“The tempter or the tempted, who sins most?”
উত্তেজনার প্ররোচনা যিনি জুগিয়েছেন না কি যিনি সেই প্ররোচনার শিকার হয়ে উত্তেজিত হয়েছেন, কে বেশি দোষী?
‘মেজার ফর মেজার’ নাটকে অ্যাঞ্জেলোর সংলাপের সূত্রে প্রশ্নটা তুলেছিলেন শেক্সপিয়র। আর সেই প্রশ্নটাই এক অবাক জিজ্ঞাসা হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতের আকাশে-বাতাসে।
বর্তমান ভারতের ছবিটা কিঞ্চিৎ অন্যরকম। উসকানিদাতা যেই-ই হোক না কেন, প্ররোচনার শিকার বা উত্তেজিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠীর ওপর দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে দেওয়াটা এখন এদেশে দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘মেজার ফর মেজার’-এ উত্থিত প্রশ্ন এদেশে একমুখী উত্তর খুঁজে নিচ্ছে। ক্ষমতাসীনের অপছন্দ যা কিছু তাই-ই এদেশে অন্যায় বলে অভিহিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন-আসছে ‘বেঙ্গল বীমা কোম্পানি’
এসবের মধ্যেই চলে এসেছে বুলডোজার। ন্যায়ের নয়া হাতিয়ার।
প্রভাবশালী দলের জাতীয় মুখপাত্র নবিসম্পর্কে অবমাননাকর কোনও মন্তব্য করে পার পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সেই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ফুঁসে উঠলেই, প্রতিবাদের আওয়াজ তুললেই, বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে বাড়ি ঘর। উসকানিদাতার সাতখুন মাফ। উত্তেজিতেরই যাবতীয় দোষ, এমন ধারণাই গেঁথে দেওয়া হচ্ছে আকাশে-বাতাসে।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোড আইনভঙ্গকারীর শাস্তিবিধানের যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সে সব উসকানিদাতা বা প্ররোচকের ওপর প্রয়োগ না করাটাই এখন বিধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, তাই-ই, ‘গোলি মারো’ হুঙ্কার দিলে হুঙ্কারদাতাকে গ্রেফতার করা হয় না। গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারী মাল্যভূষিত হয়ে অভিনন্দিত হন। এমনকী গণহত্যার হুমকি, একটি বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে সমূলে বিনাশ করার জিগির তোলাটাও স্বাভাবিক বা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। অথচ এর চেয়ে অনেক কম অপরাধের দায়ে অনেককেই জাতীয় নিরাপত্তা আইন কিংবা ইউএপিএ-তে আটক হয়ে জেলে পচতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন-অটিজম ভয় নয়, সচেতন হোন
তা বলে সংবিধানে সশস্ত্র প্রতিবাদ বৈধ, এমনটা কোথাও বলা নেই। সহিংস প্রতিবাদ আইনসম্মত, এমন কথা কোথাও বলা নেই। সহিংস আন্দোলন আইনসম্মত, এমন কোনও ইঙ্গিত নেই।
আবার আমরা এটাও জানি, হিংসা হিংসারই জন্ম দেয়, সেই পাঠেও কোনও খামতি নেই।
তাও, অবাক হয়ে দেখছি, রাষ্ট্র সহিংস আন্দোলনকারীদের দমন করতে হিংস্রতর হয়ে উঠেছে, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে আন্দোলনকারীদের বাড়িঘর। আইনের লম্বা হাত প্রতিবাদীদের খুঁজে খুঁজে সবক শেখাচ্ছে। সবক শেখাতে গিয়ে আরও নির্মম, আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে।
বিস্ময় ফুরাতেই চায় না, যখন জানি, ১৯৮৪তে ইন্দিরা হত্যার হিংস্রতার প্রতিক্রিয়ায় শিখ হত্যার যে হিংস্রতা জেগে উঠেছিল তা ‘গণহত্যা’ বলে ধিক্কৃত হয়েছিল। আর এখন, হিংসাত্মক আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় বুলডোজার সংস্কৃতি ‘উচিত শিক্ষাদান’ হিসেবে বন্দিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন-নৃতত্ত্বের নারী পথিকৃৎ
বিস্ময় লুটোপুটি খেতে খেতে রাগ হয়ে দাঁড়ায় যখন মনে পড়ে যায় ইউপি আবাস এবং বিকাশ পরিষদ বনাম ফ্রেন্ডস কোঅপারেটিভ হাউসিং সোসাইটি লিমিটেড (১৯৯৬) মামলায় শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল, বাসস্থান থাকার অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সংবিধানের ১৯(১) (ই) ও ২১ নং ধারা এই বাসস্থানের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে মান্যতা দেয়, চামেলি সিং বনাম উত্তরপ্রদেশ রাজ্য (১৯৯৬)-তেও রায়দান কালে শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল বাসস্থানের অধিকার কার্যত নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
সেই বাসস্থান যখন বুলডোজারের গুঁতোয় ভেঙে চুরমার তখন টের পাই, মৌলিক অধিকার আক্রান্ত।
তখনই খুব জানতে ইচ্ছে করে উত্তরপ্রদেশের মানবাধিকার কমিশন কি গান্ধীজির তিন বানরের মতো হয়ে গেল?
তারা কি কোনওকিছু খারাপ দেখে না, শোনে না, আর ভাল কিছু করে না?
আরও পড়ুন-হারানো দিনের স্মরণীয় নায়িকা, বিবি পটেশ্বরীতেই বাজিমাত সুমিত্রা দেবীর
পরিশেষে তাই বুকের কোণে মুচড় ওঠে ‘মেজার ফর মেজার’-এ ওঠা প্রশ্নটার উত্তর।
কে বেশি দোষী, প্ররোচনাদাতা না কি প্ররোচিত হয়ে ভুল কাজ করেছে যে লোকটা সে?
প্ররোচনাদাতার উদ্দেশ্য সফল।
প্ররোচিত ব্যক্তির অনুতাপ করে আইনের শাসন অস্বীকার করা ছাড়া বোধ হয় আর কোনও উপায় নেই।
শ্রোতা যদি বধির হয়, তবে কেঁদে লাভ কী?