একদল গবেষক-বিজ্ঞানী বানিয়েছেন এক বিশেষ ধরনের পারমাণবিক ঘড়ি। যা অতি সূক্ষ্ম। পাশাপাশি পরিমাপ করবে অন্য এক বিশেষ ঘটনা। কিন্তু সময়কাল ছাড়া আর কী মাপা যাবে ওই ঘড়ি দিয়ে? জানালেন অর্পণ পাল
আরও পড়ুন-দুর্গাপুরের সেই সভায় সুব্রতদার বিস্ফোরক বক্তৃতা
সময় মাপতে লাগে ঘড়ি। ইদানীং যা হাতে পরবার চল অনেকটাই কমে গিয়েছে পকেটে থাকা মোবাইল নামক সর্বরোগহরা বস্তুটির কল্যাণে। অথচ এই ঘড়ির নানান জাত নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার কিন্তু অন্ত নেই। অ্যানালগ-ডিজিটালের বেড়া পেরিয়ে এখন অতি-সূক্ষ্ম পারমাণবিক ঘড়ির যুগ।
আরও পড়ুন-রাজ্যের মুকুটে এবার আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসব
ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো-র এক দল গবেষক-বিজ্ঞানী সম্প্রতি বানিয়েছেন এক বিশেষ ধরনের পারমাণবিক ঘড়ি, যা অতি-সূক্ষ্ম তো বটেই, পাশাপাশি পরিমাপ করবে অন্য এক বিশেষ ঘটনা। কিন্তু সময়কাল ছাড়া আর কী মাপা যাবে ওই ঘড়ি দিয়ে?
না, ঠিক ক’টা বাজে এখন— এই ধরনের মামুলি প্রশ্ন করে বিব্রত করা যাবে না সে ঘড়িকে। বরং তাকে শুধোতে হবে, ঠিক কতটা সময়ের ফারাক চোখে পড়ছে তোমার, এক মিলিমিটার দূরত্বে থাকা দুটো স্থানের মধ্যে?
আরও পড়ুন-হাসপাতালের ফায়ার অডিট, নির্দেশ নবান্নের
এইখানেই অনেকে অবাক হবেন, দুটো স্থানের মধ্যে আবার সময় পরিমাপে ফারাক হয় নাকি? দুটো ঘড়ির মধ্যে যান্ত্রিক তফাত বা ত্রুটি থাকলে হয়তো সময়ের হেরফের হতে পারে, কিন্তু ঠিক একইরকমের (মানে একই কোম্পানির এবং একই মডেলের) দুটো ঘড়ি নিয়ে যদি দু-জন ব্যক্তি দুটো আলাদা জায়গায় উপস্থিত থেকে ক’টা বাজে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চান তাঁদের নিজেদের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, তবে তফাত কেন হবে?
আরও পড়ুন-এ মাসেই পুরভোটের নির্ঘণ্ট
হ্যাঁ হবে। আর সেটাই প্রথম বলেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। তাঁর বিখ্যাত সেই আপেক্ষিকতাবাদের সাধারণ তত্ত্বের একটা অংশে বলা আছে যে, খুব ভারী কোনও মহাকর্ষীয় বস্তুর (যেমন ভারী নক্ষত্র) কাছাকাছি এলাকায় ওই বস্তুটির প্রবল মহাকর্ষীয় টানের কারণে সময় পর্যন্ত বদলে যেতে পারে।
ওইখানে কোনও ঘড়িতে একটা নির্দিষ্ট সময়কাল (ধরা যাক একটা গোটা মিনিট বা ষাট সেকেন্ড যতক্ষণে অতিবাহিত হয়) যতক্ষণ স্থায়ী হবে, ওই নক্ষত্র থেকে দূরের কোনও স্থানে সেই সময়কাল কিছুটা কম স্থায়ী হবে।
আরও পড়ুন-ক্ষুব্ধ সুপ্রিম কোর্ট
অন্যভাবে বললে, ভারী নক্ষত্রের কাছে গেলে কোনও ঘড়ি যেন স্লো চলতে শুরু করবে। তবে এই স্লো চলার ব্যাপারটা এতটাই সূক্ষ্ম, সাধারণ কোনও ঘড়ি নিয়ে করতে গেলে সেটা নজরেই আসবে না। মহাকর্ষীয় টান বস্তুর চারপাশের স্থান-কাল বা স্পেস-টাইম নামক ব্যাপারটাকে পারে বদলে দিতে, তাই জন্যেই সময় পরিমাপে চলে আসে ফারাকটা।
আরও পড়ুন-কারখানা গড়তে ল্যান্ড ব্যাঙ্ক থেকে জমি দেবে সরকার , সবুজসাথী সাইকেল রাজ্যেই
এই ঘটনার নাম মহাকর্ষীয় সময়-প্রসারণ বা ‘গ্র্যাভিটেশনাল টাইম ডাইলেশন’। এতদিন এই ঘটনাকে হাতেকলমে পরীক্ষা করা হত পৃথিবী বা সূর্যের মতো ভারী বস্তুর মহাকর্ষীয় টানের ক্ষেত্রে, এবার সেই পরীক্ষাই করা হচ্ছে অনেক ক্ষুদ্র এলাকায়।
সেই ঘটনাটিই পরিমাপ করেছেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষকেরা। কোনও ভারী তারার কাছে-দূরে সময়ের প্রসারণতা নয়, তাঁরা মেপেছেন খুবই ছোট্ট একটি স্থানের দুই প্রান্তে সময়ের যে ফারাক, সেইটুকু। কত ছোট্ট সেই জায়গা?
