কংগ্রেস পার্টির এত দুরবস্থা এর আগে কেউ কখনও দেখেছেন বলে মনে হয় না। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা মণীশ তিওয়ারি বলেছেন পাঞ্জাবে কংগ্রেসের যে অভ্যন্তরীণ কলহ দেখা যাচ্ছে এরকমটা উনি গত চল্লিশ বছরে দেখেননি।
গত ছয় মাস ধরে ভয়াবহ যাত্রাপালা পাঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনের মুখে চলছে! এমনটা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারি শুধু দেখেননি তাই নয়! তিনি বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ক্যাপ্টেন অমরিন্দরকে সরানো নভজোৎ সিং সিধুকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি করা এসব করেও কিন্তু কোনও সমস্যা সমাধান হয়নি। উল্টে কংগ্রেসের যিনি পাঞ্জাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সেই হরিশ রাওয়াত তিনি প্রহরীর পদ থেকে নিজেই ইস্তফা দিয়ে দিয়েছেন। রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন হরিশ রাওয়াত সেবাদলের সভাপতি ছিলেন। মণীশ তখন ছাত্র সংগঠন এনএসইউআই-এর সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন।
চোখের সামনে গত চল্লিশ বছরে তিল তিল করে কংগ্রেসের যে অধোগতি, যে ধরনের অবক্ষয় চোখের সামনে দেখলাম সেটাও আমি সাংবাদিক জীবনে এর আগে কখনও দেখিনি।
মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়া লোকসভার উপনির্বাচন আসছে। সেখানে মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেসের এক বিশিষ্ট নেতা কংগ্রেসের বিধায়ক শচীন বিড়লা কংগ্রেস ছেড়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের উপস্থিতিতে বিজেপির সদস্য পদ গ্রহণ করলেন।
আরও পড়ুন- কংগ্রেসের এ কী হাল
কে এই শচীন বিড়লা? তিনি মধ্যপ্রদেশের একজন বিশিষ্ট গুর্জর সমাজের নেতা। এহেন শচীন বিড়লা যোগ দিয়েই বলেছেন, আমি খুব গর্বিত যে আজ আমি দেশের সবচেয়ে যেটা বড় দল সেই দলের সদস্য হলাম। আর আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এজন্য কৃতজ্ঞ। মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান একটু রসিকতা করেই বলেছেন ‘‘বরি দের লাগি নন্দলালা”।
আসলে রাহুল গান্ধী নিজেই এক অদ্ভুত ধারাবাহিকতাহীনতার শিকার। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সমস্ত সদস্য দাবি করছেন যে রাহুল গান্ধী যেন সভাপতি পদের দায়িত্ব নেন। রাহুল গান্ধী তখন মাথা নিচু করে বসে আছেন। আর বলছেন, না, তিনি এখনও সভাপতি পদের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত নন, ভবিষ্যতে ভেবে দেখবেন। সোনিয়া গান্ধী এই বয়সে এই শারীরিক পরিস্থিতিতে কার্যত বাধ্য হয়েছেন কিছুদিনের জন্য এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে।
সমস্যা হচ্ছে রাহুল গান্ধী যদি দায়িত্ব নিতে রাজি না থাকেন এবং কংগ্রেস সংগঠন থেকে দূরে চলে যেতে চান তাহলে তিনি পুরোপুরি ছেড়ে দিন। কিন্তু তিনি দায়িত্বভার না নিয়ে সংগঠনটাকে মজবুত করার জন্য চেষ্টা করবেন, ঘরোয়া বৈঠক করবেন তাঁর তুঘলক রোডের বাড়িতে বসে, আর সারাদিন ধরে তিনি নানা ঘটনায় ট্যুইট করবেন, এটাও কিন্তু কংগ্রেস নেতা এবং কর্মীদের মধ্যে আরও বেশি করে সংশয় সৃষ্টি করছে। ‘ঘরেও নহে বাহিরেও নহে’ এরকম একটা পরিস্থিতি! এটা কি একটা কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি? ধরুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এমনটা করতেন? এই ধরনের কাণ্ডকারখানা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় করতেন? তাহলে আমরা কি বলতাম যে উনি খুব বিচক্ষণ? ওঁকে এই পরিস্থিতিতে কোনওরকম দায়িত্ব না নিয়ে শুধু ভাবার জন্য সময় দেওয়া হোক?
