বেরিলি! উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত একটি জেলা। সেখানকার সিরাউলি শহর। সাহুকারা অঞ্চলে।
সেখানে বাবা সাহেব আম্বেদকরের মূর্তি ছিল একটা। ছোটখাটো নয়। পাঁচফুট উঁচু। এই ক’দিন আগে, ৬ নভেম্বর মূর্তিটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে। দিনের বেলায় নয়, রাতের অন্ধকারে।
মূর্তিটা তৈরি হয়েছিল মিরাটে। টাকা জুগিয়েছেন স্থানীয় মানুষজন। জনগণের চাঁদায় নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় সংবিধানের প্রাণপুরুষের মূর্তি।
২৪ ঘণ্টও কাটেনি। পুলিশি হামলা। বুলডোজার (Bulldozer) দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বাবা সাহেব আম্বেদকরের মূর্তি।
কেন?
উত্তরপ্রদেশের পুলিশ, যোগী আদিত্যনাথের আরক্ষা বাহিনী যে কোনও বুলডোজার-কাণ্ডে যে যুক্তি প্রয়োগ করে, এখানেও তার ব্যত্যয় হয়নি। সিরাউলির পুলিশ, বেরিলি জেলা প্রশাসন এক্ষেত্রেও জানিয়েছে, সরকারি জমিতে মূর্তিটা বসানো হয়েছিল। সেটা যে বেআইনি, তা জানানো হয় স্থানীয় লোকজনকে। অনুরোধ করা হয়েছিল মূর্তিটা সরিয়ে অন্যত্র স্থাপন করার জন্য। স্থানীয় অধিবাসীরা শোনেননি সেকথা। উল্টে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়ে তারা। ফলে, জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ‘হাল্কা বল প্রয়োগ’ করতেই হয়েছিল পুলিশকে। মূর্তিটার ‘সম্মানজনক ভাবে’ অপসারণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থাও নেওয়া হয় তাদের তরফে।
স্থানীয় লোকজন কিন্তু অন্য কথা বলছেন। যেমনটা বলে থাকেন যোগীর পুলিশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু মুসলমানরা, যেমনটা বলে থাকেন আদিত্যনাথের বুলডোজার-কাণ্ডের সম্বন্ধে দলিতরা।
তাঁরা বলছেন, সে-রাতে একটা নয় পাঁচটা থানার পুলিশ এসেছিল তাঁদের শহরে, তাঁদের ‘পেটাতে’, মূর্তি ‘ভাঙতে’। তারা নাকি অদ্ভুতভাবে, বিচিত্র কৌশলে লাফিয়ে লাফিয়ে তাঁদের বাড়ির ছাদগুলোতে উঠে পড়েছিল। সেখান থেকেই কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটানো শুরু হয়। বাকি যেসব উর্দিধারী ছাদে না থেকে মাটিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা জাতপাত তুলে বেদম গালিগালাজ করছিলেন। সেইসঙ্গে চালাচ্ছিলেন লাঠি। বেদম প্রহার আর গালিগালাজ যুগপৎ চলছিল। বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে পেটানো হয় স্থানীয় অধিবাসীদের।
আর মূর্তিটার কী হল?
স্থানীয় মানুষজন বলছেন, বাবাসাহেব আম্বেদকরের মূর্তিটাকে ‘যথোচিত মর্যাদা সহকারে সরিয়ে ফেলার আয়োজন হয় বুলডোজারের (Bulldozer) সাহায্যে।
দেশ জুড়ে এখন নাকি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চলছে। সেই হুজুগের ভেতর আপন অস্মিতা প্রকাশের জন্য দলিতরা বেছে নিয়েছেন আম্বেদকর ও পেরিয়ারের মূর্তি। উত্তর ভারতের দলিতরা আসলে আম্বেদকরের মধ্যে নিজেদের প্রতিস্পর্ধী চেহারাটা খুঁজে পান। সেজন্যই এই আচমকা উন্মাদনা মূর্তি স্থাপনার জন্য।
আর সেজন্যই সম্ভবত মূর্তির ওপর, আম্বেদকরের মূর্তির ওপর, আক্রোশে ফেটে পড়তে চাইছে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা। বেরিলির সিরাউলি-সাহুকারায় যা ঘটল, সেটা তারই প্রকাশ। বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার কারণ গত এক বছরে উত্তরপ্রদেশে আধ ডজনেরও বেশি আম্বেদকরের মূর্তি হয় ভাঙা হয়েছে নয় বিকৃত করা হয়েছে। আর সব ক’টি ক্ষেত্রে পুলিশ— যোগী আদিত্যনাথের পুলিশ— একটাই কথা ফাটা রেকর্ডের মতো বলে এসেছে। ‘সব দুষ্কৃতীদের অপকর্ম’।
আর-একটা কথা বলা দরকার।
উত্তরপ্রদেশ ছাড়া যে রাজ্যে এরকম ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটছে, সেটাও বিজেপি-শাসিত রাজ্য। মধ্যপ্রদেশ।
যারা আম্বেদকরের মূর্তি ভেঙে সরিয়ে, দলিত পিটিয়ে, নিম্নবর্গীয়, নিম্নবর্ণীয়দের প্রতি প্রেম দেখানোর ভান করে, তাদের জন্য আমাদের একটা উচ্চরণ—
ছিঃ!
একী অনাচার! চলছে বুলডোজার! এরা নাকি দলিত-দরদি ?
হঠাৎ করে বঙ্গমঞ্চে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে গেরুয়া হল্লা পার্টি। দলিতের জন্য দরদে কুমিরের কান্না দিকে দিকে। বিজেপি-র এসব বলার, করার, নৈতিক অধিকার আছে? বেরিলির একটা সাম্প্রতিক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সরাসরি সেই প্রশ্নটা তুলে ধরলেন আকসা আসিফ