যাকাত-দানে গরিবের ইদ হয়ে ওঠে খুশির

সংযমের মাস রমজান। কঠিন সংযম। পৃথিবীজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলিম সম্প্রদায় নিষ্ঠা ভরে তা পালন করেন। তারপর মেতে ওঠেন খুশির ইদে৷ ধর্মে ধনী-দরিদ্র বিভেদ নেই, আল্লাহ-র চোখে সবাই সমান। কিন্তু ধর্ম আশ্রয় করে বাঁচা মানুষ এই বিভেদের খাঁচায় বন্দি। তাই খুশির ইদ মালিন্য-মাখা হয় অনেক গরিব পরিবারেই। তাদের কথা ভেবেই ‘যাকাত’। যা খুশি বয়ে আনে ইদ উদযাপনে। ধন–সম্পদ পবিত্র করেন যাকাতপ্রদানকারী৷ হাসি ফোটে আল্লাহর বান্দাদের মুখেই। বিস্তারিত লিখেছেন নাজির হোসেন লস্কর

Must read

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী এই গান সবার হৃদয়ে রয়েছে গাঁথা৷ রমজান ক্ষমা, ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সংযমের মাস শেষে পূর্ণতা পায় খুশির ইদে। আর এই ইদে গরিব মুসলিম পরিবারেও খুশির ঢেউ ওঠে৷ খুশি ভিতরের বিষয়। কিন্তু তার সঙ্গে যে পার্থিব জিনিসের যোগ রয়েছে তা অস্বীকারের উপায় নেই। খালি পেটে আনন্দ করা যায় না। আর সেখানেই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ‘যাকাত’। যে কথা উল্লেখ রয়েছে ওই গানের মাঝে ‘‘…তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ/ দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ…’৷

আরও পড়ুন-মোদি জমানায় নিহতের নাম গণতন্ত্র

সমাজের অবহেলিত–বঞ্চিত মানুষের জন্য সাহায্য, দান–খয়রাত, ফিতরা–যাকাত ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দয়া–দাক্ষিণ্য নয়, এই পাওনা বঞ্চিতদের অধিকার। ঠিক যেমন নির্দিষ্ট আয়ের মাত্রা উত্তীর্ণ হলে সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়, ইসলামেও তেমনই বিধান রয়েছে৷ বিশ্বের সব ধর্মই দানের কথা বললেও বাধ্যতামূলক দানের কথা একমাত্র ইসলামই বলেছে। মনে প্রাণে ইসলাম মেনে চলা একজন সম্পন্ন মুসলিম যাকাত দিতে বাধ্য। তা কুরআনের নির্দেশ। আল্লাহ্পাক কুরআন–এ বলেছেন, ‘তাদের সম্পদে বঞ্চিতদের নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে’৷ যাকাত আদায় ধনীদের জন্য ফরজ বা আবশ্যিক। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের শেষ হল যাকাত৷ আরবি শব্দ ‘যাকাত’-এর আভিধানিক অর্থ ‘যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশি হয়’৷ অর্থাৎ, যাকাত হচ্ছে ‘বরকত’।

আরও পড়ুন-মোদি জমানায় নিহতের নাম গণতন্ত্র

যাকাত সারাবছর আদায় করার সুযোগ থাকলেও রমযানে আল্লাহর নিকট বাড়তি পুণ্যের সুযোগ থাকায় এইমাসে অধিকাংশ যাকাত আদায় করে থাকেন। প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ সা. বলেছেন, ‘যে-ব্যক্তি এ-মাসে একটি ফরজ ইবাদত আদায় করবে সে অন্য সময়ের ৭০টি ফরজ আমলের সওয়াব পাবে।’ যাকাতের মাধ্যমে সমাজ বিনির্মাণ হয়। সম্পদ আবর্তিত হয়। ইসলামি সমাজ ব্যবস্থায় দারিদ্র দূরীকরণের মাধ্যম হিসেবে সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখতে ধনীদের ওপর যাকাত যেভাবে ফরজ করা হয়েছে, অন্য কোনও ধর্মে এ ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নজির নেই। তবে যাকাত খেয়াল খুশিমতো দেওয়া যায় না। তা সাধারণ দান কিংবা সদকার মতো নয়। তা সম্পদশালী মানুষের কাছে আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ।