আরও পড়ুন-জয়ের হ্যাটট্রিকের সামনে পাকিস্তান
একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এখানে দায়িত্বভার গ্রহণ করতেই হবে। দায়িত্ব না নিয়ে ক্ষমতা ভোগ করা— সেটা কিন্তু কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মীরাও মেনে নিতে পারছেন না।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে আমি রাহুল গান্ধীর একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আনন্দবাজার পত্রিকার জন্য। তখন আমার কিন্তু মনে হয়েছিল যে রাহুল বেশ বুদ্ধিমান। কিন্তু যে কনফিডেন্স একান্তে কথা বলার সময় রাহুলের মধ্যে দেখেছি, রাহুল যখন জনসভায় দাঁড়ান, প্রচুর মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেন তখন কিন্তু সেই কনফিডেন্সটা আমি আজও কিন্তু খুঁজে পাই না। এটা কিন্তু আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত। ২০১৪ সালে কিন্তু রাহুল গান্ধী স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিলেন যে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসছেন। যেহেতু তিনি দলের কান্ডারি তাই প্রকাশ্যে সেকথা বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাহলে দলের সবথেকে নিচুতলার সর্বশেষ কর্মীদের মধ্যেও হতাশা ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু রাহুল একটা কথা আমাকে একান্তে বলেছিলেন, আসলে একটা hologram-এর সঙ্গে যেন লড়াই করছি। নরেন্দ্র মোদি যেন কোনও একটা রক্তমাংসের মানুষ নন, একটা ম্যানুফ্যাকচারড পাবলিক ওপিনিয়ন। যাকে পরবর্তীকালে অনেকেই alternate reality নাম দিয়েছেন। এই বাস্তবতা তৈরি করে কখনও পুলওয়ামা আক্রমণ, কখনও ১০০ কোটি মানুষের টিকাকরণ। এই ধরনের প্রচারকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী বলছেন, পোস্ট ট্রুথ— ইনফর্মেশন গেম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক দীপঙ্কর সিনহা এই বিষয়ের ওপর গবেষণা করে একটা বই পর্যন্ত লিখেছেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন যে বাস্তবে একটা প্রান্তিক মানুষ পর্যন্ত ঠিক কতটা পরিষেবা পৌঁছচ্ছে সেটা বড় কথা নয়! কিন্তু এই মিডিয়াটাইজড গণতন্ত্রে এমন একটা ঢক্কনিনাদ গড়ে তুলতে হবে যেখানে হবুচন্দ্র রাজা এবং গবুচন্দ্র মন্ত্রীর দেশে মানুষ আহা আহা করতে শুরু করবে। আর পিরামিডের নিচুতলা পর্যন্ত অর্থাৎ সভ্যতার পিলসুজের সর্বশেষ প্রান্ত পর্যন্ত সেই বাণী ছড়িয়ে পড়বে। অল্টারনেট রিয়েলিটির যে খেলা সেই খেলা একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু ২০২১ সালে খেলা হবে নাম দিয়ে সেই বিজেপির খেলাটাকে ভেস্তে দিতে পেরেছেন। আর আজ তাই গোটা দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটা জাতীয় বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে ।
(পরবর্তী অংশ আগামিকাল)
আরও পড়ুন-শুরুতে কিছুটা নার্ভাস ছিলাম: ট্রাম্পলম্যান
ধোঁয়াশার রাজনীতিই ডোবাল কংগ্রেসকে
কোনও বিষয়ে জোরালো কোনও অবস্থান নেই। রাজ্যে রাজ্যে সিদ্ধান্তহীনতার শিকার এই শতাধিক বছরের প্রাচীন রাজনৈতিক দলটি। জনভিত্তিক রাজনৈতিক দলের চারিত্র খুইয়ে কংগ্রেস এখন গণ-আন্দোলনকে জোরদার করার জায়গায় নেই। এক সময়ের গ্রেট কংগ্রেস এখন ডার্টি কংগ্রেস। ইতিহাস ও বর্তমান ঘেঁটে মূল্যায়ন করেছেন জয়ন্ত ঘোষাল
(গত কালের পর)
কংগ্রেসের এই যে অধঃপতন, এই যে মিস ম্যানেজমেন্ট, এই যে অবক্ষয় এটা কিন্তু আজ হঠাৎ শুরু হয়েছে এমন নয়। সুতরাং সবটাই রাহুল গান্ধীর জন্য হয়েছে এমনটা বললে সত্যের অপলাপ হয়। অথচ এই মুহূর্তে দেখছি পাঞ্জাব শুধু নয়, বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের এই দিশাহীনতা স্পষ্ট। ছত্তিশগড়ে মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল। সেখানে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি টি এস সিংদেও মুখ্যমন্ত্রীকে সরানোর দাবিতে সক্রিয়। ভূপেশ বাঘেল এসে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছেন, টি এস