এটা জানুয়ারি, ২০২২, সেটা ছিল ডিসেম্বর, ১৯৫৪। সাতষট্টি বছর আগেকার কথা।
প্রধানমন্ত্রী তখন জওহরলাল নেহরু। যাঁর তাবৎ কীর্তিকে অগ্রাহ্য করতে সদাব্যস্ত বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। আর ডঃ মেঘনাদ সাহা তখন উত্তর-পশ্চিম কলকাতা থেকে নির্বাচিত সাংসদ। এবং অবশ্যই প্রথম সারির জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী বা অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট। শেক্সপিয়রের ওথেলোর তিনটে চরিত্রের উল্লেখ করে একটা চিঠি লিখলেন তিনি প্রধানমন্ত্রীকে। সে পত্রে বললেন, ‘এসব ইয়াগোর কথায় আপনি ডেসডেমোনাকে দমন করতে যাবেন না। আমার কখনও-কখনও মনে হয়, ইতিহাসে যুগে যুগে আপনার মতো ক্ষমতাবান সম্মানিত প্রত্যেক ব্যক্তির চারপাশে ইয়াগোর দল ভিড় করে থাকে।’
একথা বলে তিনি জওহরলালকে সতর্ক করে দিলেন। আসলে তখন নেহরুর চারপাশে মেফিয়াভেলির মতো মন্ত্রণাদাতারা ভনভন করছেন আর তাঁদের দৌরাত্ম্যে বিজ্ঞানের উঠোনে রাষ্ট্রের দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ বাড়ছে। রাষ্ট্র-রাজনীতি নাক গলাচ্ছে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীর কাজে, এতেই বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন ডঃ সাহা। আর তাই, ওথেলোর চরিত্রদের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রীকে পত্রবোমা।
সে একটা সময় ছিল তখন।
সে সময় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তর্জনি তুললেও রাষ্ট্রপ্রধানের পিঠ চাপড়ানি, প্রশংসা জুটত।
সেসব অতীত এখন।
সেসবের বিপ্রতীপে এখন অন্য উদ্ভাস। কালের কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ বৈজ্ঞানিক মডেলও এখন অসহিষ্ণুতা আর কুসংস্কারের সামনে খাবি খায়। অনুসন্ধিৎসার স্বাধীনতা এখন সেসবের মুখে পড়ে খতমত খেয়ে থমকে দাঁড়ায়। জ্ঞানসৃষ্টির আদি শর্ত হল চিন্তার স্বাধীনতা, ভাবপ্রকাশের অবাধ বিস্তার। প্রতিস্পর্ধী হওয়ার অবকাশ না পেলে, সংক্ষোভ প্রকাশের পরিসর না পেলে, প্রশ্ন করার সুযোগ না জুটলে গণতন্ত্র বাঁচে না, বিজ্ঞানমনস্কতাও না।
অথচ এখন, দিশাহারা ওলট-পালট ঢেউয়ে ধুয়ে যাচ্ছে আমাদের বিজ্ঞান চেতনার গার্হস্থ্য-সন্ন্যাস। রাজনৈতিক অন্ধত্বের জোয়ারে জোয়ারে বারবার দিক ভুলছে ভারতের বিজ্ঞানচেতনা, ভারতীয় বিজ্ঞানীর ভাষা। ডঃ মেঘনাদ সাহার মতো হিম্মৎ হ্রেষা প্রকাশ করার মতো তেজীয়ান অশ্বের বড়ই অভাব এখন। বিজ্ঞানীদের মহল এখন বিরাট বিপন্নতার মুখোমুখি।
২০১৫তে ১০২তম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের কথা মনে আছে? প্রাচীন ভারত গৈরিক জাতীয়তাবাদের রঙে রাঙিয়ে বাজারজাত করতে গিয়ে কেমন সব হাস্যকর দাবি করা হয়েছিল সে সময়, মনে পড়ে? দাবি করা হয়েছিল, বেদ-পুরাণের যুগে বিমানগুলো এখনকার বিমানের চেয়ে উন্নততর ছিল। শ্রীলঙ্কায় নাকি তখন একাধিক বিমানবন্দর ছিল। তাতে সারাদিন রাবণ রাজার ২৪টা বিমান ওঠানামা করত। একজন আবার বলে বসলেন, আইজ্যাক নিউটন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, সব বেবাক ভুলভাল বলে গিয়েছেন। মহাকর্ষীয় বল নাকি শিগগির ‘নরেন্দ্র মোদি তরঙ্গ’ নামে পরিচয়গৌরব লাভ করবে।
