শহিদের রক্ত হয়নি ব্যর্থ

১৯৯৩ সালের একটু আগে থেকে বলি। ১৯৯০ সাল।

Must read

ডাঃ অলোক দাস: ১৯৯৩ সালের একটু আগে থেকে বলি। ১৯৯০ সাল। দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। আমি, বালু মানে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আমাদের স্কুটার নিয়ে বেরিয়েছি, হাজরা মোড়ে দিদির কাছে যাচ্ছিলাম। খবর এল দিদি আক্রান্ত। মাথায় লাঠির আঘাত। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা পৌঁছেছি। তখন প্রতিদিন হাসপাতালই ছিল আমাদের ঘরবাড়ি। লড়াকু নেত্রীকে দেখতে, তাঁর আরোগ্য কামনায় সেদিনও যে ঐতিহাসিক ভিড় হত তা বলার নয়। হাসপাতালেই জমায়েত। তীব্র যন্ত্রণা নিয়েও হাসপাতালের বেডে বসেই রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেন দিদি।

আরও পড়ুন-রাজ্যে প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ও কেন্দ্র উদাসীন, বিস্ফোরক অভিযোগ রাজ্যপালের, চোখে দেখলাম মানুষের দুর্দশা

যুব কংগ্রেসের দায়িত্বে তখন ছিলেন প্রদ্যুৎ গুহ। আমি, মনা, সুব্রত বক্সি, বালু, অরূপ আরও অনেকে ছিলেন। আমরা দিদির সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিলাম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। দিদির মাথায় তখন ব্যান্ডেজ। বালু দিদিকে কালো রঙের একটি উলের টুপি কিনে দিয়েছিল দিদির মাথা ঢাকার জন্য। তখন দিল্লিতে আমাদের থাকার, বসার জায়গা নেই। অপেক্ষা করছিলাম রাজীব গান্ধীর জন্য। তখন রতন মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় দেবী পালের এমপির কোয়ার্টারে আমরা ঠাঁই পেলাম। অতগুলো ছেলে একটা ঘরে, আলোচনা চলছে। সেইদিনের কথা ভোলার নয়। আমাদের কারওর কাছে একটি কানাকড়িও ছিল না। দিদি নিজে খাবার আনিয়ে খাইয়েছিলেন। আমরা অত কষ্ট করে সেদিন দিদির নেতৃত্বে রাজীব গান্ধীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। দিদি রাজীব গান্ধীকে জানিয়েছিলেন, আপনি যাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলেন তিনি সময় দেননি। প্রধানমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেন, ‘তুমি এস’। নিজের হাতে সাক্ষাতের কাগজে সই করেন। সেটিও আমাদের কাছে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সেই সময় গোটা কংগ্রেস ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের, এমন বলা যায়। যুব নেতৃত্বের হাতে চলে এসেছিল কংগ্রেস। আমরা তখন ছোট ছোট পোস্টার ছাপাতাম।

আরও পড়ুন-সকন্যা আদিবাসী প্রৌঢ়াকে নারকীয় নিপীড়ন বিজেপির

তখন সিপিএম কংগ্রেসকে রাজ্যের ৩০-৪০টা আসন একপ্রকার উপহার হিসাবেই দিয়ে দিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বাংলার মানুষকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য উঠেপড়ে লড়াই করছেন। ছাত্র আন্দোলন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের ‘কালেক্ট’ করতে শুরু করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই আমরা যুবতে কনভার্ট হই। জয়ন্ত ভট্টাচার্যরা তখন আমাদের খুব সাপোর্ট দিয়েছিলেন। এরপর ছাত্ররাই হলেন যুব কংগ্রেসের মুখ। এভাবেই শুরু হয়েছিল আমাদের আন্দোলন। আমাদের ভোট তছনছ করে দিয়েছিল সিপিএম। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই ভোটার আইডেন্টিটি কার্ডের ছবির দাবি তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৩ সালে যুব কংগ্রেসের নেতৃত্বে এই দাবি শুরু করি।

