কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে একুইল ও এনইউজিএস-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘দ্য ডিসকোর্স ২০২২’ (The Discourse 2022)- আলোচনা সভায় আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নানা দিক নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিশিষ্ট সিনিয়র অ্যাডভোকেট এবং পার্লামেন্টের সদস্য কপিল সিব্বল বলেন, সারা বিশ্বেই নতুন ধরনের আইন নিয়ে কথা হচ্ছে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় নতুন আইন চালু হয়েছে। ২০১০ সালের ক্যালিফোর্নিয়া ট্রান্সপারেন্সি ইন সাপ্লাই চেইন অ্যাক্ট (সিটিএসসিএ), ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের মডার্ন স্লেভারি অ্যাক্ট এবং ২০১৮ সালের অস্ট্রেলিয়ার মডার্ন স্লেভারি অ্যাক্ট অনুযায়ী কোম্পানিগুলিকে তাদের পুরো উৎপাদন ব্যবস্থায় আধুনিক দাসত্ব, শিশুশ্রম, মানব পাচার মোকাবিলার জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা প্রকাশ করতে হবে।আমাদের দেশ ভারতেরও এই কার্যক্রমের ওপর জোর দেওয়া উচিত। ২০১৩ সালে সেকশন ১৩৫ অব দ্য ইন্ডিয়ান কোম্পানিজ অ্যাক্টে বলা হয়, ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই তাদের কর–পূর্ববর্তী মুনাফার ২ শতাংশ সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যয় করতে হবে।
তিনি বলেন , আধুনিক গণতান্ত্রিক জনকল্যাণকর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারকে মানুষের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য করা হয়। তাই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে এর বিপরীত। জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রকে আর্থনীতিক ক্ষেত্রেও গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়। রাষ্ট্রকে একাধারে উৎপাদকের স্বার্থরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক, ভোক্তা প্রভৃতি অন্যান্যদের স্বার্থরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়।
রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটক বলেন, ব্যবসায় সামাজিক দায়বদ্ধতা ধারণাটি নতুন নয়। বহু বছর আগে থেকেই এই ধারণা এসেছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর মানুষের অধিকার ও পরিবেশের বিষয়টিতে সচেতন থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: জঙ্গলমহলের মাটিতে দাঁড়িয়ে কলকাতার পুজোর ‘জঙ্গলকন্যা’ থিম উদ্বোধন
২০ বছর আগে সামাজিক দায়বদ্ধতা কথাটি এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হত, যেন এটি একধরনের স্বনিয়ন্ত্রক প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে কর্পোরেশনগুলো স্বেচ্ছায় এমনভাবে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করবে, যেখানে সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ, নৈতিকতা ও পরিবেশের যত্নের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। কিন্তু সম্প্রতি এই বিষয়ে দেখা যাচ্ছে, আইন ব্যবস্থার কোনও চাপ না থাকলে কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র তখনই বেশি সামাজিক দায়বদ্ধতা দেখায়।এরই পাশাপাশি তিনি বলেন, কলকাতা হাই কোর্ট অনেক বেশি রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন মামলার শুনানি করছে এবং শুনছে। কিন্তু পাবলিক ইন্টারেস্টের ক্ষেত্রে এ ধরনের অনেক মামলা আছে যেগুলির ক্ষেত্রে তাদের সেভাবে কোনও আগ্রহ নেই। আসলে সময় এসেছে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করার।
রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, কতকগুলি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও পরিচালনা অপরিহার্য বিবেচিত হয়। জাতীয় মুদ্রা ও ঋণ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্বও অপরিহার্যভাবে রাষ্ট্রের উপরই এসে পড়ে। দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি পালন করছি আমরা। কিন্তু সত্যিই কি সেই চিত্র দেখতে পাচ্ছি বরং তার উল্টোটাই হল বাস্তব চিত্র।আসলে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য হল প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর মধ্যেই জনগণের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ভোগের ব্যবস্থা করা। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি , এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমরা কিন্তু তার বিপরীত ছবি প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। (The Discourse 2022) বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মৌলিক ও প্রাথমিক কর্তব্য।অথচ যে হারে বিভিন্ন পণ্যের ওপর জিএসটি বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার তা মেটেই স্বাস্থ্যকর নয়। বি আর আম্বেদকর সংবিধান তৈরির ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিটি অংশের প্রতিটি মানুষের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
West Bengal National University of Juridical Sciences এর ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. নির্মলকান্তি চক্রবর্তী বলেন, যখন আপনি কোনও পণ্য কেনেন, আমার ধারণা আপনি আশা করেন, মানবাধিকার আইন মেনেই পণ্যটি তৈরি হয়েছে। আপনি আশা করেন, উৎপাদনে কোনও অন্যায্য মজুরি দেওয়া হয়নি, মানব পাচার, বা জোর করে শিশুশ্রম আদায়ের মতো কোনও ঘটনা ঘটেনি। হয়নি কোনও বৈষম্য–নিপীড়ন বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত। সম্ভবত আপনি আরও আশা করেন, পণ্য তৈরিতে উৎপাদনকারী সংস্থা পরিবেশগত ক্ষতি এড়াতে সচেতন ছিল।কিন্তু বাস্তব চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত।
রাজ্যের কর ব্যবস্থার মজবুতিকরণ এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের করের ক্ষেত্রে রাজ্যের পাওনা গন্ডা নিয়ে ব্যাখ্যা করেন রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী (Harikrisna Dwibedi)। রাজ্যের কর কাঠামো ও জিএসটি (GST) সংক্রান্ত বিষয়টিও তার বক্তব্যে উঠে আসে।
বিশিষ্ট আইনজীবী সঞ্জয় বসু (Sanjay Basu) বলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়টি আসলে ভারতীয় গণতন্ত্রের সব থেকে বড় জিনিস। বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে হোক বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হোক বা অন্যান্য ক্ষেত্রেই হোক, তাকে আরও বেশি করে রক্ষা করা দরকার। এতে একদিকে যেমন নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ওর একই সঙ্গে প্রত্যেকটি মানুষের বিভিন্ন চাওয়া-পাওয়া আরও বেশি শক্তিশালী হয়।
সিআইআই ভাইস চেয়ারম্যান সুচরিতা বসু (Sucharita Basu) বলেন, দেশের প্রত্যেকটা রাজ্য যদি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারে তাদের ক্ষেত্রে শুধু চাপিয়েই দেওয়া হয় তাহলে রাজ্যগুলি এগোতে পারবে না। আখেরে ক্ষতি হবে দেশের।
সবমিলিয়ে এদিনের আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, এই মুহূর্তে দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে যা ঘটছে তা হওয়া উচিত নয়। রাজ্যগুলিকে আরও অনেক বেশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া উচিত। (The Discourse 2022)