সায়েন্স কংগ্রেসকে কমেডির আসর বানানোর সেই শুরু। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডারউইনের বিবর্তনবাদকে অবৈজ্ঞানিক বলে দেগে দিলেন। আরএসএস প্রধান জানিয়ে দিলেন ৪০ হাজার বছর ধরে নাকি ভারতীয়দের ডিএনএ একই আছে, এতটুকু বদলায়নি। এরই পথ ধরে, এই ২০২২-এ আমরা পেলাম খড়গপুর আইআইটি-র ক্যালেন্ডার। ইতিহাস পুনর্লিখনের প্রবল বাসনায় সেখানে তুলে ধরা হল এক আজগুবি তত্ত্ব— বৈদিক সংস্কৃতির ভিত্তিতেই নাকি গড়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতা। হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতায় প্রাপ্ত পোড়ামাটির সিলমোহরে একশৃঙ্গী ষাঁড়ের মূর্তিটাকে বিকৃত করে ঘোড়া বলে চালানোর চেষ্টা হল সেখানে।
আরও পড়ুন-দাপুটে অভিনেত্রী মঞ্জু দে
নবযুগের গুরুরা সমকামিতাকে রোগ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সে রোগ সারাতে গরুর দুধ-গোবর-মূত্র থেকে তৈরি নানা ওষুধ প্রয়োগের পক্ষে সওয়াল করছেন। বলছেন, ওই ওষুধেই সেরে যাবে কোভিডও। তাঁদের অপরীক্ষিত অবৈজ্ঞানিক দাবি অবিরত সমর্থিত হচ্ছে গেরুয়া শিবিরের রাজনীতিকদের দ্বারা। আর মৌনব্রত নিয়েছেন এদেশের বিজ্ঞানীরা। তাঁদের নিস্তব্ধতা ক্রমশ হয়ে উঠছে এক ছদ্মবিজ্ঞানের কোলাহল, জলরঙে ছেয়ে থাকছে বিজ্ঞানের যুক্তি, সত্যের আবেগ।
এসব মনে পড়িয়ে দিচ্ছে ১৯৩০-৪০-এর দশকে অ্যাডলফ হিটলার আর বেনিতো মুসোলিনির কথা। অশ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা বিশ্রীরকম বাড়ছে। ওরা অশুদ্ধ। শুদ্ধ রক্তের শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা কমছে। সেটা বিপজ্জনক। এমন অবৈজ্ঞানিক মত গেলানোর আয়োজন হয়েছিল তখন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাসিমো ম্যাজোত্তি একজন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ। বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে নাৎসি আর ফ্যাসিবাদ ভয় দেখিয়ে, হেনস্তা করে, চোখ রাঙিয়ে বিজ্ঞানের সত্য আর বিজ্ঞানীদের কণ্ঠ চেপে রাখার ব্যবস্থা করেছিল।
সেদিনও ইতালির বিজ্ঞানী মহল নিজেদের ব্যক্তিগত আসরে রাষ্ট্রনায়কদের অবৈজ্ঞানিক হাস্যকর মতামত ও মন্তব্য নিয়ে মশকরা করতেন, কিন্তু জনসমক্ষে মুখে কুলুপ এঁটে রাখতেন। সেদিনও ইহুদি বিজ্ঞানীরা জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, দলে দলে, কিন্তু চুপি চুপি। আজও এদেশে বিজ্ঞান সাধকদের অকাম্য নিস্তব্ধতা নীরবতার পেছনে অন্তত তিনটে কারণ সহজেই বোঝা যায়।
এক, সরকারি মতের বিরুদ্ধে গেলে গবেষণার জন্য সরকারি অনুদান মিলবে না। পুরোদস্তুর সরকারে অর্থেই তো পোষিত হয় গবেষণাগারগুলো। সুতরাং, চুপ করে থাকো ভাই, চুপ করে থাকো।
দুই, আজকের বিজ্ঞান গবেষকরা সমাজজীবনের মূল ধারায় সম্পৃক্ত নন। তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন। ফলে, তাঁদের নীরবতায় সমাজজীবন কতটা ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে তাঁদের ভাবতে ভারি বয়েই গিয়েছে। তার মেঘনাদ সাহা হওয়ার সাহস ও তাগিদ কোনওটাই অনুভব করেন না।
তিন, স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে গণতন্ত্রের জায়মান দশায় এদেশে বিজ্ঞান চর্চার মহলে যে বৌদ্ধিক স্বাধীনতার জোরদার জায়গাটা ছিল, যা ডঃ মেঘনাদ সাহার মতো বিজ্ঞান তপস্বীদের নির্ভীকতা ও অকুণ্ঠ সত্যনিষ্ঠায় পুষ্টি জুগিয়েছিল, তা এখন উধাও।
আলো ক্রমে নিভিতেছে।
নীরবতায় কখনও-কখনও আঁধার ঘনায়।
সেটাই ভয়। সেটাতেই ভয়।