আরও পড়ুন-মণিপুরের নৃশংসতা সভ্যতার লজ্জা

নিজাম প্যালেসের বৈঠকে বসে ঠিক হল সমস্ত জেলার প্রতিনিধিরা আসবেন দাবি জানাতে। ১৪ জুলাই, বুধবার এই দাবি নিয়ে মহাকরণ অভিযানের দিন ঠিক হয়। স্লোগান ছিল ‘No Identity Card, No Vote’. বিভিন্ন সান্ধ্য পত্রিকায় আমাদের এই আন্দোলনকে বিদ্রুপ করা হয়েছিল। আমি আর ববিদা তার প্রতিবাদ করেছিলাম। ১২ জুলাই নুরুল হাসান, তৎকালীন রাজ্যপাল প্রয়াত হন। আমাদের আন্দোলনের দিন পিছিয়ে হয় ২১ জুলাই, বুধবার। আমরা ৬টা পয়েন্ট করেছিলাম। মেয়ো রোড, স্ট্র্যান্ড রোড, ব্রেবোর্ন রোড, মিশন রোড, লালবাজার, এসপ্লানেড। প্রণব বোস, স্বপন বর্ধন, সৌগত রায়, অরূপ রায় আমরা প্রত্যেকে ছিলাম। সিপিএম আমাদের জায়গায় জায়গায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল সেদিন। এসপ্লানেডে ছিলেন আমাদের প্রয়াত মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অতীন ঘোষ, নির্মল ঘোষ, আমি নিজেও ছিলাম। রাজীব-বিশু ছিলেন।

আরও পড়ুন-মোহনবাগান মিডিয়া সেন্টার উদ্বোধনে অঞ্জন স্মরণ, এশিয়াডে যাক দল : বিজয়ন

ঝামেলার সূত্রপাত হয়েছিল মেয়ো রোড থেকে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু তখন রাইটার্সে যেতেন রেড রোড দিয়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তখন একজন নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন, মাইতিদা। জ্যোতি বসু, আইএস অফিসার এবং কয়েকজন মন্ত্রী রাস্তা দিয়ে যাবেন বলে আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিতে বলে পুলিশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের নির্দেশ দেন, কোনও রাস্তা ছাড়া হবে না। আমরা প্রয়োজনে শুয়ে থাকব। জ্যোতি বসু তখন নির্দেশ দেন ‘চার্জ দেম’। এই খবর এল আমাদের কাছে। হোম ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্দেশে পুলিশ আমাদের হটাতে লাঠিচার্জ শুরু করে। এরপর শুরু হয় টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া। এত টিয়ার গ্যাস সেদিন ছোঁড়া হয় যা ছিল চিন্তার বাইরে। এটা চলছিল মেয়ো রোডে কিন্তু ধর্মতলা থেকে সেই আঁচ আমরা পাচ্ছিলাম।

আরও পড়ুন-রাশিয়ার ভয়াবহ হামলা কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনীয় বন্দরে, তীব্র নিন্দা জার্মানি-ফ্রান্সের

এরপর শুরু হয় নির্বিচারে গুলি। সমস্ত লোক তখন ছিটকে আসতে শুরু করেন। প্রত্যেকটি পয়েন্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাওয়ার কথা ছিল। পুলিশ একটা জায়গায় এসে মারতে শুরু করল। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা ছিলেন আমার সঙ্গে। কিন্তু আমরা হটিনি। মঞ্চের ওপরে একজনকে গুলি করে পুলিশ। তখন বিধানসভায় অধিবেশন চলছিল। রক্তে ভেজা সেই জামা নিয়ে বিধানসভায় যান সাধন পাণ্ডে। ৭০টার ওপর গুলি চলেছিল সেদিন। এত আহত হয়েছিল যে বলার নয়। শহিদ হন ১৩ জন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তখন কোনও ক্ষমতা ছিল না কিন্তু তিনি শহিদ পরিবারের একজন করে চাকরি দেন। আমাদের শহিদের রক্ত ব্যর্থ হয়নি। আজ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আশা রেখে বাংলা আরও এগিয়ে যাবে। আন্দোলন ও বলিদানের জয় হবে।

Latest article