সিংদেও— তিনিও দেখা করেছেন। তার কারণ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় ক্ষোভ-বিক্ষোভ ভালমতোই ছিল। আর সেটার মোকাবিলা করার জন্য তখন কংগ্রেস হাইকম্যান্ড কথা দিয়েছিলেন যে একটা সময়ের পর টি এস সিংদেও-কে মুখ্যমন্ত্রী করা হবে। অর্থাৎ, Rotational মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাইকম্যান্ড আর সেটা করতে পারছেন না বা করতে চাইছেন না। তবে ব্যবস্থাটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। Rotational মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই, Rotational প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়। হয় না, এমনটা নয়। ইজরায়েলে এই মুহূর্তে rotational প্রধানমন্ত্রী তত্ত্ব বাস্তবায়িত করা হয়েছে। কই সে-দেশে তো এরকম কোনও বিক্ষুব্ধ কার্যকলাপ দেখা যাচ্ছে না। বরং বিক্ষুব্ধ কার্যকলাপ থামাতে, ক্ষোভ-বিক্ষোভ সামাল দিতে, ইজরায়েলেই এই ব্যবস্থাটা চালু হয়েছে আর সেটা সকলে মানছেনও। এখানে প্রশ্ন এটাই যে, এই পথে হেঁটে কংগ্রেস তার অভ্যন্তরীণ বিবাদ সামাল দিতে পারছে না কেন? আসলে রাহুল গান্ধী যেহেতু নিজে দায়িত্ব গ্রহণ করছেন না সেহেতু তাঁর নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্বের মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। সেই কারণে কংগ্রেস কর্মীরা, কংগ্রেসের রাজ্যস্তরের নেতারা উপরতলার নির্দেশ মানছেন না। রাহুল গান্ধী আসলে যে কী নির্দেশ দিয়েছেন, সেটাই তো স্পষ্ট নয়। গোড়াতেই গলদ থেকে যাচ্ছে। সুস্পষ্ট কোনও নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে না রাহুল গান্ধীর কাছ থেকে। বিভিন্ন নেতাকে বিভিন্ন বার্তা দিলে কখনওই নেতৃত্ব শক্তিশালী হতে পারে না। নানা জনকে নানা কথা শুনিয়ে অবস্থা মোকাবিলার চেষ্টা করলে কোনও পক্ষই নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে না। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে এবং হচ্ছে। পাঞ্জাবে এটাই হয়েছে বা হচ্ছে। ক্যাপ্টেন অরমিন্দর সিং-এর পক্ষে রাহুল গান্ধী ছিলেন নাকি নভজোৎ সিং সিধুর পক্ষে ছিলেন, সেটা তো স্পষ্ট নয়। ফলে কোনও পক্ষই তাঁকে আস্থাভাজন ভাবতে পারেনি। সেইমতো রাজনৈতিক পথ রচনার দিকে এগোতে পারেনি। উত্তরাখণ্ডেও একই ব্যাপার। যিনি উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হতে চান, যিনি উত্তরাখণ্ডের ছায়া মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উত্তরাখণ্ডে গিয়ে রাজনীতি করতে চান, তাঁকে পাঞ্জাবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ঝামেলা সামলাতে হবে। বলা বাহুল্য, সেই দায়িত্ব তিনি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এখন উত্তরাখণ্ডের ছায়া মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে করা হবে কিনা সেই নিয়ে উত্তরাখণ্ডের রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে তুলকালাম চলছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও ছবিটা আলাদা কিছু নয়। হাইকম্যান্ডের নীতিতে, অবস্থানে স্পষ্টতা না থাকায় অধীর চৌধুরি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়মিত আক্রমণ করছেন। এদিকে সোনিয়া গান্ধী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চা পানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন এবং সেখানে রাহুল গান্ধী উপস্থিত থাকছেন। সেখানে বিজেপিকে সর্বভারতীয় প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সমবেতভাবে বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা কংগ্রেসের নীতি কোনটা কংগ্রেসের কৌশল সবটাই একটা অস্পষ্ট। সবটাই ভাসা ভাসা। কোথাও কোনও বলিষ্ঠ নীতি আঁকড়ে এগোনোর লক্ষণ নেই। কোনও নির্দিষ্ট নীলনকশা প্রণয়ন ও রূপায়ণের কোনও উদ্যোগ আয়োজন নেই। কংগ্রেসের ইতিহাস একশো বছরেরও বেশি পুরনো ইতিহাস। একটা সময় কংগ্রেসের মাধ্যমেই ভারতের জাতীয়তাবাদের বিকাশ হয়েছে। স্বাধীনতার আগে জাতীয় কংগ্রেসের প্ল্যাটফর্মের সাহায্য নিয়ে ভারতে জাতীয়তাবাদী শক্তি বিকশিত হয়। তারপর আস্তে আস্তে সেই কংগ্রেসের অবক্ষয় শুরু হয়। ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাস তাঁর ‘Interrogating Politics and Society : Twentieth-Century Indian Subcontinent’ গ্রন্থে লিখেছেন যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একটা জাতি গঠনের ডায়নামিকস ছিল। আর সেই ডায়নামিকস কালক্রমে নষ্ট হয়। একটা গ্রেট কংগ্রেস থেকে একটা ডার্টি কংগ্রেসে পরিণত হয় দলটি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট এরপর থেকে ধীরে ধীরে তার যে ঐতিহাসিক লিগ্যাসি সেটা নষ্ট হতে লাগল। কিন্তু কংগ্রেস ভারতের প্রথম একটা mass based রাজনৈতিক দল। গান্ধীজির নেতৃত্বে সেই mass mobilizationটা হয়েছিল। কিন্তু এই কংগ্রেস গঠনের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় রাজনীতির যে radicalism-এর দিকটা ছিল সেটার marginalisation হয়েছে বলে সুরঞ্জন দাস মনে করেন।
(পরের অংশ আগামিকাল)
আরও পড়ুন-নীরবতা ভেঙে ক্ষমা প্রার্থনা ডি’ককের
বিরোধী ঐক্যই এই সময়ের দাবি
১৯৭৭-এ ভারতের রাজনীতিতে এরকম একটা সময় এসেছিল। তাবৎ শর্ত ও ক্ষুদ্রস্বার্থ ভুলে আসমুদ্রহিমাচলে বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়েছিল। অবসান হয়েছিল অগণতান্ত্রিক জমানার। সেদিন জয়প্রকাশ নারায়ণ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভারত-ইতিহাসে আবার সেরকম এক প্রহর। মাহেন্দ্রক্ষণ সমুপস্থিত। কংগ্রেসকে বাস্তবটা বুঝতে হবে। বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল
(গতকালের পর)
আস্তে আস্তে কংগ্রেসের মধ্যে বিবর্তন ঘটে। বাম এবং ডান, দুই ধরনের রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটে। ফলত দল হিসেবে কংগ্রেস একটা অন্যরকম সম্ভবনার বলিষ্ঠ ভিত্তি রচনার অবকাশ পেয়ে যায়। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সে-সময় গণতন্ত্রের বিকাশ হয়।
এরকম সময়েও এমন কিছু কিছু পদক্ষেপ কংগ্রেস সরকার নেহরুর সময় পর্যন্ত করেছিল যেগুলো ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে খুব ভাল দৃষ্টান্ত কিন্তু নয়।
যেমন নেহরুর সময়ে অনেকগুলো রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছিল আর সেই রাষ্ট্রপতি শাসন জারির যে ঘটনাগুলো সেগুলোকে সুরঞ্জন দাস তাঁর উল্লিখিত ‘Interrogating Politics & Society : Twentieth-Century Indian Subcontinent’ গ্রন্থে অগণতান্ত্রিক বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী বলে তুলে ধরেছেন। স্মর্তব্য, ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ অন্তত পাঁচ বার অ-কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সেই সরকার ফেলার ক্ষেত্রে কোনওরকম সাংবিধানিক নৈতিকতা গুরুত্ব পায়নি। এটা কেরলে করা হয়েছে, এটা অন্ধ্রপ্রদেশে করা হয়েছে, এটা ওড়িশায় করা হয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এরপর ধাক্কা খেল কংগ্রেস। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধীর সময়ই জোরালো ধাক্কা খেল তারা। এটা ঘটল ১৯৬৯ সালে।
একটা নয়, দুটো নয়, ন’টা রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হয় তারা। এমনটা আগে কস্মিনকালেও কংগ্রেস ভাবেনি, এমনকী দুঃস্বপ্নেও নয়।
এর পর ভাঙন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়েই কংগ্রেসের ভাঙনের শুরু। দু-দুবার কংগ্রেস ভেঙেছে। সেই সময়েই।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তি তখনও ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে জনসংঘ থেকে বিজেপিতে রূপান্তর হওয়ার পর আস্তে আস্তে বিজেপিও কিন্তু ভারতের একটা গুরুত্বপূর্ণ দল হতে শুরু করে।
