দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন। কবিতার পাশাপাশি তিন কবিই রচনা করেছেন নানা স্বাদের গান। তাঁদের গানে ফুটে উঠেছে প্রেম, প্রকৃতি, ভক্তি। দ্বিজেন্দ্রলালের মজার ও নাটকের গান তো অতুলনীয়। কিছুদিন আগেই পেরিয়ে এসেছি দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তের জন্মদিন। অতুলপ্রসাদের জন্মদিন সামনেই, অক্টোবরে। মাঝখানে কিছুটা ভাটা পড়লেও, বর্তমানে তিন কবির গানের প্রচার এবং প্রসার যথেষ্ট বেড়েছে। বিশেষত নতুনদের মধ্যে।
আরও পড়ুন-চা নিয়ে চর্চা: পেশার জায়গা দিচ্ছে টি ম্যানেজমেন্ট কোর্স
তিন কবির স্মরণে ১৯-২০ জুলাই রবীন্দ্র সদনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান। কয়েকজন বিশিষ্ট নবীন ও প্রবীণ শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন। প্রেক্ষাগৃহে দর্শক-শ্রোতাদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো।
২৮ জুলাই তিন কবির গান শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে বিড়লা আকাদেমিতে। সেখানেও দেখা গেছে নতুনদের প্রাধান্য, বহু মানুষের উপস্থিতি। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন সংগীতশিল্পী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়। গত দু দশকের বেশি সময় ধরে তিনি তিন কবির গান শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন। কথা হল তাঁর সঙ্গে। তিনি জানালেন, রবীন্দ্র-নজরুলের গানের পাশাপাশি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেনের গান এখন যথেষ্ট পরিমাণে গাওয়া হচ্ছে। মঞ্জু গুপ্ত, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, সুশীল চট্টোপাধ্যায় চলে যাওয়ার পরে একটা বিরাট শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল মূলত দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গানের ক্ষেত্রে। গাওয়া হত কম। এসেছিল ভাটা। কারণ, এঁদের গান সেই সময়ের বহু শিল্পী ম্যানারেজিম দিয়ে পরিবেশন করতেন। যে-কারণে তিন কবির গান নতুন প্রজন্ম শুনছিলেন কম। প্রচার করা হয়েছিল, এটাই এই ধরনের গানের মূল গায়কী। যদিও সেটা ভুল। কেন? আমাদের আর্কাইভে তিন কবির স্বকণ্ঠে গাওয়া গান আছে। শুনলে বোঝা যায়, এঁরা নিজেরা কিন্তু ম্যানারেজিম দিয়ে গাইতেন না। তিন কবির কাছে যাঁরা গান শিখেছেন, তাঁদের পরিবেশনার মধ্যেও কিন্তু কোনও রকম ম্যানারিজম ছিল না। গাইতেন স্বাভাবিক কণ্ঠে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় গায়কদেরও তিন কবির গান গাইতে শুনেছি। তাঁদের গানেও কোনও ম্যানারেজিম ছিল না। কিছু শিল্পীর ম্যানারেজিম এই গানগুলোকে শ্রোতাদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন-সেরা লিস্টন-কিয়ান, মঞ্চে অমর একাদশের পরিবার
এখন ঠিক কী পরিস্থিতি? তিনি জানালেন, এখন কিন্তু আগের পরিস্থিতি নেই। বহু নতুন ছেলে-মেয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গান গাইছেন। তিন কবির গান নিয়ে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও বহু অনুষ্ঠান হচ্ছে। সারা পৃথিবীর অসংখ্য ছেলেমেয়ে এখন তিন কবির গান শিখছেন, শুনছেন, চর্চা করছেন। এসেছে নতুন জোয়ার। ২০-২২ বছর ধরে এই তিন কবির গান নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি এটা খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করেছি। ছোটবেলা থেকে এঁদের গান শুনে বড় হয়েছি। পরবর্তী সময়ে শিখেছি। শিখেছি রবীন্দ্রনাথের গানও। যখন আমার স্বামী ড. দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নাটকের গান গাইতে এলাম, তখন মনে হল দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের এত সুন্দর সুন্দর গান, অথচ সঠিক গায়কীর অভাবে মানুষের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না। তাই আমি এই তিন কবির গানকেই প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। উপস্থাপন করি নিজস্ব স্টাইলে। আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে। পরবর্তী সময়ে গেয়েছি পঞ্চকবির গান। এখন অনেকেই গাইছেন, তবে আমাকেই কিন্তু এই ক্ষেত্রে পথিকৃৎ মনে করা হয়। পঞ্চকবি হলেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুল। পাঁচজনই কিন্তু গীতিকবিতা রচয়িতা। বয়সের তারতম্য থাকলেও এই পাঁচ কবি কিন্তু মোটামুটি একই সময়ের প্রতিনিধি। এঁদের গানের মধ্যেই নিজেকে সঁপে দিয়েছি। আমার পড়াশোনার সঙ্গেও মিশিয়েছি এঁদের গানকেই। বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আমার নাম দিয়েছিলেন ‘পঞ্চকবির কন্যা’। এটা আমার মস্তবড় প্রাপ্তি। বঙ্গসম্মেলন, বঙ্গমেলা-সহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি পঞ্চকবির গান পরিবেশন করেছি। বক্তব্য পেশ করেছি তাঁদের গান নিয়ে। আমি চাই সব বয়সের শ্রোতাদের কাছে এই কবিদের গান পৌঁছে যাক। একটা গানের ধারাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে টার্গেট করতে হবে নতুন প্রজন্মকে। সেটাই করার চেষ্টা করে চলেছি। আমি আশাবাদী, নতুন প্রজন্ম তিন কবির গানকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন-৫ দিনের দিল্লি সফরে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী
তাঁর সংযোজন, রেডিও-টেলিভিশনের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকার চেষ্টা করছে তিন কবির গানকে আরও বেশি জনমুখী করতে। আয়োজিত হচ্ছে কর্মশালা, অনুষ্ঠান। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমির উদ্যোগেও তিন কবির গান নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হচ্ছে। সেখান থেকেও উঠে আসছেন বহু নতুন প্রতিভা। শহরের পাশাপাশি গ্রামগঞ্জ থেকে। জোরদার চর্চা হচ্ছে। এই চর্চা আরও বেশি হলে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পাশাপাশি তিন কবির গান আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। ফ্রেশ ভয়েজ তুলে আনতে হবে আমাদের। দিতে হবে উন্নত প্রশিক্ষণ। আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন সংস্কৃতি-সচেতন মানুষ। সংগীত শিল্পীদের জন্য তিনি অনেক কিছুই করেছেন। ওঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আশা করি তিনি তিন কবির গানকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিশেষ উদ্যোগী হবেন।