যে লেখিকা ম্যাজিক জানেন, জোয়্যান রোওলিং

জীবনযুদ্ধের চোরাবালি থেকে উঠে আসা ফিনিক্স পাখি তিনি। অধ্যাবসায় ও নিষ্ঠার ডানায় ভর করে জয় করেছেন কীর্তি ও প্রতিপত্তির শিখর— সেই জোয়্যান রোওলিং-এর হার না মানার গল্প বললেন সৌভিক চক্রবর্তী

Must read

ঘরে ফিরে প্রথমেই হাতে ধরা কাগজের বান্ডিলটা টেবিলের ওপর রাখলেন ‘ব্লুমসবেরি’ প্রকাশনার কর্ণধার নাইজেল নিউটন। নবাগতা এক লেখিকা ছোটদের জন্য ফ্যান্টাসি উপন্যাস লিখেছেন, তারই প্রথম কয়েকটা অধ্যায় তাঁর দপ্তরে জমা দিয়েছেন লিটারারি এজেন্ট ক্রিস্টোফার লিটল। সারাদিন কাজের চাপে একবার নজর বোলানোও হয়ে ওঠেনি লেখাটায়, তাই বাধ্য হয়েই সেটা বাড়ি নিয়ে এসেছেন নিউটন। এমনিতে প্রকাশক হিসেবে সোহো স্কোয়ার-এর ঘুপচি অফিসঘরে পাণ্ডুলিপির পাতা উলটেই বেলা কাটে তাঁর, কিন্তু এত রাতে বাড়ি ফিরে সেই একই কাজে বসতে একটুও ইচ্ছে করছে না। অথচ লিটল-কে তিনি কথা দিয়েছেন, একদিনের মধ্যেই পাণ্ডুলিপিটার বিষয়ে মতামত জানাবেন। এখন উপায়?

আরও পড়ুন-তিন কবির গান

আচমকাই নিউটন-এর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। বাড়িতে অ্যালিস থাকতে অযথা কেন চাপ নিচ্ছেন তিনি? অ্যালিস— তাঁর আট বছরের মেয়ে—গল্পের বইয়ের পোকা। তাকেই তো পড়তে দেওয়া যেতে পারে পাণ্ডুলিপিটা। শিশুপাঠ্য লেখার প্রথম পাঠপ্রতিক্রিয়া একজন খুদে পাঠিকা দিলে ব্যাপারটা মানানসইও হবে। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। মেয়েকে ডেকে কাগজের তাড়া ধরিয়ে দিয়ে নিউটন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
এক ঘণ্টাও কাটল না, দোতলার ঘর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে এল অ্যালিস। মুখচোখ আনন্দে ঝলমল করছে তার। স্যাম্পেল চ্যাপ্টার-গুলো দারুণ পছন্দ হয়েছে, কিন্তু এরপর কাহিনিতে কী হল না জানলে সে শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। তাই বাবার কাছে তাই মেয়ের আবদার, লেখার বাকিটুকু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে এনে দিতে হবে। নড়েচড়ে বসলেন নিউটন। নতুন লেখিকার কলমে নিশ্চয়ই এমন কিছু রয়েছে যা একজন আট বছরের মেয়েকে বাধ্য করেছে তাঁর কাহিনি গোগ্রাসে গিলতে। এমন সাহিত্যিকের ওপর বাজি ধরাই যায়। মনস্থির করলেন নিউটন, উপন্যাসটা ‘ব্লুমসবেরি’ থেকেই প্রকাশ করবেন। পরদিন অফিসে গিয়ে ‘চিল্ড্রেনস লিটারেচার’ বিভাগের প্রধান ব্যারি কানিংহ্যামকে নির্দেশ দিলেন, লেখিকার থেকে সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি চেয়ে নিতে ও তাঁকে ২৮০০ পাউন্ড অ্যাডভান্স রয়্যালটি-র চেক লিখে দিতে। কে সেই লেখিকা, জানতে ইচ্ছে করছে নিশ্চয়ই? তাঁর নাম জোয়্যান রোওলিং।