আরও পড়ুন-চাকরি কই? আশঙ্কায় আইআইটি বম্বের পডু়য়ারা

যেমন চুল বড় হলে আমরা ছেঁটে ফেলি, নখ বড় হলে কেটে ফেলি, তেমনই সম্পদ বেশি হয়ে গেলেও তা ওই ভাবে ট্রিম করে নিতে হয়। তার জন্য আলাদা করে কেউ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন না। যাকাত কারও ওপর আবশ্যিক হলে তিনি যাকাত দেবেন কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা ভেবে। লোকে তার কতখানি সুনাম করল তা এখানে বিবেচ্য নয়। মনে রাখতে হবে যাকাত এবং দান সমার্থক নয়। যাকাত যেমন আল্লাহর নির্দেশমতো আবশ্যিক। দান কিন্তু বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ। তা মৌলিক নয়, নীতিমূলক। একজন কম দান করবেন নাকি বেশি দান করবেন, নাকি একেবারেই করবেন না তা তাঁর ব্যাপার। সেখানে তিনি ক্যাজুয়াল হতেও পারেন। কিন্তু যাকাতে সে অবকাশ নেই। তাই যাকাত সমাজের আর্থিক কাঠামো বদলে দিতে পারে।
সাধারণ দানের ভরসায় সমাজে এমন বদল আসা কঠিন। তেমন দান তো সকলেই করেন। ‘দিলাম যা রাজ ভিখারিরে স্বর্ণ হয়ে এলো ফিরে আমি তখন চোখের জলে দুটি নয়ন ভরি, তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করি।’ কৃপণ কবিতাতে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। এমন দানের প্রতিদান পরম করুণাময় এরকমই দেন। কিন্তু যাকাত তেমন সাধারণ দান নয়। যাকাত হল আর্থিকভাবে সম্পন্ন বক্তিদের কাছে নির্দেশিকা। তাকে তা দিতেই হবে। সম্পন্ন মানুষ হলে সঞ্চিত অর্থের ২.৫ শতাংশ হারে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।
ইসলামের শুরু থেকেই নিত্য ব্যবহার্য জিনিস (বাড়ি, গাড়ি, পশু, বাসন-কোসন, নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ) বাদে যদি কারও কাছে সাড়ে সাত ভরি ওজনের সোনা, সাড়ে ৫২ ভরি রুপো অথবা এই পরিমাণ নগদ অর্থ এক বছর থাকে, তাহলে বছর শেষে তাকে ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হয়। সোনা–রুপো মিলে যদি ওই পরিমাণ হয়, তাহলেও দিতে হবে। এছাড়াও এক বছরের বেশি সময় ধরে সঞ্চিত স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ ছাড়াও বিভিন্ন দলিল, শেয়ার সার্টিফিকেট, প্রাইজবন্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র যার আর্থিক মূল্য আছে ইত্যাদির মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ, অর্থাৎ যাকাত প্রদানের উপযুক্ত পরিমাণ হয় এবং পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হয় তাহলে ইসলামিক আইন অনুযায়ী যাকাত দেওয়া বাধ্যতামূলক।

আরও পড়ুন-আবার ভারতীয় পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যু, মার্কিন মুলুকে, প্রশ্নের মুখে নিরাপত্তা

ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী যাকাতের অর্থ আটটি খাত পর্যালোচনা করলে এই সর্বজনীন অর্থনৈতিক নিরাপত্তার দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন— ফকিরদের সাহায্য ও জীবিকার ব্যবস্থা, মিসকিনদের সাহায্য ও জীবিকার বন্দোবস্ত, দাসমুক্ত করা, ঋণগ্রস্তের পক্ষ থেকে ঋণ আদায়, ইসলাম গ্রহণের প্রতি আশা করা যায় বা ইসলামের প্রতি যাদের দুর্বলতা আছে তাদের সাহায্য, মুসাফিরদের কল্যাণ এবং আল্লাহর পথে ব্যয় নির্বাহের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যয় করা যায়। কোরআনে বর্ণিত এই আটটি খাতকে সম্প্রসারিত করে যাকাতের অর্থ আরও ব্যাপকায়তনে অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণে কাজে লাগানো যায়।
বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যাকাতের অর্থ সরাসরি হাতে না দিয়ে তা সংগঠিত করে প্রাপকদের স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে৷ যাঁরা এই যাকাত ও দানের অর্থ একজায়গায় করে দুস্থ ও মেধাবীদের উচ্চশিক্ষিত করে তোলার কাজে হাত লাগিয়েছেন তা আখেরে সামাজিক উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি হচ্ছে৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সম্প্রতি চেন্নাই-ভিত্তিক এক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক ছাত্র গভীর সমস্যায় পড়েছিলেন৷ সামনে ছিল তাঁর পরীক্ষা৷ কিন্তু কলেজ তাঁকে বকেয়া প্রায় ৪৫,০০০ টাকা পরিশোধ করতে বলেছিল। পরীক্ষা ভুলে তখন মেধাবী ওই ছাত্র টাকা সংগ্রহে আত্মীয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন৷ এমন সময় এক পরিচিত দেশের এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ মুসলিম প্রফেশনালস (এএমপি)-এর সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলেছিলেন। তারপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নির্দিষ্ট কারণ উত্থাপন করে ফর্ম পূরণ করার পরামর্শ দেয়৷ এই স্বেচ্ছাসেবীর মাধ্যমে যাকাত-ভিত্তিক ক্রাউডফান্ডিং প্ল্যাটফর্ম, IndiaZakat.com-এ প্রয়োজনীয়তার বিশদ বিবরণ দেয়। কিছুদিন পরে দেখা যায়, ওই ছাত্রের প্রয়োজনীয় অর্থ কলেজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ জানা যায়, এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে শেষ চার বছরে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষকে অর্থসাহায্যের মাধ্যমে ১৮ কোটি টাকা খরচ করেছে৷ যা তারা সংগ্রহ করেছিল যাকাত বা দানের মধ্য দিয়ে৷ আমাদের বাংলাতেও এমন কিছু মানুষ যাকাতের টাকা এককাট্টা করে মুসলিম সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হাল ধরেছেন৷ রাজ্যের প্রোগ্রেসিভ যাকাত ফাউন্ডেশনের এই সদস্যরা একসময় নিজেদের অর্থনৈতিক কষ্টের দিন পার করেছেন৷ যাঁরা এখন সরকারি–বেসরকারি চাকুরে বা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী৷ বছর শেষে যাঁদের যাকাতের অর্থ শিক্ষাক্ষেত্রে যুবসমাজকে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এছাড়া বাংলায় মুসলিমদের দ্বারা বহু স্বশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলছে৷ যেখানে দুস্থ ও মেধাবী ছাত্র–ছাত্রীদের স্কলারশিপ দেওয়া হয়৷ আর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি চলে সেই যাকাত বা দানের অর্থে৷ আবার এইসব প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশুনো করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পুরনো দিনের কথা না ভুলে তাঁরা যাকাত বা দানের একটা অংশ প্রতিষ্ঠানকে তুলে দিচ্ছেন৷ এভাবে সমাজের একটা অংশ সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবায় যুক্ত হয়ে আরও উন্নত সমাজ গড়ার দায়িত্ব নিচ্ছেন তাঁরা। আবার এমন প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশুনো করে রাজ্য–দেশব্যাপী সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্র–সহ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হয়ে মুসলিম ছেলেমেয়েরা সামনে থেকে প্রতিনিধিত্ব করছেন৷ শুধুমাত্র মুসলিম নয়, ভিনধর্মের মেধাবী-গবির পড়ুয়ারাও যাকাত-শিক্ষাবৃত্তির সুযোগ পাচ্ছেন।

আরও পড়ুন-আবার ভারতীয় পড়ুয়ার রহস্যমৃত্যু, মার্কিন মুলুকে, প্রশ্নের মুখে নিরাপত্তা

সংগঠিত যাকাতের অর্থ ব্যবহারের পাশাপাশি এই রমজান মাসে গরিবের হাতে সরাসরি যাকাতের অংশ তুলে দেন সামর্থ্যবান ধনীরা। একেবারে গবির আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী, ভিক্ষুদের যাকাত বা দান প্রদান করেন। যেহেতু সারাবছর যাকাতের ব্যবহার আছে তাই বন্যা কবলিত বা দুর্যোগে সব হারিয়ে ফেলা নিঃস্বদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন অর্থবান মুসলিমরা বা যাকাতের অর্থ নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন৷ আর রমযান মাসে ইফতার সামগ্রী–সহ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে দেওয়ার পাশাপাশি ইদের মুখে গরিব–মিসকিনদের হাতে তুলে দেয় নতুন জামাকাপড়। বছর শেষে যাকাতপ্রদানকারীরা নিজেদের ধন-সম্পদ পবিত্র করে সমাজের অসহায়, ফকির, মিসকিন, দরিদ্রের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটায়। আবহমান কাল থেকে আল্লাহর এই নির্দেশ মেনে ধনী-গরিব খুশির সুবাস ভাগ করে নেয় ইদের ময়দানে।

Latest article