আরও পড়ুন-কারখানা গড়তে ল্যান্ড ব্যাঙ্ক থেকে জমি দেবে সরকার , সবুজসাথী সাইকেল রাজ্যেই
এমনিতে এতদিন যাবৎ যে ধরনের পারমাণবিক ঘড়ি নিয়ে সূক্ষ্ম সময় পরিমাপ চলে আসছে, তাতে সময়ের এই হেরফেরটা মাপা যেত তেত্রিশ সেন্টিমিটার বা প্রায় তেরো ইঞ্চি দূরত্ব অব্দি। আর এই গবেষক দল যে সময়-ফারাক মেপেছেন, সেটা মাত্রই এক মিলিমিটার দূরত্বের মধ্যে! যা, অনেকেরই মতে, অবিশ্বাস্য সাফল্য।
আরও পড়ুন-সোমা দাশের উপর বিজেপির আক্রমণ প্রতিবাদ তৃণমূল কংগ্রেসের
কিন্তু এঁরা কীভাবে করলেন কাজটা?
প্রায় এক লক্ষ স্ট্রনশিয়াম ধাতুর পরমাণুকে একটা পাতলা চাদরের মতো জায়গায় একত্রিত করা হয়। সমান দূরত্বে সাজানো পরমাণু দিয়ে তৈরি ওই চাদরের পুরুত্ব বা বেধ হয় এক মিলিমিটার, আর তার উষ্ণতাকে রাখা হয় পরম শূন্যের প্রায় কাছাকাছি (পরম শূন্য বলতে মাইনাস দুইশো তিয়াত্তর ডিগ্রি সেলসিয়াস।
মহাবিশ্বে এর চেয়ে কম উষ্ণতা কোথাও পাওয়া যায় না তাই একে পরম শূন্য আখ্যা দেওয়া হয়েছে)। এখন ওই পরমাণুর পাতলা চাদরের ওপর ফেলা হয় নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো। বা বিকিরণ। সেই আলোর উপাদান-কণার সঙ্গে বিক্রিয়া হবে পরমাণুগুলির। পরমাণু-চাদরের যে পরমাণু পৃথিবী থেকে যত কাছে বা দূরে (অর্থাৎ মাটির কাছাকাছি বা দূরে কি না) সেই অনুযায়ী সে বিক্রিয়া করবে আলোর সঙ্গে।
আরও পড়ুন-গোয়ায় দলে অব্যাহত যোগদান
পরমাণুরা কিছু নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো বা বিকিরণ পেলে কম্পিত হয়, যে কম্পনের ওপর ভিত্তি করে পরমাণুকে কাজে লাগানো হয় ঘড়ির মতো সময়-পরিমাপক ব্যবস্থা হিসেবে। এক একটা শক্তির স্তর থেকে অন্য শক্তির স্তরে পরমাণুর ঝাঁপ দেওয়া সম্ভব হয় বাইরের ওই বিকিরণ থেকে শক্তির শোষণ করবার ফল হিসেবে। আর এই ঝাঁপ দেওয়ার সময়েই সে আবার বিকিরণ করে নির্দিষ্ট কিছু কম্পাঙ্কের বিকিরণ।
আরও পড়ুন-ভয়াবহ দূষণের জেরে দিল্লির হাসপাতালে বাড়ছে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীর সংখ্যা
এই বিকিরণের যে ঢেউ, সেটারই কম-বেশি হওয়া ঘটতে দেখা গিয়েছে ওই মিলিমিটার-পুরু পাতের দুই প্রান্তের উপাদান-পরমাণু থেকে নির্গত বিকিরণের মধ্যে। কম্পাঙ্কের পরিমাপে অত্যন্ত কম সেই ফারাকটাই দেখিয়ে দিয়েছে যে ওপরে-নিচে থাকা দুটো স্থানের মধ্যে সময়ের খুব সূক্ষ্ম একটা হেরফের আছেই। ওপরের অবস্থানে সময় যেন কিছুটা দ্রুত, নিচে স্লো। দুটো অবস্থানে কম্পাঙ্কের ওই হেরফেরকে বিজ্ঞানীরা বলেন ‘গ্র্যাভিটেশনাল রেড শিফট’, বাংলায় বলতে পারি মহাকর্ষীয় লাল-সরণ।
আরও পড়ুন-রাজ্যে মহা আড়ম্বরে পালিত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন
বর্ণালিতে লাল রঙের কম্পাঙ্ক কম আর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি, বস্তু থেকে যত দূরে সরে যাওয়া হয় ততই আলোর বিকিরণের (বা ওই আলোর একক কণা ফোটনের) তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে বলেই এই নাম। আর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বৃদ্ধি মানেই কম্পাঙ্কের হ্রাস, সুতরাং বস্তু থেকে ফোটনকণা যত দূরে সরবে তার কম্পাঙ্ক ততই হ্রাস পাবে।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সাধারণ তত্ত্বের এই বিশেষ ঘটনাটিকে বাস্তবে প্রমাণ করা হয়েছিল পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে, তবে এত সূক্ষ্ম জায়গায় তার সত্যতা এবার প্রমাণিত হওয়ায় বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, আগামী দিনে পদার্থবিদ্যা আর মহাকাশবিদ্যার আরও বেশ কিছু রহস্যের সমাধান করা যাবে এই পারমাণবিক ঘড়ির সাহায্যে।