আর এ-সবের মধ্যে ১৯৭৭-এ দিল্লিতে প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার গঠিত হল। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জনতা সরকার গঠিত হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৭ সালেই হোক বা পরবর্তীকালে দেবেগৌড়া-গুজরালের সরকারই হোক কখনওই কিন্তু সেই সরকার স্থায়ী সরকার হিসেবে মাথাচাড়া দিতে পারেনি। বিজেপি প্রথম দল যারা মোরারজি দেশাই, চরণ সিং, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং, চন্দ্রশেখর, দেবেগৌড়া এবং গুজরালের মতো প্রধানমন্ত্রী দেয়নি। অটলবিহারী বাজপেয়ী ৬ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তখনও সেটা কোয়ালিশন সরকার ছিল।
পরবর্তীকালে এই বিজেপিই কিন্তু টানা দশ বছর স্থায়ী সরকার দিল। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্রুট মেজরিটি নিয়ে তাঁরা রাজত্ব করছেন। সেই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ক্ষয়িষ্ণু। বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসের কেবল যে আসন কমছে তা নয়, শুধু শতকরা ভোট কমছে তা-ও নয়, রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেস কার্যত মুছে যাচ্ছে। সংগঠন সাইনবোর্ড থেকে দেশলাই বাক্স হওয়ার পথে।
পশ্চিমবঙ্গের কথাই যদি ধরা যায় তা হলে দেখা যাবে এবারে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস বামপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটযুদ্ধে নেমেছিল। ফল কী হল? কংগ্রেস এবং বাম— দু’পক্ষই শূন্য হয়ে গেছে। আর পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসের সৌজন্যে বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরটা কিন্তু বিজেপি নিয়ে নিয়েছে।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের এইরকম একটা অবস্থা কি কাম্য? কংগ্রেসের বোধহয় বোঝা প্রয়োজন যে পুরনো সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দল গঠিত হয়েছে, রাজ্যভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেছে; তাদেরকে মর্যাদা দিতে হবে।
এটা ঠিক যে বেশকিছু রাজ্যে কংগ্রেস বনাম বিজেপি একটা লড়াই আছে। আঞ্চলিক দলগুলো এখনও সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু দুদিন আগেও যেখানে আঞ্চলিক দলগুলো ছিল না সেখানে আঞ্চলিক দলের সংগঠন তৈরি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে গোয়াতে তৃণমূল কংগ্রেস এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে? কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে ত্রিপুরায় বিজেপির শাসন এইরকম ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে?
সুতরাং কংগ্রেসকেও তার নেতৃত্ব সুগঠিত করতে হবে। ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় রোধ করতে হবে। কিন্তু কংগ্রেস যখন গণতন্ত্রের কথা বলে তখন কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের ভেবে দেখতে হবে, তাদের সংগঠনের ক্ষেত্রেও কতটা গণতন্ত্র কার্যকর হচ্ছে। যে বিক্ষুব্ধ নেতারা চিঠি দিয়েছিল, যারা জি-২৩ বলে পরিচিত সেই বিক্ষুব্ধ নেতাদের এখনও ডেকে কথা বলা তো দূর অস্ত্, তাদের সঙ্গে এখনও পর্যন্ত কোনও আপসমীমাংসা কংগ্রেস হাইকম্যান্ড করে উঠতে পারেননি। এই পরিস্থিতিতে ভারতের মতো এত জটিল আর এত বড় দেশ চালানোর জন্য যে রাজনৈতিক দর্শন, প্রজ্ঞা ও মানসিকতা প্রয়োজন সেটা কিন্তু রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে দেখা যাচ্ছে না।
সুতরাং এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদির মোকাবিলা করার জন্য অন্যকে দোষ না দিয়ে কংগ্রেসের আগে নিজেদের ঘর নিজেদের সামলানো উচিত। আর সমস্ত বিরোধী দলের উচিত নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে একই মঞ্চে এসে দাঁড়ানো। কে প্রধানমন্ত্রী হবেন আর কে হবেন না, সেটা আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। আজকের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে যে, বিজেপিকে প্রধান শত্রু চিহ্নিত করে সমস্ত বিরোধী দলকে একটা ছাতার তলায় এসে দাঁড়াতে হবে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনের সময়। এটাই সময়ের দাবি।