদ্ধির জগতে যখন পরনির্ভরতা এসে যায় তখন জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। পরনির্ভরতা কোনও জাতির উন্নতির সুফল হয়ে ওঠে না। তাই তো তিনি বারবার নতুন প্রজন্মের আহ্বান জানিয়েছেন দেশ ও জাতি গঠনে যুব সম্প্রদায়ের কর্তৃত্বকে। আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই প্রথম তিনিই। তাই তো তিনি নবজীবনের নতুন দিগন্তের উন্মুক্ত পুরুষ হিসাবে আজও দেশে-বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত। তাই স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে তিনি এক অন্যতম পথিকৃৎ পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ।
আরও পড়ুন-নোটঙ্কিবাজ সরকার, আর নেই দরকার
ভারতবর্ষ যখন দুর্যোগের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত বেদনা ও নানা বঞ্চনার ইতিহাসে নিমজ্জিত তখন এই গৈরিক সন্ন্যাসীর যুব সমাজের দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, তোমরা জাগো তোমরা ওঠো। যুব সমাজই পারে কোনও দেশ ও জাতির গৌরবকে আরও অনেক বেশি গৌরবান্বিত করে তুলতে তাই তো তাঁর জন্মদিনকে ভারতবর্ষ আজ যুবদিবস হিসেবে পালন করে চলেছে।
বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) পাণ্ডিত্যের কথা আজ বিশ্বময়। তাঁর চিন্তা, চেতনা, বিদ্যা— তাঁকে আজীবন অনুসরণ করেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে এদেশের মাটিতে এসে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র এই সন্ন্যাসীর আহবানে। তিনি দেখেছিলেন এই মহামানবের মধ্যে এক সিদ্ধপুরুষকে । যাঁর বলিষ্ঠ চেতনা একটা গোটা জাতিকে কেমন ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেদিন তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে এক বিদেশি মনীষী বলেছিলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ অধ্যাপকদের পাণ্ডিত্য একত্র করলেও এই মানুষটির পাণ্ডিত্যের কাছাকাছি পৌঁছাবে না।’ এই কথা বলেছিলেন অধ্যাপক রাইট। প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদ ম্যাকিসম্ মন্তব্য করেছিলেন, ‘যাবতীয় মিশনারি ও যাজকদের দর্শন ও ধর্ম সম্বন্ধীয় সম্মিলিত জ্ঞানের চেয়েও অনেক বেশি জানেন।’
সেদিন আমেরিকার নবজাগ্রত নারী সমাজের মধ্যেও স্বামীজি জাগিয়ে তুলেছিলেন এক নতুন চেতনা। তাঁরা বিবেকানন্দকে দেখেছিলেন মানুষের স্বাধীন চিত্তের ও মুক্তির প্রতীক রূপে। সেদিন বিশ্বের বুদ্ধিজীবী মানুষ তাঁর কাছ থেকে পেয়েছেন নব মূল্যায়নের ধর্মশিক্ষা যার মধ্যে দিয়ে সাম্যবাদের আগমনবার্তা ঘোষিত হয়েছিল। গোটা ইউরোপ সেদিন দেখেছিল ভারতবর্ষের এক তরুণ বৈদান্তিক সন্ন্যাসীকে যার চিন্তা-চেতনায় এক নবমুক্তির বার্তা।
সেদিন গোটা ইউরোপের মন জয় করে যেদিন ভারতবর্ষের মাটিতে পা রাখলেন এই বৈদান্তিক সন্ন্যাসী, সেদিন ভারতবর্ষের আকাশ জুড়ে যুবকদের মধ্যে এক প্রবল উন্মাদনা। স্বামীজির স্বপ্ন সেদিন এ দেশের আপামর যুবকদের কাছে। চাই চরিত্রের, চাই মনুষ্যত্ব। যুবসমাজও সেদিন যেন স্বামীজির জনসেবা ত্যাগ ও সংগ্রামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হল। স্বামীজিকে পেয়ে তরুণ শক্তি উপলব্ধি করল জীবন্মৃত জাতিকে বাঁচাতে গেলে সর্বাগ্রে দরকার যৌবনের শক্তি ও বিপুল কর্মপ্রচেষ্টা। আত্মনির্ভর ভারত চাই, সত্যের ভারত চাই, চাই সাহসী ভারত। স্বামী বিবেকানন্দ সেদিন হয়ে উঠলেন ভারতে প্রথম যুব আন্দোলনের স্রষ্টা। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহরু, মহামান্য তিলক, সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীই স্বীকার করেছেন স্বামীজির কাছে তাঁদের ঋণ। যুব সমাজের প্রতি দিকনির্দেশ করতেই বিবেকানন্দ সেদিন ঘোষণা করেছিলেন এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আগামী ৫০ বছর আমাদের গরীয়সী ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা হউন।’ আর উদাত্ত আহ্বানেই ভারতবর্ষের তরুণ সমাজ সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্ত করতে দেশমাতৃকাকে। অধীনতা থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে।
এশিয়া মহাদেশের এই ভারতবর্ষ পায়ে পায়ে এগিয়েছে। ঝড়-ঝঞ্ঝা অভাব, দারিদ্র্যমোচনের স্বপ্ন নিয়ে। সময়ে সময়ে মহামনীষী থেকে দেশনায়ক এই ভারতবর্ষের মঙ্গল সাধনায় আত্মনিবেদন করেছেন। বিশ্বের কাছে এক সত্য শক্তিধর সনাতন ভারতকে তুলে ধরতে চেয়েছেন।
ভারত এক গৌরবের ভারত হয়ে উঠেছে। তবু কি দেশ দারিদ্র্যমুক্ত, সাম্যচেতনার ভারত মাথা তুলেছে? এখনও আকাশে বাতাসে এক জাতপাতের নির্বিচার অপমানিত, লাঞ্ছিত ধর্মান্ধতার অন্ধকারের ছবি যেন প্রতীয়মান হয়। একদিকে প্রযুক্তির উন্নয়ন, অন্যদিকে দরিদ্র অনাহারের ভারত। এই দারিদ্রের অভিশাপের মুক্তি ঘটাতে পারে আজ থেকে অনেক বছর আগে স্বপ্ন দেখা স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্নের আত্মনির্ভর ভারত। যুবচেতনায় উদ্বুদ্বের ভারত। তাই তো আজও আমাদের কাছে অনেক অনেক বেশি করে প্রয়োজন আদর্শ পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের ভাবচেতনা।
ঋদ্ধচেতনার এই গৈরিক বৈদান্তিক যুগপুরুষকে আজ অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন যুবশক্তির কাছে এক নবদিগন্তের দিশারী হিসেবে।