আরও পড়ুন-চা নিয়ে চর্চা: পেশার জায়গা দিচ্ছে টি ম্যানেজমেন্ট কোর্স

৩১ জুলাই ১৯৬৫, ব্রিটেন-এর গ্লসেস্টারশায়ার-এ রোওলিং-এর জন্ম হয়। তাঁর মা অ্যানি বই পড়তে খুব ভালবাসতেন। মেয়েকে প্রায়ই গল্প পড়ে শোনাতেন তিনি, বিশেষ করে রিচার্ড স্ক্যারি-র রূপকথার কাহিনি। স্ক্যারি-র কথা বলতে পারা পশু-চরিত্ররা রোওলিংকে এতটাই অনুপ্রাণিত করে যে মাত্র ছয় বছর বয়সে ‘র‍্যাবিট’ বলে একটা গল্প লিখে ফেলেন তিনি। শিশু রোওলিং-এর মনে গল্পের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ জেগে ওঠার পেছনে তাঁর মায়ের ভূমিকা ছিল অনেকখানি। সি এস লিউইস-এর ‘ক্রনিকলস অফ নার্নিয়া’ সিরিজ, এডিথ নেসবিট-এর অলৌকিক গল্পগুচ্ছ, এলিজাবেথ গৌজ-এর ‘দ্য লিটল হোয়াইট হর্স’, পল গ্যালিকো-র ‘ম্যাংক্সমাউজ’ খুদে বয়সেই পড়ে ফেলেন রোওলিং। একটু বড় হলে তাঁর হৃদয় কেড়ে নেয় জেসিকা মিটফোর্ড ও জেন অস্টেন। পরবর্তী সময়ে নিজের লেখায় এই বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের প্রভাব মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন রোওলিং।

আরও পড়ুন-ময়দানে প্রাণ ফেরায় খুশি সুব্রত-মানসরা

ওয়াইডিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর ইউনিভার্সিটি অফ এক্সিটার-এ ফ্রেঞ্চ সাহিত্য নিয়ে বিএ করেন রোওলিং। ইংরেজি ও ফরাসি— দুটো ভাষার ওপর দখল তাঁকে লন্ডন শহরে কয়েকটা অস্থায়ী চাকরি পেতে সাহায্য করেছিল। ১৯৯০ সালে একদিন কাজের সূত্রে ট্রেনে করে লন্ডন থেকে ম্যাঞ্চেস্টার যাওয়ার পথে আচমকাই তাঁর কল্পনায় ধরা দেয় এক অনাথ ছেলের কাহিনি, যে কিনা জাদুস্কুলে পড়তে গিয়ে অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা ঘটায়। এই নিয়ে উপন্যাস লিখলে ছোটদের ভাল লাগবে— এরকম ভাবনা থেকেই প্লটটা বাড়াতে শুরু করেন তিনি। কিন্তু বেশিদূর সেরকম এগোনোর আগেই রোওলিং-এর জীবনে নেমে আসে দুর্যোগ; মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রোগে মৃত্যু হয় তাঁর মায়ের। সেই বিপর্যয়ের রেশ কাটিয়ে ওঠার আগেই আরও এক সমস্যা হাজির হয়। যেসব অস্থায়ী চাকরির সঙ্গে এতদিন যুক্ত ছিলেন তাদের দরজা একে একে বন্ধ হতে শুরু করে তাঁর সামনে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৯১ সালে নাইট স্কুলে ইংরেজি পড়ানোর চাকরি নিয়ে পর্তুগাল পাড়ি দেন রোওলিং। সেখানেই তাঁর পরিচয় হয় টেলিভিশন সাংবাদিক হরহে আরান্তেস-এর সঙ্গে। মাসকয়েক মেলামেশার পর তাঁকে বিয়ে করে সংসার পাতেন তিনি।

আরও পড়ুন-৫ দিনের দিল্লি সফরে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী

দুর্ভাগ্যবশত রোওলিং-এর বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। আরান্তেস প্রায়ই চিৎকার-চেঁচামেচি করতেন তাঁর ওপর, ছোটখাটো কারণে গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করতেন না। ১৯৯৩ সালে অত্যাচার-কটূক্তি সহ্যের সীমা পেরোলে স্বাধীনচেতা রোওলিং স্বামীর ঘর ছাড়েন। একরত্তি সন্তান জেসিকা-কে নিয়ে স্কটল্যান্ড-এ ফিরে আসেন তিনি; বোনের বাড়িতে কিছুদিন কাটানোর পর এককুঠুরি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন এডিনবরা শহরে। হাতে রোজগার নেই, দারিদ্র্য প্রতিমুহূর্তে হাঁ করে গিলতে আসছে, সম্বল বলতে সোশ্যাল সিকিউরিটির সামান্য ক’টা টাকা— একলা মায়ের পক্ষে তখন দিন গুজরান সহজ ছিল না। মানসিক বিষণ্ণতার অন্ধকারে তলিয়েই যেতে পারতেন রোওলিং, কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না। বরং জেদ ধরলেন, অসমাপ্ত ফ্যান্টাসি উপন্যাসটা যেভাবেই হোক শেষ করবেন। তাঁর সস্তার ফ্ল্যাটে রুম হিটিং-এর কোনওরকম বন্দোবস্ত ছিল না; শীতের দিনগুলোতে মেয়েকে নিয়ে রোওলিং চলে যেতেন স্থানীয় পাব-এ। সেখানে বসেই চলত লেখালিখি, স্বপ্নকে বাস্তব করে তোলার লড়াই। ১৯৯৫ সালে লক্ষ্যপূরণ হল, ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোজফারস স্টোন’ লেখা শেষ করলেন রোওলিং।

আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসে শুভেচ্ছা বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

তারপর শুরু হল বই প্রকাশের চেষ্টা। এজন্য কম ঘাম ঝরাতে হয়নি রোওলিংকে। বারোজন প্রকাশকের দপ্তরে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার করুণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে; এমনও দিন গেছে যে টাকার অভাবে পাণ্ডুলিপি জেরক্স অবধি করে উঠতে পারেননি, রাত জেগে নিজের হাতে টাইপ করে কপি বানিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে ‘ব্লুমসবেরি’ বইটা ছাপতে রাজি হওয়ার পরেও শেষ একটা বাধা রয়েই যাচ্ছিল। রক্ষণশীল ইংরেজ পাঠক তাঁর মতো এক অপরিচিতা মহিলার বই হাতে তুলে নেবে কিনা তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না প্রকাশনার কর্তাব্যক্তিরা। তাঁদের নির্দেশে রোওলিং বাধ্য হন লেখিকা হিসেবে নিজের পুরো নাম ও পদবির বদলে দুটো আদ্যক্ষর ও পদবি ব্যবহার করতে। মাঝের নাম না থাকায় ঠাকুমার কাছ থেকে ক্যাথলিন নামটা ধার করেন তিনি। ১৯৯৭ সালের ২৬ জুন প্রকাশিত হয় ‘ফিলোজফারস স্টোন’, লেখিকা হিসেবে জে কে রোওলিং নামটাই সিলমোহর পায় বইয়ের প্রচ্ছদে। এরপরের ঘটনাগুলো সবারই জানা।

আরও পড়ুন-রাজস্থানে ভেঙে পড়ল যুদ্ধ বিমান, মৃত ২

‘ফিলোজফারস স্টোন’ অভাবনীয় সাফল্য পেল, সিরিজের বাকি বইগুলোও পাঠকের ভালবাসা আদায় করে নিল অনায়াসে। পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হল হ্যারি পটার, বিখ্যাত আমেরিকান সংস্থা ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর প্রযোজনায় রুপোলি পর্দাতেও ঝড় তুলল ‘দ্য বয় হু লিভড’। পরপর দু’বার ‘চিলড্রেন’স বুক অফ দ্য ইয়ার’ অ্যাওয়ার্ড, ২০০০ সালে ‘অফিস অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ অ্যাওয়ার্ড, সেই বছরই ‘গবলেট অফ ফায়ার’ উপন্যাসের জন্য হুগো অ্যাওয়ার্ড— সম্মান ও পুরস্কারের ঢেউয়ে ভেসে গেলেন রোওলিং। লেখিকার ব্যথাতুর হৃদয়ে মলম লাগানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন ভাগ্যদেবী স্বয়ং; আবার প্রেম এল রোওলিং-এর জীবনে, এবার ডাক্তার নীল মারে-র বেশে। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন রোওলিং, সুখী দাম্পত্যের নীড় বাঁধলেন মনের আনন্দে। ২০০৫ সালে ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিন রোওলিং-কে ‘দ্য ফার্স্ট বিলিয়ন ডলার অথার’-এর স্বীকৃতি দিল। ২০০৮ সালে ‘ব্রিটিশ বুক অ্যাওয়ার্ড’, তার পরের বছর ‘লিজিয়ন অফ অনার’—একের পর পালক জুড়তেই থাকল তাঁর মুকুটে। সাম্প্রতিক সময়ের জনপ্রিয়তম সাহিত্যিক হয়ে ওঠার যাত্রায় অনেকখানি পথ পাড়ি দিলেন জোয়্যান রোওলিং।

আরও পড়ুন-বিজেপি চোরকে বাঁচাচ্ছে, ফের শুভেন্দুকে একহাত নিলেন কুণাল ঘোষ

কথায় বলে গোলাপে কাঁটা থাকে। ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের জন্য রোওলিং-কেও যথেষ্ট বিতর্কের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ন্যান্সি স্টোফার রোওলিং-এর বিরুদ্ধে কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ আনেন। ন্যান্সি-র দাবি ছিল, ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত তাঁর কিছু গল্প থেকে চুরি করে হ্যারি পটার লিখেছেন রোওলিং। বিষয়টা আদালত অবধি গড়ায়, ২০০২ সালে আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হন রোওলিং। প্রায় একই সময়ে আমেরিকায় ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করেন রক্ষণশীল খ্রিস্টান সমাজের একাংশ। রোলিং-এর বইয়ে জাদুবিদ্যা, ডাকিনীতন্ত্রের যে বর্ণনা রয়েছে তা শিশু-কিশোরদের মনে খারাপ প্রভাব ফেলবে—এই অভিযোগে ছোটদের লাইব্রেরি এবং বইয়ের দোকানের বাইরে ধর্নায় বসেন তাঁরা, রোওলিং-কে বয়কট করার এবং তাঁর বই পোড়ানোর ডাক দেন প্রকাশ্যে। বিক্ষোভের আঁচ আমেরিকা-র বাইরেও ছড়ায়; সৌদি আরবের প্রাইভেট স্কুলগুলোতে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় হ্যারি পটার। তবে স্বস্তির বিষয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থিতিয়ে গেছে সমস্ত বিরোধিতা, কোনও অভিযোগই ধোপে না টেকায় রণে ভঙ্গ দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। পণ্ডিতরা প্রমাণ করেছেন, হ্যারি পটার খ্রিস্টধর্মের পরিপন্থী নয়, বরং নিখুঁতভাবে তারই অনুসারী। রোওলিং-এর কাহিনির নায়ক হ্যারি আসলে প্রভু যিশুরই প্রতীক; আত্মত্যাগ ও ভালবাসার মাধ্যমে অশুভকে জয় করে সে, আলোর পথ দেখায় বারবার।

আরও পড়ুন-রাজস্থানে ভেঙে পড়ল যুদ্ধ বিমান, মৃত ২

২০০৭ সালে হ্যারি পটার সিরিজের শেষ উপন্যাস ‘ডেথলি হ্যালোজ’ প্রকাশের পর রোওলিং কয়েকবছর লেখালিখি থেকে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। ২০১২ সালে আবার সাহিত্যের জগতে ফিরে আসেন তিনি। চাইলেই হ্যারি-কে নিয়ে সিকুয়েল অথবা একই ঘরানার কোনও উপন্যাস লিখে বাজিমাত করতে পারতেন, নিশ্চিত করতে পারতেন লক্ষ লক্ষ কপি বই বিক্রি। কিন্তু রোওলিং আলাদা ধাতুতে গড়া, সবসময় চেনা ছকের বাইরে তাঁর পদচারণা। গ্রাম্য ব্রিটেন-এর পটভূমিকায় লেখা সামাজিক উপন্যাস ‘দ্য ক্যাজুয়াল ভ্যাকেন্সি’ দিয়ে নিজের দ্বিতীয় ইনিংসের সূচনা করলেন তিনি। বাণিজ্যিক সাফল্য খুব বেশি না এল না বটে, কিন্তু সমালোচকরা তাঁর এই ব্যতিক্রমী প্রয়াসকে মন খুলে প্রশংসা করলেন। এর ঠিক পরপরই রোওলিং আরেকটা চ্যালেঞ্জ নিলেন, রবার্ট গেইলব্রেথ ছদ্মনামে লিখে ফেললেন ক্রাইম নভেল ‘দ্য কুকু’জ কলিং’। যখন জানা গেল গেইলব্রেথ আসলে রোওলিং, হইচই পড়ে গেল চারদিকে, বইয়ের বিক্রিও বাড়ল অনেকটাই। পরে এই সিরিজে তিনি আরও চারটে বই লিখেছেন— ‘দ্য সিল্কওয়ার্ম’, ‘কেরিয়ার অফ ইভিল’, ‘লিথ্যাল হোয়াইট’ ও ‘ট্রাবলড ব্লাড’।

আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথ তপোবন শিক্ষার সঙ্গে মিশিয়ে ছিলেন পশ্চিমী শিক্ষার রঙ

বিগত দু’ দশকে সাহিত্যিকের পাশাপাশি সমাজসেবী হিসবেও জোয়্যান রোওলিং-এর স্বতন্ত্র পরিচিতি গড়ে উঠেছে সর্বত্র। ২০০১ সালে প্রয়াত মায়ের স্মৃতিতে ‘ভোল্যান্ট চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’ খোলেন রোওলিং, যার উদ্দেশ্য সমাজের প্রান্তিক মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের সবরকমভাবে সাহায্য করা। ২০০৫ সালে অনাথ ও বিকলাঙ্গ শিশুদের জন্য ‘চিলড্রেন’স হাই লেভেল গ্রুপ’ (যার বর্তমান নাম ‘লুমোস’) প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ‘কুইডিচ থ্রু দ্য এজেস’, ‘টেলস অফ বিডল দ্য বার্ড’ জাতীয় বই থেকে পাওয়া লভ্যাংশ এই সংস্থাগুলোর তহবিলে দান করেছেন রোওলিং। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর নিঃস্বার্থ দানের খতিয়ান রীতিমতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যেমন ২০১০ সালে এডিনবারা ইউনিভার্সিটির মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রিসার্চ সেন্টার-এর উন্নতিকল্পে এক কোটি পাউন্ড-এর ডোনেশন অথবা একেবারে হাল আমলে কোভিড মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া দুই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন খালসা এইড ও ব্রিটিশ এশিয়ান ট্রাস্ট-এর হাতে তুলে দেওয়া বিপুল অঙ্কের অর্থসাহায্য।

আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথ তপোবন শিক্ষার সঙ্গে মিশিয়ে ছিলেন পশ্চিমী শিক্ষার রঙ

এত সবের মধ্যেও অবশ্য ছোটদের কথা ভোলেননি জোয়্যান রোওলিং। হ্যারি-র ম্যাজিক দুনিয়ারই অন্য এক নায়ক নিউট স্ক্যামেন্ডার-এর বিভিন্ন অভিযান নিয়ে ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর ফিল্ম সিরিজ ‘ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস অ্যান্ড হোয়্যার টু ফাইন্ড দেম’-এর জন্য তিনি চিত্রনাট্য লিখেছেন, ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের ত্রাসে যখন গোটা বিশ্ব ঘরবন্দি তখন কচিকাঁচাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে তাঁর রূপকথার বই ‘ইকাবগ’। গতবছরের শেষদিকে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর আরেকটা ছোটদের উপন্যাস ‘দ্য ক্রিসমাস পিগ’। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে খুদেদের জন্য আরও অনেক বই লিখবেন রোওলিং, ইংরেজি শিশুকিশোর সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধতর হবে তাঁর মায়াকলমের হেমপরশে।

আরও পড়ুন-মানবতার গল্প ধর্মযুদ্ধ

আগামী ৩১ জুলাই জোয়্যান রোওলিং-এর জন্মদিন, ৫৭ বছর পূর্ণ করবেন আমাদের সকলের প্রিয় লেখিকা। ষাট পেরোনোর আগেই কোনও ব্যক্তি কিংবদন্তির পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছেন— এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু রোওলিং-এর ক্ষেত্রে এই বিরল ঘটনাটাই সত্যি হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ, আর্থিক অনটন, ডিপ্রেশন-এর চোরাবালি থেকে যেভাবে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এসেছেন তিনি, যেভাবে অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার ডানায় ভর করে জয় করেছেন কীর্তি ও প্রতিপত্তির শিখর— সে-কাহিনি সিন্ডারেলা-র গল্পকেও হার মানায়। তাইতো আজ কোটি কোটি মানুষের কাছে অনুপ্রেরণার আরেক নাম জোয়্যান রোওলিং, দেশ-ভাষা-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে আপামর পাঠক-পাঠিকার হৃদয়-সিংহাসনে তাঁর ভাস্বর অধিষ্ঠান।

Latest article